হাসনাত আবদুল হাইয়ের জন্মদিন

সাতাশিতেও সৃষ্টিশীল

শানজিদ অর্ণব

ছবি: হাসনাত আবদুল হাইয়ের ফেসবুক

আজ সাতাশিতে পা দিয়েছেন দেশের অন্যতম সাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই। তিনি এ বয়সেও সৃষ্টিশীলতা, অনুসন্ধানী মন, আর পাঠাভ্যাস দিয়ে যেকোনো তরুণকে লজ্জায় ফেলে দিতে পারেন। তার বাসায় গেলে দেখা মিলবে ঘরময় ছড়ানো নানা বিষয়ে কতশত বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিনের। সেসবেই ডুবে আছেন সারাক্ষণ। আর অতি অবশ্যই লিখে চলেছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ; কখনো মনের আনন্দে করছেন অনুবাদ। ২০২৩ সালে প্রকাশিত ঈদ সংখ্যাগুলোয় তার একাধিক গল্প, উপন্যাস প্রকাশ হয়েছে। এ সাতাশিতেও থেমে নেই তার মন, তার কি-বোর্ড। তার এমন জীবন দেশের যেকোনো তরুণ লেখককে প্রেরণা দিতে পারে।

হাসনাত আবদুল হাই সাতাশিতেও নতুন হয়ে থাকছেন। এ বছরের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা গ্রন্থ নদীপথে, সঙ্গে ইউলিসিসবাংলাদেশে ইউলিসিস নিয়ে এমন বই অন্তত আমার জানামতে আর নেই। ইউলিসিস বিশ্বসাহিত্যের এক বিস্ময়কর কীর্তি। কারো মতে, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। তার পরও এ উপন্যাস সারা বিশ্বে কতজন পুরোটা পড়তে পেরেছেন তা জানতে জরিপ হতে পারে। ইউলিসিস বোঝার জন্য পশ্চিমে আছে অনেক গাইড বই। নদীপথে, সঙ্গে ইউলিসিস বাংলা ভাষার পাঠকের জন্য জেমস জয়েসের ইউলিসিস পাঠের সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

তবে এ পর্যায়ে বইটি লেখার প্রেক্ষাপটটি উল্লেখ করা যায়। উচ্চশিক্ষা শেষে যখন বিদেশ থেকে ফেরার সময় নিয়ে এসেছিলেন ইউলিসিস, কিন্তু সেটি ডাকবিভাগ বাজেয়াপ্ত করেছিল। তার অনেক বছর বইটি তিনি কেনেন নিউ মার্কেটের জিনাত বুক সাপ্লাই থেকে (ঢাকার এ বিশিষ্ট বইয়ের দোকানটি এ মাসে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে)। ১৯৯৩ সালে সদরঘাট থেকে রকেট জাহাজ গাজীতে খুলনায় গিয়েছিলেন সরকারি দায়িত্ব পালনে। সে যাত্রায় প্রথমবার পড়ে শেষ করলেন ইউলিসিস। উপন্যাসটি পড়ার অভিজ্ঞতা, সেই নৌভ্রমণ, নদীর জীবন নিয়ে ঢাকায় ফেরার পর দৈনিক ভোরের কাগজে ট্রাভেলগ নামে ধারাবাহিক লিখতে শুরু করেন। চারটি কিস্তি লিখেছিলেন। অর্ধেকটা অপ্রকাশিত রয়ে গিয়েছিল।

ছবি: আউট বই

২০২২ সালে খেয়াল করলেন সে বছর ইউলিসিস প্রকাশের শতবর্ষ। মনে পড়ল সেই ভ্রমণ, আর পাণ্ডুলিপির কথা। সিদ্ধান্ত নিলেন শতবর্ষে ইউলিসিস আর তার লেখককে নিয়ে লেখার। খুঁজে বের করলেন তিন দশক আগের হলুদ হয়ে আসা পাণ্ডুলিপি। নিজের মোবাইল ফোনেই টাইপ করে ফেললেন সেই পাণ্ডুলিপি। এর মাঝে আবার ড. গিফোর্ডের অ্যানোটেশন বইয়ের সাহায্য নিয়ে দ্বিতীয়বার পড়লেন ইউলিসিস। পাণ্ডুলিপির সঙ্গে যুক্ত করলেন অধ্যায়ভিত্তিক সারসংক্ষেপ এবং বইটি নিয়ে আরো কিছু মূল্যায়ন। নদীপথে, সঙ্গে ইউলিসিস ২০২৩-এর অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশ হয়েছে। ছিয়াশি বছরে এমন কীর্তি সম্পাদন বিস্ময়ের উদ্রেক করে বৈকি! মুর্তজা বশীর তাকে নিয়ে হয়তো এজন্যই বলেছেন, হাসনাত আবদুল হাইয়ের লেখায় যে বৈশিষ্ট্য আমাকে মুগ্ধ করে তা হলো গতানুগতিকতা ও পৌনঃপুনিকতা পরিহার করে নতুনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নিত্যনতুনের অনুসন্ধান ও চর্চা একজন শিল্পী বা লেখককে চির তরুণ করে রাখতে পারে, হাসনাতকেও তাই করেছে। নদীপথে, সঙ্গে ইউলিসিস তার চির তরুণ শিল্পীসত্তারই স্মারক।

হাসনাত আবদুল হাইয়ের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৭ মে, কলকাতায়। পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার সৈয়দাবাদ গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষা লাভের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৫ সালে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। সাহিত্যচর্চা শুরু করেন ছাত্র জীবন থেকেই। সাহিত্য ও জ্ঞান চর্চার নানা শাখায় স্বচ্ছন্দে বিচরণ করছেন ছয় দশকের অধিককাল ধরে। বাংলা এবং ইংরেজিতে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, স্মৃতিকথা, নাটক, অনুবাদ, অর্থনীতি বিষয়ে প্রবন্ধ সংকলন ইত্যাদি মিলিয়ে তার মোট প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। পেয়েছেন অনেক সাহিত্য পুরস্কার। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯৬ সালে পেয়েছেন একুশে পদকতার লেখা উপন্যাস সুলতান ডাবলিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়।

শানজিদ অর্ণব: লেখক ও সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন