নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার

ভূমি ও অর্থায়ন সংকট দূর করতে হবে

চলমান সংকট দূর করতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বিকল্প উৎস হিসেবে এ খাতে উপযুক্ত সহযোগিতা মিলছে না। যার ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভূমি, অর্থায়ন সংকট এবং বিশ্বব্যাপী সুদের হার বৃদ্ধি বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে বাধা তৈরি করছে। তবে এরই মধ্যে সোলার হোম সিস্টেম, মিনি গ্রিড এবং সৌর সেচ ব্যবস্থার মতো বিতরণকৃত নবায়নযোগ্য প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ সাফল্য পেয়েছে। তাই বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারলে এক্ষেত্রে সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপর দেশের প্রথম পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে এর কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮৮ সালের অক্টোবরে এ কেন্দ্রে ৫০ মেগাওয়াট কাপলান টাইপের টারবাইন সংবলিত চতুর্থ এবং পঞ্চম ইউনিট স্থাপন করা হয়, যাতে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ২৩০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সিলেটে প্রথম সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনে বেসরকারি উদ্যোগও ভূমিকা পালন করে। পরবর্তী সময়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) কর্তৃক সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) কর্মসূচি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ হয়। ১৯৯৬ সালে এসএইচএস চালু হওয়ার পর থেকে এটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচি। এ পর্যন্ত প্রায় ছয় মিলিয়ন সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকলের মাধ্যমে সরকার কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত কর্মসূচির কারণে এর সংখ্যা বাড়ছে। সোলার হোম সিস্টেম একটি বিশাল সিস্টেম। এর সফলতার জন্য গ্রামীণ ক্রেডিট এবং ‘কস্ট বাই ডাউন’ সিস্টেমের মাধ্যমে গ্রামীণ বাড়িগুলো এর আওতায় এসেছে।

এখন সামগ্রিকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারের সময় এসেছে। এজন্য জ্বালানি রূপান্তর টেকসই করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, স্মার্ট জ্বালানি সিস্টেম ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার যে অঙ্গীকার করেছে তার ওপর আমরা আস্থা রাখতে চাই। এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমির যে সংকট দেখা দিয়েছে, সেটি নিরসনে সরকারের আন্তরিক পদক্ষেপ দরকার। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে কাজে লাগাতেই হবে। এর কোনো বিকল্প এখন নেই। ভবিষ্যতে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ১০ শতাংশ হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রধান মাধ্যম হিসেবে সৌরশক্তি সর্বাধিক কাজে লাগানোকে গণ্য করা হয়েছিল। ২০২১ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের প্রচেষ্টা থাকলেও মূলত জমিস্বল্পতার কারণে তা সফল হয়নি। তবে লক্ষ্য অর্জনে কাজ চলছে। 

নবায়নযোগ্য জ্বালানির একটি বিশেষ দিক হচ্ছে এটি কখনো শেষ হবে না। মানে সেটা নবায়ন হতেই থাকবে। উদাহরণ হিসেবে সূর্যের কথা আসে, যতদিন পৃথিবী আছে সূর্য তাপ দিয়ে যাবে এবং সেখান থেকে সৌরশক্তি তৈরি করা যাবে। এছাড়া বায়ু ও সমুদ্রের ঢেউ থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করা যাবে। সমুদ্র যতদিন থাকবে, ততদিন সমুদ্র থেকে তরঙ্গ আসবে। আরো নতুন একটি ধারণা যেটি পৃথিবীতে খুব আলোচনা হচ্ছে, বাংলাদেশে এখনো সেটি খুব বেশি আলোচনায় আসেনি। সমুদ্রের পানিতে কেমিক্যাল, লবণসহ বিভিন্ন ধরনের সলিড আছে। এর ধরন থেকে বিদ্যুৎ তৈরির সুযোগ আছে। কিছু কিছু দেশ স্বল্প পরিসরে এটি করছে। এ ধরনের একটি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশেও চেষ্টা করা হচ্ছে। 

রিমোট এরিয়া অর্থাৎ উপকূলীয় জনগণের জন্য এটি একটি সম্ভাবনা। সেখানে এ প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো যাবে। এছাড়া পৃথিবীতে এখন যে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনকে যদি মোকাবেলা করতে হয় তাহলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতেই হবে। ইউরোপের অনেক দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভর করছে। অন্যান্য দেশও নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এগোচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির যেহেতু বড় সম্ভাবনা রয়েছে। সে হিসেবে এক্ষেত্রে বিনিয়োগ এখন লাভজনক হিসেবে গণ্য হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাদে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। আর বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে ৪ শতাংশের কম। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচলিত উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে—তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা। এই তিনটিই হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি। এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। তাই বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় পুরো বিশ্বেই এখন বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।

দেশে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিলেও এখনো তেমন সাফল্য আসেনি। বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের বাস্তবতায় বর্তমানে মূল অগ্রাধিকার সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো। এতে মূল চ্যালেঞ্জ হলো জমির স্বল্পতা, অন্যটি হলো পর্যাপ্ত সূর্যের আলো। দিনের বেলা সূর্যের তাপে সোলার থেকে বিদ্যুৎ পেলেও রাতের বেলা বিকল্প উৎস থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার বিষয়টি মাথায় নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।

জমিস্বল্পতায় অনাবাদি খাসজমি ও সরকারি-বেসরকারি ভবনের ছাদ এবং শিল্প-কারখানার ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সেচের অনেক পাম্পকে এরই মধ্যে সোলারের আওতায় আনা হয়েছে, বাকি সেচ পাম্পগুলোকেও সোলারে রূপান্তরের কাজ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও তা জমিস্বল্পতার কারণে অর্জন সম্ভব হয়নি। এজন্য অনাবাদি খাসজমি এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদের মাধ্যমে সমুদ্র ও নদীতীরের জমি ব্যবহার করা যেতে পারে।

এছাড়া শিল্প-কারখানায় যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে, রুফটপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ব্যবহার করলে তাতে খরচ অনেক কম হবে। তাছাড়া রুফটপ ব্যবহারের ফলে আলাদা করে জমির প্রয়োজনও হবে না।

এছাড়া লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন করতে গেলে প্রচুর জমির প্রয়োজন হবে। এজন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারের লক্ষ্যে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জমি পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। ব্যাংকগুলো সোলারের উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চায় না, এমন অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। পাশাপাশি সোলারের প্রসার বাড়াতে ইনভার্টারের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের যে দাবি ব্যবসায়ীরা করেছেন সেটিও বিবেচনা করা দরকার।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন