
বৈশাখের বিষাদময় সন্ধ্যা। আকাশে মেঘ, উত্তরের
হাওয়া বইছে। কালবৈশাখীর আভাসে আকাশ যেমন নিজেকে সাজিয়েছে, তেমনিভাবে তিনদিনব্যাপী রবীন্দ্রজয়ন্তীর
বিশাল আয়োজনের সেই সন্ধ্যায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় নিজেকে সাজালো।
ছোট্ট ক্যাম্পাস। বিশালাকারের ব্যানারগুলো
ছেয়ে গেছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিতে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে
রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন উপভোগ করতে এসেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল। লম্বা লাইন
দেখে এগিয়ে গেলাম। শুনলাম, নর্থ সাউথের কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামে মঞ্চস্থ হবে কবিগুরুর
লেখা নাটক রক্তকরবী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা দলও নৃত্য পরিবেশন করবে,
কবিতা আবৃত্তি করবে।
মঞ্চনাটক, থিয়েটারের ব্যাপারগুলোতে নিজেকে
ধরে রাখা মুশকিল। বেশ উচ্ছ্বসিতই হলাম। টিকিট সংগ্রহ করে একদম সামনের সারির দিকে বসে
পড়লাম। দীর্ঘ সময় পর এমন মঞ্চনাটক। গায়ে কাঁটা দেবার মতো —লোভ মানুষকে এমন
একটি অবস্থানে নিয়ে যায়, যেখানে মানুষ এক পর্যায়ে নিজেকেও বিক্রি করে ফেলে। এক সময়
যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হয় লোভীর। সেই মৃত্যু দেহের নয়, হয় আত্মার।
নাটকে সে রকমই চরিত্র যক্ষপুরীর রাজার। মুহতাসিম
আন নাফি অভিনয় করছেন রাজার চরিত্রে। নাফির কণ্ঠের দৃঢ়তায় স্পষ্ট ফুটে উঠছে শোষণের চিত্র।
প্রজাশোষণের মাধ্যমে নিজের স্বার্থ হাসিল করাই তার ধর্ম। ধর্মকে পুঁজি করে মানুষকে
বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর চরিত্র গোঁসাই ওরফে রাহাত জামান। নাটকে লোভী রাজার কার্যক্রমে
একদিকে যেমন রাজ্যের সকল মনষ্যত্ব ও মানবতা পুড়ে ছাই হয়ে যায়; তেমনি অন্যদিকে দেখা
যায়, জীবনের সকল প্রেমের সৌন্দর্য দিয়ে সাজানো চরিত্র নন্দিনী। মৃত্যুও যে মানুষের
সবচেয়ে বড় অস্ত্র হতে পারে, রঞ্জন এবং নন্দিনী তারই প্রতিচ্ছবি।
মালতী, মল্লিকা, চামেলী —এতো ফুল থাকতে বিশ্বকবি
কেন নামকরণে রক্তকরবী ফুলকেই বেছে নিলেন, নাটকে তাই স্পষ্ট হয়েছে। রূপক অর্থের এই নাটকটিতে
বিশ্বকবি খুবই স্পষ্টভাবে পেশিশক্তি ও প্রেমের শক্তির পার্থক্য ফুটিয়ে তুলেছেন। রেললাইনের
মাঝে অসংখ্য উত্তপ্ত পাথরের মাঝে চাপা পড়ে থাকা ফুলগাছটির বেঁচে থাকা জানান দেয় রক্তকরবী।
এ শহরের মানুষেরাও আজকাল ইট-পাথরের দেয়ালের
মতোই আচরণ করে। দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন স্বরে কথা বলে। মানুষ বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধারের
পরিবর্তে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষের মতোই সীমাহীন চাওয়া-পাওয়ার
ফলাফল দেখা যায় রক্তকরবীতে।
এক সময়ে এ দেশে প্রচুর মঞ্চনাটক হতো। এখন
হয় না। গ্রামে গ্রামে, শহরের বাজারে সারিগান-জারিগানের আসর বসত। পথনাটক হতো, সামাজিক
বিষয়ক যাত্রাপালা হতো, শিক্ষনীয় থিয়েটার হতো। এখন তেমন কিছুই নেই। আধুনিকতার এক ছোঁয়ায়
এ সবই হয়ে গেলো অযথা সময় ব্যয় করার মতো। উঁচু উঁচু দালানে বড় বড় সব করপোরেট অফিসের
ছায়ায় এসবের অধিকাংশই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
যে কিঞ্চিৎ অংশটুকু বেঁচে আছে —তার পেছনে রয়েছে
সত্যিকারের সাংস্কৃতিক মানুষ। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাব
সেই কিঞ্চিৎ অংশকে একটু একটু করে বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টায় গত কয়েক বছর ধরে মঞ্চনাটকে
নিজেদের আভিজাত্য দেখিয়ে আসছে। এই যেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ভাবা যাক। কাঁটাতারের
সীমানা সংস্কৃতিকে বাঁধতে পারেনি। রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন দুই বাংলাকে একই আসনে বসিয়েছে।
সংস্কৃতির মূল শিক্ষা এখানেই। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, সাহিত্যের কোনো সীমানা হয় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখা অসংখ্য কবিতায়, গানে একদিকে যান্ত্রিকতার তিক্ত কোলাহল এবং অন্যদিকে জীবনের সজীবতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। রক্তকরবী তারই অংশ। জীবনধর্মের সজীবতার মতো স্নিগ্ধ এই পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। অথচ কী যেন একটা অদৃশ্য চাওয়া-পাওয়া আমাদেরকে ঘিরে রেখেছে। আমরা ছুটছি, ছুটছি আর ছুটছি। কেন ছুটছি জানি না। তবে কিছু একটার জন্য। এভাবে একদিন হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়াতে হয় আমাদের। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় হাপিয়ে উঠি। থেমে যাওয়া পথের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে মৃত্যু। বৈশাখের কালো মেঘের মতো। যে মেঘ কখনো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে না ।
লেখক: শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।