সাক্ষাৎকার

জরুরি স্বাস্থ্যসেবাকে বলা হয় হাসপাতালের আয়না

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শামীম আহসান। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক। দীর্ঘদিন ধরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরকারি হাসপাতালটি পরিচালনা করছেন তিনি। রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। জরুরি স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাপনা, সীমাবদ্ধতা ও অগ্রগতি নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রাথমিক জরুরি স্বাস্থ্যসেবা কি শুধু স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক?

প্রাথমিক জরুরি স্বাস্থ্যসেবা যেখানে প্রয়োগ শুরু হয় সেটাকে বলা হয় ইনসিডেন্ট স্পট। কোনো দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ডে স্বাস্থ্যসেবা সেখান থেকে শুরু হয়। সেখানে দুই ধরনের কাজ হয়। শুরুতে ট্রায়াজ (রোগীর অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে দ্রুত চিকিৎসার ধরন চিহ্নিত করার দলগত কাজ) ফর ইভাকুয়েশন বা উদ্ধার আর ট্রায়াজ ফর ট্রিটমেন্ট বা চিকিৎসা। চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে চিন্তা করা হয় কোন রোগীকে কী চিকিৎসাসেবা দেয়া হবে, কীভাবে দেয়া হবে সেসব। আর উদ্ধারের ক্ষেত্রে দেখা হয় কাকে আগে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে, কীভাবে পাঠানো হবে সেসব। এর পরের সেবাটা আসে হাসপাতালকেন্দ্রিক। স্কুলে একটা ছেলে ব্যথা পেলে বা কারখানায় একজন শ্রমিক ব্যথা পেলে কী করবে সেগুলো উঠে আসে সেখানে। হঠাৎ বুকে ব্যথা হলে কী করতে হবে সেটাও দেখা হয়। তবে অনেক সময় দেখা যায় খেলার মাঠে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে অন্য খেলোয়াড়রা ভুলভাবে আহতকে বহন করে নিয়ে যায়, তাতে আক্রান্তের আরো ক্ষতি হয়ে যায়। তাই আমাদের স্কুলে, কলেজে বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার মতো ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা থাকা দরকার। যেমন সিপিআর ট্রেনিং বা বেসিক লাইফ সাপোর্ট ট্রেনিং দেয়া হয় তেমন। পৃথিবীর উন্নত সব দেশেই এমন ট্রেনিং দেয়া হয়। সেখানে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা কীভাবে দিতে হবে? কী দেখলে কি করতে হবে সেসব শেখানো হয়।

কী কী সেবা জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত থাকে?

হার্ট অ্যাটাকস্ট্রোক, সাপে কাটা, অর্থোপেডিক নানা সমস্যা, আগুনে পোড়া, শিশুদের নানা সমস্যা নিয়ে রোগীরা জরুরি বিভাগে আসেন। এমনকি তীব্র ডায়রিয়া নিয়েও অনেকে হাসপাতালে আসছেন। তাদের জরুরি বিভাগে অবজারভেশনে রাখা হচ্ছে, সেখানেই চিকিৎসা করা হচ্ছে। কিন্তু ভর্তি করা হচ্ছে কম। সেখানেই এসব রোগীর সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। সব ধরনের বিশেষজ্ঞও সেখানে আছেন। এমনকি আমাদের জরুরি বিভাগে নাক-কান-গলা এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞও আছেন।

দেশে সরকারি বেসরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্যে জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় কোনো পার্থক্য রয়েছে কি?

অবশ্যই রয়েছে। বেসরকারি খাতে বেশির ভাগ হাসপাতাল হলো ডিপার্টমেন্টভিত্তিক। জরুরি বিভাগে মেডিকেল অফিসার থাকে এবং সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রম থাকে। আমাদের হাসপাতালে কিন্তু আইসিইউ সেটআপও আছে। তাছাড়া মাস ক্যাজুয়ালটি ডিল করার ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থান খুবই ভালো।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক টারশিয়ারি পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে কী ধরনের পার্থক্য রয়েছে? সেসব কি প্রাতিষ্ঠানিক পার্থক্য, নাকি সীমাবদ্ধতা এর কারণ?

দুটোই পার্থক্য। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন গ্র্যাজুয়েট ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসাটাই দিতে পারবেন। ইন্টারভেনশনাল বা অন্যান্য যে সেটআপ দরকার তা তারা দিতে পারবেন না। সেখানে অ্যানেসথেটিকস বা অর্থোপেডিকস চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব না। যেটা আমাদের জেলা পর্যায়ের অনেক হাসপাতালে দেয়া সম্ভব। তারপর অবশ্যই মেডিকেল কলেজগুলোতে সেবা দেয়া সম্ভব।

জরুরি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক নীতিগত কোনো সীমাবদ্ধতা রয়েছে কি?

আমাদের গর্ব যে আমরা ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার প্রতিষ্ঠা করেছি। তা দেখে বিভিন্ন হাসপাতালে এবং বিভিন্ন সেটআপে ইমার্জেন্সি কেয়ার স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমরা যখন ইমার্জেন্সি কেয়ারে একজন রোগীকে নিয়ে আসি তখন আশা করি হাসপাতালে পৌঁছালে সে ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু ইমার্জেন্সি কেয়ার সঠিক না থাকলে হাসপাতালে যাওয়ার পরে তারা নানান ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। জরুরি স্বাস্থ্যসেবাকে বলা হয় হাসপাতালের আয়না। হাসপাতাল কত ভালো চলছে, কত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যাচ্ছে এবং কত দ্রুত বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে তা বোঝা যায় সেখানকার জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দেখেই।

বাংলাদেশে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে উন্নত দেশের জরুরি স্বাস্থ্যসেবার পার্থক্য বা সীমাবদ্ধতা কী?

জরুরি স্বাস্থ্যসেবা কিন্তু উদ্ধারকাজ দিয়ে শুরু। উন্নত দেশে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আলাদা নার্স, আলাদা ডাক্তাররা কর্মরত থাকেন। চিকিৎসার বড় একটা অংশ তারা অ্যাম্বুলেন্সে বসে বা উদ্ধার চলার সময়েই শেষ করতে পারেন, যেটা আমরা পারি না। আমাদের সীমাবদ্ধতা আমরা ওভাবে বিশেষায়িত জনবল তৈরি করতে পারিনি, যেখানে একই মানুষ বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে প্রশিক্ষিত থাকবে। সে হার্টের চিকিৎসার জন্য, আইসিইউ সেবার জন্য, ইনজুরি ডিল করার জন্যও প্রশিক্ষিত থাকবে। তাছাড়া আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোতে মাস ক্যাজুয়ালটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান নেই। যা বিশ্বের অন্য সব হাসপাতালে থাকা বাধ্যতামূলক। যদি একসঙ্গে ১০০-২০০-৫০০ রোগী আসে তাহলে কী করব, রোগীরা কী করবে, শৃঙ্খলা কীভাবে বজায় থাকবে সেসব বিষয় কিন্তু পরিকল্পনার মধ্যে থাকে। সেটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তৈরি করতে হবে। আমরা যারা এসব আংশিকভাবে করতে চাই, তারা কেউ বাস্তবায়ন করতে পারি কেউ পারি না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন