সাইক্লিং ক্লাব

বাকৃবি ছাত্রীদের নিত্যদিনের সঙ্গী সাইকেল

ফিচার প্রতিবেদক

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়ামে বাকৃবি উইমেন সাইক্লিং ক্লাবের শোভাযাত্রা ছবি: বাকৃবি উইমেন সাইক্লিং ক্লাব

ক্যাম্পাসের আয়তন ১ হাজার ২৩১ একর। বিশাল এ ক্যাম্পাসে সাইকেলে চড়ে ছুটে চলছেন মেয়েরা। বাধাহীনভাবে পাড়ি দিচ্ছেন পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরত্বের জব্বারের মোড় থেকে ডেইরি ফার্ম ল্যাব, কেআর মার্কেট থেকে আমবাগান এগ্রোনমি ফিল্ড কিংবা ভেটেরিনারি অনুষদ থেকে রিসার্চ অ্যানিমেল ফার্ম। বলছি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ছাত্রীদের সাইক্লিং শেখানোর সংগঠন বাকৃবি উইমেন সাইক্লিং ক্লাবের কথা। শুরুটা ২০১৭ সালে। হাতেগোনা দু-একজন ছাত্রী সাইকেল চালাতে জানতেন। এত বড় ক্যাম্পাসে যারা সাইকেল চালাতে জানতেন না তাদের নির্ভর করতে হতো রিকশার ওপর। অথবা হেঁটেই ক্লাস কিংবা ব্যবহারিক ক্লাসে যেতে হয়েছে তাদের। সেই থেকে শুরু করে আজ মেয়েরা চলাচলের জন্য হয়েছে স্বনির্ভর। ক্যাম্পাসে বের হলেই এখন সাইকেল তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। যদিও মেয়েদের এ পথচলা মোটেও সহজ ছিল না। ছিল অনেক বাধা।

‘‌মেয়ে হয়ে সাইকেল চালাবে! কেমন মেয়ে ও! ’ এ রকম নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী সাইক্লিস্টদের। কোনো মেয়ে সাইকেল চালিয়ে গেলে তার দিকে একটু আলাদাভাবে তাকাতেন আশেপাশের মানুষ। অবশ্য তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়েরই। অনেক মেয়ে লজ্জাবোধ থেকে সাইকেল চালাতে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে একেক সময় একেক জায়গায় যেতে হয়। যার গড় দূরত্ব প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার। হেঁটে সময়মতো ক্লাস ধরা অসম্ভব হতো মেয়েদের। এত বড় ক্যাম্পাসে চলাচলের জন্য মেয়েদের রিকশার ওপর ভরসা করে থাকাটা মেনে নিতে পারেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রগতিশীল শিক্ষক। তাদের মধ্যে অন্যতম পোলট্রি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সুবাস চন্দ্র দাস। তার উদ্যোগ ও অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো যাত্রা করে বাকৃবি উইমেন সাইক্লিং ক্লাব। লক্ষ্য একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি মেয়ে সাইকেল চালাতে জানবে, প্যাডেলে ভর করে স্বনির্ভর হয়ে চলাচল করবে; সাইকেল ছেলে-মেয়ে যেকোনো মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় একটি যানবাহন—এই ধারণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি মানুষ বিশ্বাস করবে।

সেই থেকে বাকৃবি উইমেন সাইক্লিং ক্লাবের যাত্রা। পথপরিক্রমায় পেরিয়ে গেছে প্রায় ছয় বছর। এই ছয় বছরে সংগঠনটি প্রায় এক হাজার মেয়েকে হাতে ধরে সাইকেল চালানো শিখিয়েছে। একসঙ্গে গ্রুপ সাইক্লিং করে ক্যাম্পাসে যেন ডানা মেলে উড়ার আনন্দ উপভোগ করতে শিখিয়েছে মেয়েদের। এখন তার ফলাফলও দৃশ্যমান। বাকৃবির প্রত্যেকটি ছাত্রী হলে এখন সাইকেল স্ট্যান্ড ভর্তি সাইকেল দেখা যায়। স্থান সংকুলান করতে না পেরে হল প্রশাসন এখন সাইকেল স্ট্যান্ড সম্প্রসারণ করতে বাধ্য হচ্ছে। সাইকেলে ভর দিয়ে ছাত্রীরা এখন ক্লাস করছেন। বাকৃবি পাঁচটি হলেই রয়েছে উইমেন সাইক্লিং ক্লাবের হল প্রতিনিধি এবং অনুষদভিত্তিক রয়েছে অনুষদ প্রতিনিধি। প্রত্যেকটি ছাত্রী হলে উইমেন সাইক্লিং ক্লাবের নিজস্ব সাইকেলও রয়েছে। এগুলো দিয়ে আবাসিক হলের ভেতর শিক্ষার্থীদের সাইকেল চালানো শেখানো হয়। যেকোনো প্রয়োজনে দিনপ্রতি ৫ টাকা দিয়ে নিতে পারেন সাইকেল ভাড়া। প্রতি শুক্রবার বাকৃবি হেলিপ্যাডে সাইকেল চালানো শেখানো হয়। সেখানে আবাসিক, অনাবাসিক সব ছাত্রীই সাইকেল চালানো শিখতে পারেন। ক্লাবের সদস্যরা পালাক্রমে শেখান নতুন সদস্যদের। কেউ কেউ দুই-একদিনের মধ্যেই বা কিছু ক্ষেত্রে এক বেলাতেই সাইকেল চালানো শিখে যান। আবার অনেকের চার-পাঁচদিনও সময় লাগে যায়। 

চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী রাজিয়া ইসলাম রাখি বলেন, ‘‌রক্ষণশীল পরিবার হওয়ায় শখ থাকা সত্ত্বেও সাইকেল চালানো শেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ভার্সিটিতে এসে একটি ক্লাব সম্পর্কে জানতে পারি যারা মেয়েদের বিনামূল্যে সাইকেল চালানো শেখায়। তারপর আমি উইমেন সাইক্লিং ক্লাবের মাধ্যমে সাইকেল চালানো শিখি। এখন আমি অনেক দ্রুত সাইকেল চালাতে পারি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জায়গাগুলো ঘুরে দেখার ইচ্ছা ছিল বহুদিনের তা আজ সাইকেল চালাতে পারি বলে পূরণ হয়েছে।’

ক্লাবটির আয়োজনে দিবসকেন্দ্রিক থাকে নানা কর্মসূচি। আন্তর্জাতিক নারী দিবস, মা দিবস, আন্তর্জাতিক সাইক্লিং দিবসে মেয়েদের সাইকেল শোভাযাত্রা ও সাইক্লিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এ ক্লাব। এবার আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন অনুপ্রেরণাময়ী সফল নারী শিক্ষার্থী ও একজন নারী শিক্ষককে প্রদান করা হয় ‘‌স্পার্কেল অ্যাওয়ার্ড’। উইমেন সাইক্লিং ক্লাবের সদস্যরা নিজেরা গ্রুপ করে সাইক্লিং করতে বের হন ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে। এখন অনায়াসেই ১ হাজার ২০০ একর ক্যাম্পাসের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সৌন্দর্য উপভোগ করেন তারা। 

উইমেন সাইক্লিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা বাকৃবির পোলট্রি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সুবাস চন্দ্র দাস বলেন, ‘‌বাকৃবিতে ক্লাস ও ল্যাবসমূহ অনেক দূরে হওয়ায় ছাত্ররা খুব সহজেই সাইকেলের মাধ্যমে যাতায়াত করতে পারলেও ছাত্রীরা পড়েন দুর্বিপাকে। সেই থেকে আমি চিন্তা করেছিলাম ছাত্রীদের এ ব্যাপারে সংঘবদ্ধ হওয়া উচিত। কালের পরিক্রমায় এখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস মেয়েদের সাইক্লিংয়ের সাবেকি ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে এসেছে। এখন ক্যাম্পাসে মেয়েরা সুন্দরভাবে সাইকেল চালাতে পারেন, সাইকেল কেনার হারও অনেক বেড়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন