জয়নুল আবেদিন: পঞ্চাশে ‘মনপুরা ৭০’

ওয়াহিদ সুজন

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছবি: জয়নুল আবেদিন জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি বই থেকে

১৯৭০ সাল; জয়নুল আবেদিন যে বছর ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যের ‘নবান্ন’র মতো উৎসবমুখর ছবি আঁকছেন। তখনো কি তিনি জানতেন ঠিক বিপরীত একটা ছবির উৎসমূল রচিত হচ্ছে ওই বছর। যা শুধু জয়নুলের ছবির বিষয় হয়েছে তা-ই নয়, পূর্ববঙ্গের মানুষের ভাগ্য বদলের অন্যতম নিয়ামক হয়ে উঠবে। সেই ছবির ৫০ পূর্ণ হচ্ছে এ বছর। 

বাংলাদেশে ঘটা প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর অন্যতম ১৯৭০ সালের নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ‘গোর্কি’। তীব্র জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেসে যায় হাজার হাজার মানুষ। সাহায্যের অভাবে খাদ্য ও পানীয়র অভাবে আরেক দফা মৃত্যু ঘটে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের উদাসীনতা প্রমাণ করেছিল যে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-মৃত্যু তাদের কাছে কোনো মূল্য বহন করে না। যার উত্তরও পায় তারা। সাইক্লোনের এক মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে একচেটিয়া বিজয় লাভ করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।

গোর্কি ট্র্যাজেডি বিষয় হয়েছে জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্মে। পত্রিকার সংবাদ বা লোকমুখে শুনে আঁকেননি তিনি। সরজমিনে ঘটনাস্থলে হাজির হয়েছিলেন। এরপর বেশকিছু স্কেচ আঁকেন, যা একেকটি মাস্টারপিস হয়ে উঠলেও আদতে হাত মকশো করছিলেন শিল্পাচার্য। যার পরিপূর্ণ রূপ আমরা দেখি ১৯৭৩ সালে। সেই ছবির নাম ‘মনপুরা ৭০’। 

৩০ ফুটের বিশালাকার এ স্কোলচিত্রে সমুদ্রের পটভূমিতে এসেছে স্থলভাগ। যেখানে সারি সারি মরদেহ। প্রকৃতিসংলগ্ন মানুষ জীবৎকালে অন্য প্রাণকে পৃথক করে না, মৃত্যুও তাই। জয়নুলের ছবিতে শুধু মানুষ নয়, মৃত গরু-মহিষও একাকার হয়ে গেছে। মরদেহের সারির শেষ প্রান্তে দেখা যায় একমাত্র জীবিত মানুষটি হাঁটু মুড়ে বসে আছে। এত ধ্বংসযজ্ঞের মাঝেও মানুষ পরাজিত হয় না। প্রতিটি ধ্বংসস্তূপ থেকে সে নতুন করে শুরু করে; এই যেন সেই দৃশ্য। এও কল্পনা করা যায়, এত ধ্বংস, এত মৃত্যুর মাঝে বেদনাহত, স্তব্ধ এক শিল্পী। যার হাতে ফুটে উঠবে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার গল্প। সাধারণ মোটা কাগGজ আঁকা যে ছবি হয়ে উঠবে অমূল্য গল্প। যে গাথা হাজার পৃষ্ঠায় শেষ করা যাবে না, কিন্তু একটি ছবি লহমায় বলে দেবে সবকিছু।

‘মনপুরা ৭০’ একক কোনো ঘটনার ছবি নয়, আদতে। বরং প্রকাশের একটি অবলম্বন। পৃথিবীর মানুষে মানুষে এত এত ভেদাভেদের ভেতর চিত্রকর্মকে সর্বজনীন ভাষা হিসেবে দেখেছেন তিনি। সে ভাষায় অনুবাদ করেছেন বাংলার মানুষ ও প্রকৃতি। যাকে বলছেন, পৃথিবীর ভাষা বা সবার ভাষা।

দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা দিয়ে জয়নুলের সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক পরিচয়। ঠিক এতটুকু তথ্যের ভেতর পূর্ব বাংলা ও এ অঞ্চলের মানুষের যে হদিস আমরা পাই; সাধারণ মানুষ সম্পর্কে বাংলার মধ্যবিত্ত শিল্পরুচি অনেকটাই সেদিকে আটকে আছে। যার সমালোচনাও আছে। কিন্তু ট্র্যাজেডি সে প্রকৃতি প্রদত্ত বা মানবিক সৃষ্ট যা-ই হোক; তার ভেতর মানুষকে নিবিড়ভাবে বোঝা যায়। সেখানে গিয়ে জয়নুলকে দেখতে হয়। ব্রহ্মপুত্র তীরের ছেলেটিকে। সমাজের সঙ্গে তার লিপ্ততা থেকে। তার নিজের জীবন, বেড়ে ওঠা ও পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিত্ব ফুটে ওঠে। মানুষকে শুধু আঁকা বিষয় করেননি, তার জীবনের সঙ্গীই করেছেন।

জয়নুলের ছবির বিষয়বস্তু নিয়ে সাইয়িদ আতীকুল্লাহ বলছিলেন, ‘তাঁর দৃষ্টিপথে যারা ঘুরে বেড়াতেন তারা হচ্ছেন সাধারণ মানুষ—মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বাঙালি। আবেদিন স্বভাবতই বিশেষভাবে ব্যস্ত ছিলেন বাংলাদেশের মানুষ নিয়ে; সেইসব মানুষ, যাদের ঘরবাড়ি উড়ে যায় ঝড়ে, খরা-অনাহার-দুর্ভিক্ষে যারা বিনষ্ট হয় লাখে লাখে, যারা মাটি কুপিয়ে রাস্তা বানায়, যারা মাঠে মাঠে ফসল ফলায়, যারা কাঁথায়-পাটিতে নকশা তোলে, হাঁড়ি বানায়, পুতুল বানায়, জাল দিয়ে মাছ ধরে নদীতে নদীতে, রোদে-ঝড়ে-বৃষ্টিতে। এক কথায়, যারা সমাজের একেবারে নিচুতলার বাসিন্দা এবং কোনো অবস্থাতেই জীবন যাদের প্রসন্নভাবে নেয় না সেইসব মানুষকে নিয়েই ছিল আবেদিনের ভাবনা-চিন্তা শিল্পকর্ম।’

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জয়নুল আবেদিনের তুলিতে রিয়ালিজমের কর্তৃত্ব দেখি। যেখানে আবহমান গ্রামীণ জীবনের নিবিড় চিত্র উঠে এসেছে। প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরি প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত নর-নারী স্পষ্ট। এ ধারণাগুলো জয়নুলের স্বচক্ষে পাওয়া, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা। মনপুরা ভ্রমণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মনপুরায় আমরা যখন থার্ড ডে-তে নামলাম। সি প্লেনে আমি আর আমার বন্ধু একা ঘুরতাছি সারাদিন। কয়টা লোক বাঁইচা আছে। দেখলাম। দৌড়ায় আসল। দেখলাম জখমওয়ালা। তারা কানতে আরম্ভ করল। আমরাও কানতে আরম্ভ করলাম। আপনারা বিশ্বাস করেন, আমার পেছনে...সমুদ্র...ঠিক সমুদ্র না, সমুদ্রের খাড়ি, যেখানে যান, খালি গরু-মানুষ শুইয়া রইছে।’

জয়নুলের এই বয়ান একদম সরল, যা দেখেছেন তা-ই বলেছেন। ছবিতেও তাই উঠে এসেছে। এটাই সেই স্বাতন্ত্র্য দৃষ্টিভঙ্গি; যা সেই ১৯৪০ থেকে ১৯৭০-এর দশকে এসেও সত্য। কলকাতায় যেমন দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষ স্মৃতি ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন, ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করতে চলে যান মনপুরায়। দুই দুর্যোগের ধরন আলাদা হলেও বিপন্নতা ও অসহায়ত্বকে এক সুতোয় বেঁধেছেন। এ প্রসঙ্গে রফিকুন নবী বলেন, ‘সত্তরের সাইক্লোন আর জলোচ্ছ্বাসের পর উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণকর্মীদের সঙ্গে সশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, ক্ষয়ক্ষতি, অসংখ্য মানুষের লাশের পাশাপাশি মৃত পশু-পাখি আর ধ্বংসলীলা দেখে মর্মাহত হয়ে ঠিক করেন, সেসব নিয়ে ছবি আঁকবেন। বিস্তৃত এলাকা জোড়া উপকূলের মানুষের দুর্গতিকে ছোট পরিসরে আঁকলে সম্পূর্ণতা পাবে না ভেবে তিনি আবার স্কোল আঁকার চিন্তা করেন এবং তা একসময় অতি দ্রুততায় এঁকেও ফেলেন। এই ছবি আঁকতে দেখে আমার মনে হয়েছিল, তাঁর মনটা আবার তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময়টিতে চলে গেছে যেন। সে সময়ের মানবিক চিন্তা আর অনুভূতিগুলো যেন ফিরে এসেছে। তাঁর আঁকার সাবলীলতা দেখে মনে হয়েছে, তখনকার উদ্দীপনাই যেন পুনরায় ধারণ করছেন। অভিভূত হয়ে দেখেছিলাম তাঁর আঁকা।’

সেই ভ্রমণে সঙ্গী ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের ফ্লাইং ক্লাবের সদস্য ক্যাপ্টেন সৈয়দ আলী আকবর রিজভী। তার জবানে উঠে এসেছে জয়নুল আবেদিনের মনপুরা পরিদর্শনের ঘটনা। তিনি বেশ কয়েকবার শিল্পাচার্যকে দ্বীপটিতে নিয়ে যান। জয়নুল আকাশ থেকে দেখে সন্তুষ্ট ছিলেন না, নিচে নেমে দেখতে চাইলেন। এভাবে দিনের প্রথম ফ্লাইটে চলে যেতেন, ফিরতেন শেষ ফ্লাইটে। সারা দিনে খেয়ে না খেয়ে ওই দ্বীপে কাটাতেন। আর ছবি আঁকতেন। ওই সময় স্কেচ করলেও তিন বছর পর আঁকেন স্কোলচিত্রটি। অর্থাৎ বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় নিয়ে বড় কাজের পরিকল্পনা করছিলেন ওই সময়ে। 

দ্বীপে তিনি যেভাবে চারপাশের লাশের স্তূপ দেখেছেন সেই অভিজ্ঞতা ক্যানভাসে উৎপাদন করতে চাইলেন। তার দর্শককে একই আবহের ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। এই উপলব্ধিতে দর্শককে নিয়ে যেতে চাইলেন। যেভাবে তিনি বলেছিলেন, ‘তারা কানতে আরম্ভ করল। আমরাও কানতে আরম্ভ করলাম।’

দিল্লির মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামে গোর্কি সিরিজের কিছু স্কেচ রয়েছে। আরো কিছু স্কেচ ও অন্যান্য কাজ বাংলাদেশে রয়েছে। মোম দিয়ে আউটলাইন করা ‘মনপুরা ৭০’ সম্পর্কে চিত্রশিল্পী নিসার হোসেনের ভাষ্য, একই ছবিতে পরিস্থিতির আলোকে ভিন্ন ব্রাশ ব্যবহার করেছেন জয়নুল আবেদিন। শুকিয়ে যাওয়া মরদেহের ক্ষেত্রে ‘অনেক ড্রাই, শুকনো ব্রাশ’ ব্যবহার করেছেন। আবার ফুলেফেঁপে-পচে-গলে যাওয়া মরদেহের ক্ষেত্রে চওড়া ব্রাশ বেছে নিয়েছেন। যেখানে কালি ও পানির পরিমাণ নিলেন বেশি। ‘লাইন অনেক লুজ’ ছিল। অর্থাৎ শুধু আবেগের বশবর্তী হয়ে ছবি এঁকেছেন এমন নয়। অনেক পরিকল্পনা ও সুচিন্তিত কাজ ছিল ‘মনপুরা ৭০’। 

নিসার হোসেন লিখেছেন, “মনপুরা ৭০’ শীর্ষক চিত্রটিও আড়ে-দীর্ঘ কাগজের ওপর আঁকা, কিন্তু এতে “‍নবান্ন”র মতো ঘটনা বা দৃশ্যের বর্ণনা যেমন নেই, তেমনি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের একটি আকস্মিক হৃদয়বিদারক ঘটনাকে ভিত্তি করে আঁকা হলেও তাকে “‍দুর্ভিক্ষ‍”র চিত্রের মতো একটি খণ্ডিত দৃশ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়নি। এখানে উপকূলীয় অঞ্চলে ঘটে যাওয়া স্মরণকালের ভয়াবহতম প্রাকৃতিক প্রলয়ের সার্বিক উপলব্ধিকে তিনি Panoramic view-তে এবং প্রমাণানুপাতে এতটাই দর্শক-সন্নিহিতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, যেন দর্শক নিজেও সেই বীভৎস পরিস্থিতি সরজমিনে হেঁটে পর্যবেক্ষণ করার কাছাকাছি একটা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন।’ 

কোনো লেআউট ছাড়াই কর্ণফুলী পেপার মিলের কাগজের ওপর মাত্র ৩ ঘণ্টায় এ ছবি এঁকেছেন বলে জানান ছেলে ময়নুল আবেদিন। বলেন, ওই সময় পীড়িত মানুষের অসহায়ত্বের সামনে অনেক সময় নিজের শার্ট খুলেও দিয়ে এসেছেন জয়নুল। সঙ্গে নিয়ে যেতেন কাপড়, দিয়াশলাই কাঠি। পরে করাচিতে শিল্প প্রদর্শনী করে দুর্গত মানুষের জন্য ৫ হাজার রুপি সংগ্রহ করেন তিনি। 

‘মনপুরা ৭০’-এ বাংলার আবহমান চিত্রধারার সঙ্গে মেক্সিকান ও চীনা শিল্পরীতির সংমিশ্রণ ঘটান জয়নুল আবেদিন। নিসার হোসেন বলেছেন, মেক্সিকো সফরে ঐতিহ্যবাহী দেয়ালচিত্র দেখে জয়নুল ভাবতে থাকেন বাংলার গণমানুষের চিত্র কী? পটচিত্র। তবে পটচিত্রে ভিন্ন ফ্রেমে একই কাহিনীকে প্রকাশ করা হলেও জয়নুল তার স্কোলচিত্রে একসঙ্গে পুরো ঘটনার বিভিন্ন দিক উন্মুক্ত করেন। যার অনুপ্রেরণা চীনা কম্পোজিশন। আমরা তাকালে যেভাবে দিগন্ত পর্যন্ত একটা দৃশ্য দেখতে পাই, জয়নুল তার ছবিতে সেই রীতি বেছে নেন। সে কারণে পাঁচ দশক পরও জাতীয় জাদুঘরের জয়নুল গ্যালারিতে এ ট্র্যাজেডির সঙ্গে আমরা একাত্ম হতে পারি। সহজে চিনতে পারি বাংলার মানুষকে; যারা অজস্র ভাঙনের মাঝে নিজেকে আবার তুলে ধরে। সব দুর্যোগের চেহারা একই নয়। এই ৫০ বছরে তা যেমন সত্য, আগামী হাজার বছরেও হয়তো সত্য। জয়নুল শুধু ছবি আঁকেননি, আমাদের ভবিষ্যৎ লিখে দিয়েছেন।

তথ্য ও মন্তব্য সূত্র: প্রদীপ ঘোষ পরিচালিত প্রামাণ্যচিত্র ‘মনপুরা ৭০, একটি ছবির গল্প’ ও বেঙ্গল পাবলিকেশনস লিমিটেড প্রকাশিত ‘জয়নুল আবেদিন জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি’।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন