রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মে নারী

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকর্ম, সংগ্রহ: মুহাম্মদ আজিজ খান, চেয়ারম্যান, সামিট গ্রুপ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের শেষ ছবি এঁকেছিলেন ১৯৪১ সালের ১৫ জুন (১ আষাঢ় ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)। সেটি ছিল প্যাস্টেলে আঁকা একটি গাছ: গাছের সম্মুখে একজন মানুষ। কিন্তু জীবনের প্রথম ছবিটি কবে এঁকেছিলেন বা কী এঁকেছিলেন—তা নিশ্চিত জানা নেই। 

যৌবনের শুরুতেই তার চিত্রাঙ্কনের আগ্রহ ও প্রচেষ্টা ছিল। এ প্রসঙ্গে ‘জীবনস্মৃতি’-তে লিখেছেন: ‘মনে পড়ে, দুপুরবেলায় জাজিম-বিছানো কোণের ঘরে একটা ছবি আঁকার খাতা লইয়া ছবি আঁকিতেছি। সে-যে চিত্রকলার কঠোর সাধনা তাহা নহে, সে কেবল ছবি আঁকার ইচ্ছাটাকে লইয়া আপন-মনে খেলা করা। যেটুকু মনের মধ্যে থাকিয়া গেল, কিছুমাত্র আঁকা গেল না, সেইটুকুই ছিল তাহার প্রধান অংশ।’ যা আঁকতে চেয়েছিলেন তা তিনি রেখায় রেখায় ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হননি। চিত্রাঙ্কন বিদ্যা তার অধিগত ছিল না।

এই আঁকিবুঁকির খেলা জীবনে শেষ অধ্যায়ে সাধনায় পরিণত হয়েছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘ছবি আমার শেষ বয়সের প্রিয়া।’ আমরা স্মরণ করতে পারি ১৯০৯ সালে এপ্রিল মাসের এক দুপুরবেলা শিল্পী মুকুল দে-কে ডেকে রবীন্দ্রনাথ দেরাজ খুলে মোটা চামড়া বাঁধাই কালো খাতা বের করে দেখতে দিয়েছিলেন। তাতে ছিল বেশ কিছু ‘হেড ও ফিগার স্টাডি’ ও আলংকারিক নকশা। আমাদের সংগত অনুমান এই যে এ সময় তিনি গুরুত্বের সঙ্গে ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন। তবে বিভিন্ন ছবির তারিখ দেখে অনুমিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘এখন থেকে ছবি আঁকব’ এহেন কোনো প্রতিজ্ঞা নিয়ে ছবি আঁকা শুরু করেন ১৯২৪ সালে। তখন তার বয়স ৬৩। তার চিত্রকর্মের প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল প্যারিসে, ১৯৩০ সালে। পরে বার্মিংহাম, লন্ডন, বার্লিন, মিউনিখ, কোপেনহেগেন, জেনেভা, মস্কো, বোস্টন, নিউইয়র্ক এবং সর্বশেষে ১৯৩১ সালের মে মাসে ফিলাডেলফিয়ায় প্রদর্শনী হয়। ভারতে প্রথম প্রদর্শনী হয় ১৯৩২-এ, কলকাতায়। 

১৮ আগস্ট ১৯৩০ প্রতিমা দেবীকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “এখানকার (প্যারিসের) ন্যাশনাল গ্যালারিতে আমার পাঁচখানা ছবি নিয়েছে....তারা পৌঁছেছে ছবির অমরাবতীতে। ....আমি যে ‘পোটো’ সেই নামটাই ছড়িয়ে পড়ছে ‘কবি’ নামকে ছাপিয়ে।” [সূত্র: চিঠিপত্র ৩, বিশ্বভারতী, ১৩৪৯, পৃ. ৮২-৮৩] তবে বাস্তবতা তো এই যে আজও, প্রায় একশত বছর হতে চলল, রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রকর’ পরিচয়টি বাঙালির কাছে মুখ্য কোনো পরিচয় হয়ে ওঠেনি। নানা পরিচয়ের সমন্বয়ে যে বিশাল, বিপুল রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি আমাদের মনে ভেসে ওঠে তার মধ্য থেকে ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’ যেন অনাভাসিত। 

শিবনারায়ণ রায় যখন বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন তখন তিনি নিবিড়ভাবে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মগুলো দেখেছিলেন। প্রায় ষোলশ ছবির একটি তালিকা (ক্যাটালগ) তিনি প্রণয়ন করেছিলেন। এখন কলকাতায় বা শান্তিনিকেতনে গেলে রবীন্দ্রনাথের আঁকা মূল ছবি দেখার উপায় নেই। সবই অন্তরালে সুসংরক্ষিত। গুলশানে রাজীব সামদানীর বাসায় গোটা পাঁচেক মূল ছবি দেখার সৌভাগ্য হলেও সেই ১৯৮৫ থেকে ডানলপ টায়ারের পাঁচটি পোস্টার দিয়ে শুরু করে অদ্যাবধি কেবল রিপ্রডাকশন দেখে আসছি। রবীন্দ্রনাথ-অঙ্কিত ছবির সংখ্যা প্রায় দুই হাজার তিনশ। এর মধ্যে কয়েকশ ছবি দেখার সুযোগ পাওয়া যায় নানা পত্রপত্রিকার পাতায় ও বিভিন্ন গ্রন্থে দুই মলাটের ভেতর। 

রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলোকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা চলে। প্রথমত, পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটির মধ্য দিয়ে রূপ ফুটিয়ে তোলার ছবি। দ্বিতীয়ত, অদ্ভুত কাল্পনিক প্রাণীর ছবি। তৃতীয়ত, ফুল ও গাছের ছবি। চতুর্থত, নিসর্গ দৃশ্য। পঞ্চমত, মুখমণ্ডল বা মুখাবয়বের ছবি এবং ষষ্ঠত, নকশা। এর বাইরেও ছবি আছে যেমন নৃত্যরত নারীর ছবি বা নগ্ন নারীর প্রতিকৃতি। কিন্তু অধিকাংশ ছবি উল্লেখিত পাঁচটির যেকোনো একটি ভাগে পড়ে যায়।

ছবির বিষয় নির্বাচন প্রসঙ্গে আরো বলা যেতে পারে, মুখাবয়ব বা মুখমণ্ডল আঁকার প্রতি তার বিশেষ পক্ষপাত ছিল। যতই সময় গিয়েছে এ পক্ষপাত ততই বেড়েছে। মুখাবয়বের ছবির মধ্যে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিকৃতি। এছাড়া মুখোশের ছবিও তিনি এঁকেছেন। 

১৯৩৫-৩৬ থেকে তার ছবিতে মানুষের রূপই ক্রমেই প্রাধান্য পায়। পুরুষের মুখাবয়ব যেমন এঁকেছেন, নারীর মুখাবয়বও এঁকেছেন। তুলনামূলকভাবে নারীর মুখাবয়বই বেশি এঁকেছেন। সব মিলিয়ে নারীর মুখাবয়ব সংখ্যায় চার-পাঁচশ হবে। বিচিত্র সব মুখাবয়বে গাম্ভীর্য, নিস্পৃহতা, প্রশান্তি, ভয়, বিষণ্নতা, ক্রোধ ইত্যাদি নানা অভিব্যক্তি অবধৃত হয়েছে।  

১৯৩৯ সালে অনেক নারীমূর্তি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। কিছু স্কেচ করেছেন কলমে বা পেন্সিলে। চিত্রশিল্পী মুকুল চন্দ্র দে বলেছেন (১৯৩২), ‘মানুষের প্রতিকৃতি তিনি যা এঁকেছেন, সবই জীবনের ছন্দে ভরপুর।’ কিন্তু অনেকের কাছে মনে হয়েছে এসব যেন আদিম গুহাবাসী মানুষের চিত্রাবলি। 

অধিকাংশ ছবিতে তারিখ-স্বাক্ষর দেননি রবীন্দ্রনাথ। তবে ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৪০ তারিখে আঁকা নারী মুখাবয়বের ড্রয়িংয়ে তারিখ রয়েছে। প্রশস্ত সাদা জমিনে ডিম্বাকৃতি রমণীয় মুখাবয়ব। চোখ কোমল অথচ দৃষ্টি রহস্যময়। মনে হয় চিত্রাঙ্কনবিদ্যা আয়ত্তে না-থাকলেও রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে তার চিত্রকলায় পারদর্শিতা অর্জন করে উঠেছিলেন। লক্ষ করা যায় তার আঁকা নারী মুখাবয়ব সাধারণত কিছুটা লম্বাটে। 

তবে চিত্রাঙ্কনবিদ্যা অনায়ত্ত হলেও ১৯৩৫-এর ১৪ অক্টোবর আঁকা পত্র পাঠরতা রমণী ছবিটিতে যে পরিপক্বতা রয়েছে তা দৃষ্টি এড়ানোর মতো নয়। শতাধিক ছবি পর্যালোচনা করে আমাদের কাছেও মনে হয়েছে কবির আঁকা প্রতিটি রমণী প্রতিকৃতির মুখচ্ছবিগুলো ব্যঞ্জনাময়ী। এই ব্যঞ্জনার বিবিধ রূপও দৃষ্টি এড়ানোর মতো নয়। একই পটে দুই রমণীর মুখাবয়বের ছবিটির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। তার প্রশিক্ষণহীন হাতেও কলমের টানে ফুটেছে ঔদাসীন্য, কুণ্ঠা, কৌতূহল বিবিধ অভিব্যক্তি। কখনো ফুটিয়ে তুলেছেন এক চিলতে হাসি বা ভ্রুকুটি।

তবে অনেক ক্ষেত্রে কেবল কনট্যুর আছে, মুখাবয়ব ফাঁকা। এ প্রসঙ্গে আয়না হাতে রমণী ছবিটির কথা অনেকের মনে পড়বে। কিংবা ১৯২৯-এর ১৫ মার্চ অঙ্কিত এবং স্বাক্ষরিত বেঞ্চে উপবিষ্ট নারীর কথা। আরেকটি বিষয় হলো অনেক ছবিতে মাথায় ঘোমটা টানা। কেউ কেউ বলেছেন, ঠাকুরবাড়ির অবগুণ্ঠিত নারীদের প্রতিচ্ছবি এসব ছবি। বলেছেন, এসব উৎসারিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের অবচেতনার গভীর থেকে। 

কলমে আঁকা স্কেচগুলো পর্যালোচনা করে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ নারীর চোখ ও দৃষ্টির গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্যক অবহিত ছিলেন। কোনো স্কেচে ফুটে উঠেছে ভয়ার্ত দৃষ্টি। আবার কোনো স্কেচে ফুটে উঠেছে ভর্ৎসনা। রবীন্দ্রনাথের নিজের চোখে যে তীব্রতা ছিল তার আঁকা নারীচিত্রের দৃষ্টিতে সে রকম তীব্রতা প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়।

‘অকল্পিত’ ছবির চিত্র এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি কোনো বিষয় ভেবে আঁকিনি—দৈবক্রমে একটা অজ্ঞাতকুলশীল চেহারা চলতি কলমের মুখে খাড়া হয়ে ওঠে।’ 

শিবনারায়ণ রায় বলেছেন, ‘গোড়ার দিকে প্রাকপৌরাণিক কিম্ভূতের, মগ্নচৈতনিক বিক্ষোভের প্রাবল্য যতটা ব্যাপক, পরের দিকে সে তুলনায় কলম, তুলি, খড়ি বা পেন্সিলের নিপুণতর প্রয়োগে নিসর্গচিত্র এবং মুখাকৃতি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।

সাদৃশ্য আনবার চেষ্টা করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছেন; কিন্তু এই সচেতন প্রয়াস লক্ষণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তুত এ প্রয়াসের শেষ থেকে তিরিশের মধ্য এবং শেষভাগের বেশকিছু ছবি জন্ম নিয়েছে, যেগুলোতে দৃঢ় মুখাকৃতি ও স্থির ল্যান্ডস্কেপের রঙ ও রেখাঙ্কন অবচৈতনিক প্রাণশক্তির প্রক্ষোভে রহস্যময় ও বেগবান।’ [সূত্র: ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ১১০-১২৪]

তিনি আরো বলেছেন, এসব ‘রঙ-এর প্রলেপহীন বিশুদ্ধ রেখায় টানা মুখ, আবার কলম এবং মোটা তুলিতে আঁকা মুখ—যৌবনবতীরা কেউ বিষণ্ন, কেউ উদাস, কেউ আর্ত, আবার কারোবা চোখেমুখে ব্যঙ্গমিশ্রিত কৌতুকের আভাস।’ [সূত্র: শিবনারায়ণ রায়: ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ১১০-১২৪]  

ছবি রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ বয়সের প্রিয়া’। জীবন-সায়াহ্নে তিনি নিজেকে ছবির হাতে প্রায় নিঃশেষে সঁপে দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন? এ প্রশ্ন সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। ‘রবিকার চিত্রকর্ম’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ প্রশ্নের জবাব দিলেন এই বলে, “অতি গভীর অন্তরের উষ্মা ও তাপে এই রঙ-রূপ সমস্তই যেন প্রকৃতির খেলাঘরে লুকানো হঠাৎ আবিষ্কারের আনন্দ দিয়ে নির্মিত, ফেটে বেরিয়েছে, রূপ পেয়েছে।... এত রঙ, এত রেখা, এত ভাব সঞ্চিত ছিল অন্তরের গুহায় যা সাহিত্যে কুলালো না, গানে হলো না—শেষে ছবিতেও ফুটে বের হ’তে হলো...।” 

এ কথাই খানিকটা অন্যভাবে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, “...রবীন্দ্রনাথকে বৃদ্ধ বয়সে ছবি আঁকতে হলো তা’ এ-জন্যেই। তাঁর সত্তার যে অংশটিকে তাঁর অতিপ্রজ লেখনী সম্পূর্ণ উদ্ঘাটন করতে পারেনি, তার জন্যে একটা নির্গমপথ সায়াহ্নকালে তিনি নির্মাণ ক’রে নিলেন।”

সন্দেহ নেই, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম অন্তর্লীন অনুপ্রেরণারই ফল। অনন্ত সুন্দরের অর্থাৎ সৌষাম্য ও মসৃণতার কবি রবীন্দ্রনাথের ছবিতে কেন ভিড় করে আসে কড়া বা খাড়া লাইনের রচনা, কেন খোঁচাওয়ালা, কোণওয়ালা, কাঁটার মতো, অদ্ভুত ও বিকৃত মুখের মেলা বসে গেছে—এসব প্রশ্ন উঠতেই পারে। তাই বলে যে বিষণ্ন একটি মুখ তিনি এঁকেছিলেন তা তার নতুন বৌঠানের বা ভূতুড়ে মুখগুলো রান্নাঘরের পাচকদের বা মলিন ভাবলেশহীন মুখগুলো সেই পরিচারিকাদের যারা তার বাড়ির পেছন দিককার উঠোনে কাজ করত—এ ধরনের বিশ্লেষণ যতই আবেদনপূর্ণ হোক না কেন, সহসা মেনে নেয়া যায় না। আরো দেখবার ও বুঝবার আছে; আরো মিলিয়ে দেখবার অবকাশ আছে।

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী: কথাসাহিত্যিক ও গবেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন