ভিঞ্চির নিখুঁত দুনিয়া

ওয়াহিদ সুজন

লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা সেলফ পোর্ট্রেটছবি: লিওনার্দোদা-ভিঞ্চি.ওআরজি

মানবমন কীভাবে পরিপূর্ণ হয়? লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির পরামর্শের একটা হলো শিল্পের বিজ্ঞান বা সায়েন্স অব আর্ট অধ্যয়ন করুন।তাহলে দুনিয়ার কায়কারবার বুঝতে পারবেন, যেখান সবকিছুই পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। এ দর্শন বোঝাপড়াকে সামগ্রিকভাবে দেখে, অনুসন্ধান করে নিখুঁত বিশ্বের। এ অধ্যয়ন বা পাঠ বেশ প্রয়োগিক অর্থে ব্যবহার করেছেন লিওনার্দো- তার জীবন ও কর্ম পর্যবেক্ষণ করলে আমরা তা সাদা চোখে বলতে পারি। তবে চিত্রশিল্পী হওয়ায় এটাও ভাবার কারণ নেই, স্রেফ প্রতিলিপির দুনিয়ার মধ্যে আটকে থাকার কথা বলছেন মহান এ শিল্পী। 

বিবাহবহির্ভূত মায়ের সন্তান, একসময় মাকে ছেড়ে বাবার পরিবারে বেড়ে ওঠা। যার কাছে মায়ের কোনো স্মৃতি প্রায় নেই-ই, যদিও তিনি এঁকেছিলেন বাইবেলের পবিত্র নারী ও সমকালের অভিজাত নারীদের অবয়ব। মনে হতে পারে, অপ্রাপ্তি থেকে জীবনকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে গেছেন এভাবে। এও ধারণা করা হয়, মায়ের দিক থেকে বহন করছিলেন অপশ্চিমা জিন। মোটের ওপর জীবনের বৈচিত্র্য অভিজ্ঞতা তাকে নিখুঁত হতে শিখিয়েছে। 

২০১৯ সালে তার প্রয়াণের ৫০০ বছর স্মরণে ইউরোপজুড়ে ব্যাপক আয়োজন করা হয়। এ শিল্পীর জন্ম ১৪৫২ সালের ১৫ এপ্রিল। ১৫১৯ সালের ২ মে ৬৭ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নশ্বর জীবনে তার সফর থেকে ভাবতে হয়, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আসলে কী ছিলেন না! সাদামাটাভাবে বললে, চিত্রশিল্পী, প্রকৌশলী, স্থপতি ও উদ্ভাবক। সঙ্গে যোগ করুন বিজ্ঞানী, ভাস্কর, সংগীতজ্ঞ ও সাহিত্যিক। আরো অনেক কিছু। অবশ্যই সব ধরনের বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ শিক্ষার্থী। তার প্রতিভা এত বেশি শাস্ত্রকে অতিক্রম করেছিল, সমকালের সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ ‘রেনেসাঁর মানুষ’ ছিল যথাযথ প্রয়োগ। পলিম্যাথের যথাযথ উদাহরণ। 

‘মোনালিসা’ ও ‘দ্য লাস্ট সাপার’ চিত্রকর্ম দুটির জন্য সর্বাধিক পরিচিত তিনি। হাতে গোনা আরো কয়েকটি চিত্রকর্ম পাওয়া যায়। আর অবশ্য ড্যান ব্রাউনের থ্রিলার ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’, যাকে সরিয়ে আলোচনা করতে হয়; তাই তথ্যটুকু দেয়া।

এত এত পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও আপনি জেনে থাকবেন লিওনার্দো ছিলেন স্বশিক্ষিত। শিক্ষানবিশ হিসেবে আঁকাআঁকির খানিক তালিম নিয়েছিলেন বটে। তবে তার প্রতিভা ও আগ্রহের অনেকটাই জীবদ্দশায় অনালোচিত ছিল। উদ্ভাবন, পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্ব লিপিবদ্ধ ছিল কয়েক ডজন নোটবুকে। যেখানে বাদুড়ের শারীরবৃত্তীয় রহস্য ও ওড়ার ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে বাইসাইকেল, হেলিকপ্টার বা আস্ত বিমানের নকশা পাওয়া যায়।

পরিমাণ ও পরিমাপের প্রতি তার ঝোঁক ছিল বরাবর। রেনেসাঁ যুগের চিত্রকর্ম মূলত ফিগারেটিভ। ধর্মীয় কাহিনী বা অভিজাতদের প্রতিকৃতিই আজকাল নিদর্শন হিসেবে নজরে আসে। লিওনার্দো যে অল্প কয়েকটি কাজ টিকে আছে, সেখানে অভিব্যক্তি ও আলো-ছায়ার নিখুঁত বিন্যাসের মাঝে বাস্তবতার প্রয়োগ দেখি। সেই উদ্ভাবনী কৌশল, যার মূলে আছে শারীরবৃত্তীয় সংস্থান সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান ও অনুসন্ধিৎসা। ফিগারেটিভ কম্পোজিশনের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী দক্ষতার ব্যবহার; বিশেষ করে দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠে ত্রিমাত্রিক জগতের প্রতিস্থাপনের চ্যালেঞ্জ সফলভাবে সামলেছেন।

নিখুঁত মানে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ, যা বাস্তবতার চেয়ে বাস্তবকে রূপ দেয়া বিশেষ ছাঁচ। লিওনার্দো ফিগারের ভারসাম্যের সঙ্গে অন্যান্য সংস্থানে ছিলেন কৌশলী। রঙ ও তার নানা পরত ধীরে ধীরে মিশিয়ে দেন ছায়ায়। তুলির আঁচড় স্পষ্ট নয়, কিন্তু অভিঘাত সরস। অর্থাৎ ভারসাম্য শুধু দৃশ্যের মাঝে জ্যামিতিক মাপজোঁক নয়। মানুষকে একহারাভাবে চিহ্নিত না করে তার সমগ্র জটিলকে তুলে ধরাও।

‘মোনালিসা’ অভিব্যক্তির জন্য বিখ্যাত। এ প্রতিকৃতির আকার দেখলে যে কেউ হতাশ হবেন। কিন্তু ওই অধরা হাসির ভেতর রেখে দিয়েছেন চিরকালীন রহস্য। মোনালিসার চোখের কোণে যা সূক্ষ্মভাবে ঝুলে আছে আরো সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যার অধীন হওয়ার জন্য। আর ব্যাখ্যামাত্রই মানুষে-মানুষে, সমাজে-সমাজে বা কালে-কালে আলাদা। একদম বাহুল্যহীন এ ছবিতে দর্শকই শুধু মোনালিসাকে দেখে না, তার রহস্যময় চোখ দর্শককে দেখছে। যার মাধ্যমে ভাবিকালের দর্শকদেরও দেখছেন লিওনার্দো।

‘দ্য লাস্ট সাপার’। বিষয় ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে শেষ ভোজে যিশু ও ১২ শিষ্য। যেখানে মসিহা ঘোষণা করেছিলেন, ভোজে উপস্থিত একজন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। এ ছবিতে খ্রিস্ট ঐতিহ্যকে নতুন রূপ দেন লিওনার্দো। এর আগে লাস্ট সাপারের প্রতিটি উপস্থাপনায় যিশু ও অন্য শিষ্যদের বিপরীতে রাখা হতো জুদাসকে, যাতে সবাই বিশ্বাসঘাতককে চিনতে পারে। কিন্তু লিওনার্দো সব চরিত্রকে টেবিলের একই পাশে রাখেন। সবাই শঙ্কিত ও বিচলিত। শিষ্যদের মতোই দর্শকের সামনে একই প্রশ্ন, বিশ্বাসঘাতকটা কে? এ যেন ভবিষ্যৎ ও বর্তমানে ভারসাম্য, যা খোলাসা হবে ভবিষ্যতে।

‘দ্য ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড উইথ সেন্ট অ্যান’। অনেক পণ্ডিতের বিশ্বাস লিওনার্দোর শেষ চিত্রকর্ম এটি। সেন্ট অ্যান, তার মেয়ে কুমারী মেরি ও শিশু যিশু; সঙ্গে ভেড়ার ছানা। সবার দৃষ্টি তির্যক। প্রাকৃতিক আবহে পিরামিডাল ধাঁচের বিন্যাসে অ্যান শীর্ষে, তার কোলে মেরি। আর একটি ভেড়ার ছানাকে নিয়ে খেলারত যিশুকে বিরত রাখার চেষ্টা করছেন মেরি। এই ভেড়া আবার উৎসর্গের প্রতীক। অন্য চিত্রকর্ম ‘দ্য ভার্জিন অব দ্য রকস’-এ চিত্রিত শিশু যিশুর সঙ্গে বৈপরীত্য বিদ্যমান। তবে মূল সুর অন্তরঙ্গ মিথস্ক্রিয়া মানব সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করে; লিওনার্দো কী এই কথায় বলছিলেন?

দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠে ত্রিমাত্রিক স্থানকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন ছিল লিওনার্দোর সাধনা। সেটাই যে নিখুঁত বিশ্বের প্রতিলিপি। ‘দ্য ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড উইথ সেন্ট অ্যান’-এ পাথুরে গঠনগুলো দূরত্বের বিভ্রম তৈরি করে। একই টেকনিক পাওয়া যায় ‘মোনালিসা’ ও ‘দ্য ভার্জিন অব দ্য রকস’সহ অনেক ছবিতে।

লিওনার্দোর চিত্রকর্মের সঙ্গে আলোচিত হয় ‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ নামের ড্রইং। রোমান স্থপতি মার্কাস ভিট্রুভিয়াস পোলিওর ‘দে আর্কিতেকচুরা’ বইয়ে মানবদেহের অনুপাতবিষয়ক আলোচনা এর উৎস। সাদামাটা কালিতেই মানুষকে বৃত্ত ও বর্গের দুটি ভিন্ন বিন্যাসে দেখালেন তিনি। দুটি ক্ষেত্রে তারা এঁটে গেল সাযুজ্যপূর্ণভাবে। সঙ্গে লিখে রাখলেন প্রয়োজনীয় উপাত্ত। এ আইকনিক অঙ্কনে একসঙ্গে মিলেছে গণিত, দর্শক ও শিল্পকলা। রেনেসাঁ যুগের ঠিকঠাক প্রতীক এই ‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’।

লিওনার্দো মারা গিয়েছিলেন ৬৭ বছর বয়সে। কিন্তু আত্মপ্রতিকৃতিতে লম্বা ঢেউ খেলানো চুল ও দাড়িসহ এমন একজন বৃদ্ধকে এঁকেছেন যাকে বেশি বয়সী মনে হয়। লিওনার্দো কিনা দ্বিধা থাকলেও পরিপক্ব বয়সের আভিজাত্য ও প্রজ্ঞার সঙ্গে মানানসই। একজন পলিম্যাথের খুঁতখুঁতে চেহারা তো এমনই হবে। এভাবে অনায়াসে আরো কিছু শিল্পকর্মের নাম নিতে পারি—হেড অব আ ওম্যান, লেডি উইথ অ্যান এরমাইন, সালভাটর মুন্ডি বা পোর্ট্রেট অব জেনেভ্রা বেনচি। এছাড়া লিওনার্দোর অদম্য কৌতূহলের ফলাফল অসংখ্য অসমাপ্ত প্রকল্প। যেখানে চিত্র ও অঙ্কনে মানব প্রকৃতির সবচেয়ে প্রাণবন্ত, জটিল ও কোমল উপস্থাপন পাওয়া যায়।

লিওনার্দো বিশ্বদৃষ্টিসম্পন্ন এক শিল্পী। যিনি কৌতূহল দ্বারা চালিত, বস্তুসমূহের পারস্পরিক সংযোগ দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং যার সাধনা সামগ্রিক ঐক্য, যা মূলত সম্পর্ক ও বিন্যাসের জটা। লিওনার্দোর অনুসন্ধান বলে, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার যত বেশি ক্ষেত্র আমরা আয়ত্ত করি, বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তত পূর্ণতার কাছে পৌঁছে। সম্পর্কগুলো আমরা তত বুঝতে পারি। যেখানে চিত্রকর্মের মাধ্যমে শিল্পী প্রকৃত জ্ঞানলাভ করেন। তিনি অপূর্ণতাকে সম্মানিত করেন পূর্ণতার পথ দেখিয়ে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন