উনিশ শতকের ফরাসি তাসে মোগল নান্দনিকতা

বণিক বার্তা অনলাইন

ছবি: স্ক্রল ডট ইন

একটি সাধার তাসের আড্ডা যখন বক্স থেকে তাস বের করা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হবে লাল-সাদা রঙের একটি তাস বের হবে। চারকোণা তাসটিতে থাকবে ইউরোপীয় আভিজাত্যে রাজা, রানী  গোলামের মুখচ্ছবি। কিন্তু তার বদলে আপনি দেখলেন একদম ভিন্ন কিছু পুরুষের পরনে জামা, গয়নায় শোভিত নারীর পরনে কোলি ব্লাউজ, হাতে টিয়াপাখি। অনেকটা অ-উপমহাদেশীয় ধাচের এবং বলা যায় প্রাক-আধুনিক কালের চিত্রলেখার মতো সাবলীল। বোঝা যাচ্ছে যে আপনি তাকিয়ে আছেন বিরল এক সেট তাসের দিকে। এটি কার্টেস ইন্ডিয়ানিস নামে উনিশ শতকের এক ধরণের তাস।

তাসের চরিত্রগুলোর চিত্রায়ণে কার্টেস ইন্ডিয়ানিস দক্ষিণ এশীয় চিত্রশিল্পীদের অঙ্কিত মোগল ক্ষুদ্রচিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে চিত্রগুলোর রঙের আঁচড়সারাধরণত্ব  মসৃনতা আধুনিক অর্থাৎ উনিশ শতকের ইউরোপীয় চিত্ররীতির পরিচায়ক। এ তাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো ভারতীয় চিত্রকল্পের সাথে পাশ্চাত্যের উনিশ শতকের শেষের দিকের প্রভাবশালী শিল্পরীতির সঙ্গে এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ ফলাফল এক অসাধারণ নতুন শিল্প।  ক্যাথরিন পেরি হারগ্রেভ তার ‘‌এ হিস্ট্রি অব প্লেয়িং অ্যান্ড  বিব্লিওগ্রাফি অব কার্ডস অ্যান্ড গেমিং বইয়ে উনিশ শতকের শেষের দিকের ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ তাস উৎপাদনকারী কোম্পানীর তৈরী এই তাসকে ‘‌মৌলিক শিল্প প্রতিভার প্রতিফলন, অত্যন্ত সুন্দর, অসাধারণ নকশা, লিথোগ্রাফি এবং অনন্য রঙিন"বলে অভিহিত করেছেন। 

এই তাসগুলো সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ফরাসি জাতীয় গ্রন্থাগারের তথ্য অনুযায়ী ১৮৯০-১৯০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বি.পি গ্রিমড নামের একটি কোম্পানী এ কার্ডগুলোর উৎপাদন করে। ফরাসি জাতীয় গ্রন্থাগারে পাওয়া দুই সেট তাসের মধ্যে একটির মালিক হেনরী রেনে দ্য অ্যালেমাইন। তিনি একজন দলিল বিশারদ, ইতিহাসবিদ এবং ‘‌অ্যান্টিক প্লেয়িং কার্ডস; অ্যা পিক্টোরিয়াল হিস্ট্রি বইয়ের লেখক।

কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় হলো, কার্ডগুলোর গঠন এবং সেগুলোর উপর অঙ্কিত রাজা, রাণী ও গোলামের বেশভূষা বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন অঞ্চলকে নির্দেশ করে। রাজার ছবিগুলো বিভিন্ন আমলের মোগল রাজাদের প্রতিমূর্তিকে নির্দেশ করে এবং রানীর  ছবিগুলো মোগল আমলের কর্মশালায় অঙ্কিত নারীদের মডেল চিত্রের অবলম্বনে গঠিত।

ছবি: স্ক্রল ডট ইন

জনপ্রিয় এই ফরাসি তাসের নকশার পেছনে মোগল অনুপ্রেরণার কার কী?

প্রসঙ্গক্রমে, তাস খেলা ও তাসের নকশা নির্মাণের ইতিহাসে মোগলদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। রুডল লেইডেন তার সার্ভে  ‘‌গঞ্জিফা: প্লেয়িং কার্ডস অব ইন্ডিয়া’-তে এ নিয়ে কিছু তথ্য দিয়েছেন। প্রথম মোগল সম্রাট বার কর্তৃক ১৬ শতকে মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে গঞ্জিফা খেলার তাস আনার কথা বলেছেন তিনি। অ্যাডাম উইন্টালের মতে, আঠারো শতকের একজন ব্রিটিশ তাস-নির্মাতা ক্রিস্টোফার ব্লানচার্ড একটি ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রার করেন যেটার নাম ছিলো ‘‌দ্যা গ্রেট মোগল। উইন্টলের মতে সে সময় থেকেই মোগল ধারার তাসগুলো বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানী দ্বারা উৎপাদিত হতো। এ ধরারা মধ্যে ছিল কোর্ট মোগল, মোগলস, রিয়েন্টাল মোগলস, ডাবল মোগলস, ফ্লোরাল মোগলস এবং গ্রেট মোগলস ইত্যাদি।

এ ধারার তাসের আছে আরো কিছু বৈশিষ্ট্য। কার্টেস ইন্ডিয়ানিসে ব্যবহৃত নানা প্রতীকের পশ্চাপটগুলো উইলিয়াম মরিসের সমসাময়িক দেয়ালচিত্রের মতো মনে হয়। প্রতিটি তাসের কোণা জাপানি উড-ব্লক প্রিন্টের ভিত্তিতে নতুন সময়ে (নোভিউ) ব্যবহৃত ফুলের-মোটিফ দিয়ে অলংকৃত। তাসগুলোর উল্টোদিকে নির্দিষ্ট প্রতীকগুলো বৃত্তাকারে ফুল দ্বারা সুসজ্জিত যা প্রাচীন ইউরোপীয় কায়দায় নকশা করা। বি.পি. গ্রিমড সম্ভবত তার সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছিলো। যে বছর কার্ডগুলো তৈরি করা হয়েছিলো তার পুর্বের কয়েক বছরগুলোতে ফ্রান্সে নিয়মিত ভারতীয় শিল্পকলা প্রদর্শিত হয়েছিলো। জিগফ্রিড বিং এবং লুই গন্স নামক দুইজন এশীয় শিল্প সংগ্রাহক প্রচুর ভারতীয় ও পারসিক প্রতিকৃতি সংগ্রহে অবদান রেখেছেন গুলোর মধ্যে কোনো একটির আদলে হয়তো কার্টেস ইন্ডিয়ানিস তৈরি করা হয়েছিলো। ঠিক একই ভলিউমে সার্ভে “ল্য কস্তিউম হিস্টরিক” প্রকাশিত হয়। এটি ঐ সময়ের তাস-নির্মতাদের তথ্যের একটি সমৃদ্ধ উৎস।

সময়ের ভিত্তিতে নান্দনিকতার কথা চিন্তা করলে কার্টেস ইন্ডিয়ানিস ছিলো সময়ের যুগোপযোগী ফ্যাশন। নোভিউ শিল্পরীতির সঙ্গে ভারতীয় দরবারি প্রতিকৃতির অপূর্ব মেলবন্ধন মূলত পাশ্চাত্যের কল্পনায় ভারতের অবস্থানকে প্রকাশ করে। ১৯৮০ এর দশকের মাঝামাঝিতে ভেনিস-সিমন রিয়েন্টাল এক্সপ্রেস স্বল্প পরিবর্তন করে পুনরায় কার্টেস ইন্ডিয়ানিস প্রকাশ করে। ফরাসি সৌন্দর্যর যুগ ও অতিক্রান্ত ভারতীয় রাজকীয়তার উপর গুরুত্বারোপ মূলত পুরোনো দুনিয়ার আভিজাত্যের ইঙ্গিত বহন করে। সৌন্দর্যর যুগের প্রতি এই স্মৃতিবেদনা এক শতাব্দী পূর্বে শুরু হওয়া নতুন ধারার (নোভিউ) শিল্পের উদ্দীপনার শিখাকে আজো জ্বালিয়ে রেখেছে।   

সূত্র: স্ক্রল ডট ইন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন