অ্যামাজন রক্ষা করতে পারবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?

বণিক বার্তা অনলাইন

কালচার ট্রিপের ছবি।
অ্যামাজনের গবেষক ও বিজ্ঞানীরা এমন একটি কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্ল্যাটফর্ম বানিয়েছেন, যেটি আগে থেকেই বুঝতে পারে, পরবর্তী বন উজাড়ের কার্যক্রম কোথায় ঘটতে যাচ্ছে। প্রিভিস আইএ নামের এই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্ল্যাটফর্ম আসলেই অ্যামাজনের সুরক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা— এমনটাই এখন পরিবেশ প্রেমীদের কৌতূহলের কেন্দ্রে। 

দ্য গার্ডিয়ানের খবর বলছে, পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, যেখানে উজাড় হওয়া বন পুনরুদ্ধারের চেয়ে বন উজাড় বন্ধ করাটাই বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত যন্ত্রটির হিসেবে অ্যামাজনে আসন্ন সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে ত্রিয়ানফো ডো জিংগু এলাকা। ২৭১ বর্গ কিলোমিটার এলাকার বনাঞ্চলটি চলতি বছর শেষ হওয়ার আগেই উজাড় হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত মার্চের মধ্যেই এর ৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা রীতিমতো উজাড় হয়ে গিয়েছে। এই এলাকার বিশেষ প্রজাতির সাদা গালের মাকড়সা, বানর, হাইসিন্থ ম্যাকাও এবং জাগুয়ার এরই মধ্যে উদ্বাস্তু হয়ে বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই বিশেষ প্রজাতিগুলো বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যায় না। 

নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তির হিসেবে, ত্রিয়ানফো ডো জিংগুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দুটি এলাকা হলো— আলতামিরা এবং সাও ফেলিক্স ডো জিঙ্গু। এই দুই এলাকায় বন উজাড়ের হার সর্বোচ্চ। ব্রাজিল সরকার এলাকাগুলোকে সংরক্ষিত ঘোষণা করলেও খনি খননসহ বিভিন্ন কারণে ভূমি দখল এখানকার বনাঞ্চলকে ঝুঁকিতে ফেলছে। 

তবে এমন আশঙ্কার মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে প্রিভিস আইএ। প্ল্যাটফর্মটির উদ্ভাবক গবেষকরা এখন সরকারের সঙ্গে এক হয়ে অ্যামাজন সুরক্ষার উদ্যোগ নিচ্ছে। তারা বলছে, যে এলাকাগুলো ধ্বংসের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেগুলোর সুরক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। 

এদিকে দ্য গার্ডিয়ান আরো জানায়, অ্যামাজন উজাড়ের মাত্রা এখন সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গিয়েছে। অ্যামাজন সুরক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের হিসাবে, গত বছরের মার্চের তুলনায় এ বছরের মার্চে বন উজাড়ের মাত্রা বেড়েছে অন্তত তিনগুণ। ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে ৮৬৭ একর রেইনফরেস্ট ধ্বংস হয়েছে। এই পরিমাণ গত ১৬ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। 

প্রিভিস আইএর ধারণাটি প্রথম আসে ২০১৬ সালে, যখন অ্যামাজনের বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইটের ছবি দেখে অ্যামাজন নিয়ে গবেষণা করছিলেন। অল্প সময়ে প্রচুর বনাঞ্চল সাফ হয়ে যাওয়ায় বিজ্ঞানীরা চিন্তিত হয়ে পড়েন। ক্রমাগত বনভূমি ধ্বংসের খবরে ক্লান্ত হয়ে তাদের মাথায় চিন্তা আসে, বন উজাড়ের কোনো স্বল্পমেয়াদি পূর্বাভাস মডেল তৈরি করা সম্ভব কিনা। 

অ্যামাজনের সিনিয়র গবেষক এবং প্রিভিস আইএ প্রকল্পের সমন্বয়ক কার্লোস সুজা জুনিয়র বলেন, এর আগে বন উজাড়ের যেসব পূর্বাভাস ব্যবস্থা ছিল, সেগুলো ছিল খুবই দীর্ঘমেয়াদি। এগুলো এক দশকের পূর্বাভাস করতে পারত। আমাদের প্রয়োজন ছিল দ্রুত পূর্বাভাস দিতে পারে, এমন কোনো প্রযুক্তি, যেটি বনাঞ্চল ধ্বংসের চেয়ে দ্রুত আমাদের তার তথ্য দিতে পারে। 

এই ভাবনার পরই একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী এবং আকেজন ভূ-পরিসংখ্যান বিশেষজ্ঞকে নিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তিটি উদ্ভাবন করেন তারা। পরে ২০১৭ সালের আগস্টে স্থানীয় একটি জার্নালে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়। 

প্রযুক্তিটি দুইভাবে কাজ করে। প্রথমত, এটি সরকারি তথ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে বনাঞ্চল ধ্বংসের সাধারণ প্রবৃত্তি নির্ধারণ করে। এর মাধ্যমে প্রিভিস আইএ বুঝতে পারে, কোন এলাকায় কী ধরনের গোষ্ঠীর উপস্থিতি রয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য কী এবং এর ফলে নিকটবর্তী বনাঞ্চল ধ্বংসের সম্ভাবনা কতটুকু। 

দ্বিতীয়ত, এটি বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোকেও বিবেচনায় রাখে। যারা বন উজাড়ের ক্ষেত্রে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। কিছু আদিবাসী বন উজাড় করে না। আবার কিছু কিছু আদিবাসী বন উজাড় করে থাকে, বিশেষ করে যাদের জনসংখ্যা বেশি। এছাড়াও আরো কিছু ফ্যাক্টরকে বিবেচনায় রেখেই মূলত প্রযুক্তিটি পূর্বাভাস দেয়। 

গবেষকরা বলছেন, বনের মধ্যে যেসব এলাকায় রাস্তা রয়েছে তার আশপাশের ৫ কিলোমিটারে বন উজাড়ের সম্ভাবনা অন্তত ৯০ গুণ বেশি। বনে দাবানলের ৯০ শতাংশও ঘটে রাস্তাগুলোর সাড়ে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে। এছাড়া যেসব এলাকায় গাছপালার ঘণত্ব বেশি এবং কাষ্ঠল গাছের সংখ্যা বেশি ওইসব এলাকায়ও বন উজাড়ের হার বেশি।

অ্যামাজনের বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইটের হাজার হাজার ছবি বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করেন, কোন কোন এলাকায় রাস্তা রয়েছে, এবং এর আশপাশে বন উজাড়ের সম্ভাবনা কেমন। তবে এখন প্রিভিস আইএর মাধ্যমে স্যাটেলাইটের ছবি বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অল্প সময়েই এ বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। 

প্রযুক্তিটির উদ্ভাবকরা বলছেন, এর নির্ভুলতা এখন পর্যন্ত চমকে দেয়ার মতো। এ পর্যন্ত প্রিভিস আইএ যেসব এলাকা চিহ্নিত করেছে, তার ৮৫ শতাংশই প্রায় নির্ভুল। প্রযুক্তির চিহ্নিত করা এলাকার চার কিলোমিটারের মধ্যেই বন উজাড়ের ঘটনাগুলো ঘটেছে।

গবেষক দলের প্রধান কার্লোস সুজা জুনিয়র বলছেন, আমরা চাই এমন একটা সময় আসুক, যখন আমাদের প্রযুক্তি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করবে ঠিকই কিন্তু ওই এলাকার বনভূমি উজাড় হবে না। আর এটাকেই আমরা অ্যামাজন রক্ষায় আমাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সফলতা বলে ধরে নেব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন