ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প রক্ষায় বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির বিকাশ

তাসলিমা জাহান, ইমতিয়াজ আহমেদ সজল

ছবি: বণিক বার্তা/ফাইল

বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন করেছে এবং এ সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি নেয়ার অঙ্গীকার করেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) শক্তিশালী ভূমিকা ও বাজার সক্ষম হয়ে ওঠা, হতে পারে বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার ও উন্নয়নের চাবিকাঠি। বিশ্বের যেকোনো দেশে উদ্ভাবনের বিকাশ ঘটাতে, এসএমই শিল্পকে দেশীয় অর্থনীতির সুরক্ষাকবজ বলা হয়ে থাকে। নতুন চিন্তা, ক্ষুদ্র আকারে গবেষণা, উৎপাদন, প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি, সম্ভাব্য সমস্যার ক্রমাগত সমাধান প্রয়াস ও নতুন পণ্যদ্রব্য বা প্রক্রিয়ার যে সমন্বয় ও সমাহার করে, তার জন্য এসএমইকে উদ্ভাবনের সূতিকাগার বলা হয়ে থাকে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা ও উন্নয়ন-উদ্ভাবনে ধীরগতির কারণে, দেখা গিয়েছে উন্নত বিশ্বে গুটিকতক বড় আকারের শিল্পের একচেটিয়া প্রভাব, এবং ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্পের পর্যাপ্ত গবেষণা ও উদ্ভাবন না থাকায় বাজার-চাহিদা নিয়ন্ত্রণ প্রায়ই সংকুচিত হবার উপক্রম হয়। এসব বিবেচনায় ক্ষুদ্র ও প্রতিযোগী উদ্যোক্তা সৃষ্টি, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বৈষম্যহীন সুযোগের প্রসার, নতুন নতুন পণ্যের গবেষণা ও বাণিজ্যিকীকরণ ইত্যাদি বজায় রাখতে রাষ্ট্রীয় নীতি, আইন ও পরিকল্পনাতে বিশেষ নজর দিতে হয়। তাই উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্ব নতুন পণ্য ও মানসম্মত বাজার ধরে রাখতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে নানাবিধ প্রণোদনা, সৃষ্টিশীল সুযোগের ব্যবস্থা করে থাকে।

বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি যেমন-পেটেন্ট, ডিজাইন, ট্রেডমার্ক, জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন, ট্রেডসিক্রেটের অধিকার চর্চা ও প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও পণ্যকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে নিজস্ব অবস্থান প্রতিযোগিতা সক্ষম করে গড়ে তোলা তেমনি একটা প্রয়াস। বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর থেকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তিসংক্রান্ত চুক্তি (ট্রিপস) অনুযায়ী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পণ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিতকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ পণ্য ও সেবার বাজার সৃষ্টি করতে বর্তমানে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তিসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও সংশোধন প্রক্রিয়াতে আছে। ইতোমধ্যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজেদের অবস্থান শক্ত ও স্বনির্ভর করতে নতুন করে জাতীয় উদ্ভাবন ও মেধাসম্পদ নীতিমালা ২০১৮, এসএমই নীতিমালা ২০১৯, জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০২২ এবং বাংলাদেশ পেটেন্ট আইন, ২০২২ প্রণয়ন করেছে। উন্নয়নশীল হওয়া মাত্রই, মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তি অনুযায়ী দেশীয় শিল্পের পাশাপাশি বিদেশি শিল্প, বিনিয়োগকারী ও বহুজাতিক কোম্পানি তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির সমঅধিকার রক্ষায় দেশের আইন-আদালত ও সরকারের কাছে সুযোগ পাবে।

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেশীয় শিল্পে এসএমই বাণিজ্য পণ্য বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। এটাও লক্ষণীয় যে গবেষণা, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ সহজলভ্য বলে, দেশীয় এসএমই ও স্টার্ট-আপগুলো নতুন নতুন পণ্য নিয়ে কাজ করতে চাইছে। ২০২৬ সালের পর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা ও আন্তর্জাতিক চুক্তির বিশেষ সুবিধা বন্ধ হয়ে গেলে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি এসব পণ্যকে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের পণ্যের সাথে সমপ্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে টিকে থাকতে হবে। অন্য অর্থে, শুধুমাত্র রপ্তানিযোগ্য পণ্য সরবরাহই একমাত্র লক্ষ্য নয়, বরং নিজস্ব বাজার থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার গ্রহণযোগ্যতা, বাজার তৈরি করা এবং তা ধরে রাখার প্রয়াসে এখন থেকেই বাংলাদেশের এসএমইকে প্রস্তুতি নিতে হবে। বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনময় এসব শিল্প ও উদ্যোক্তারা কতটা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকারী ও মুক্তবাজারের শক্তিশালী শিল্পের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কতটা সক্ষম, এ প্রশ্ন এখন ভাবিয়ে তুলছে।

বাংলাদেশের এসএমই উদোক্তা ও পণ্যসামগ্রী নানারকম আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও কৌশলগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এক দিকে যেমন পণ্যের বাজার ও গুনগতমান, গবেষণা নিয়ে উদোক্তারা পর্যাপ্ত সুবিধা পায় না, তেমনি সৃষ্টিশীল ও গুণগত মানের পণ্যগবেষণা ও বাজার সৃষ্টিকরণে কৌশলগত, প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক সুবিধাও পায় না। তাই উন্নয়নশীল হওয়ার পথে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি কীভাবে দেশীয় শিল্প ও পণ্যকে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে সহায়তা করে, তাই লক্ষণীয়। বাংলাদেশের এসএমই শিল্পের মধ্যে বেশিরভাগ কৃষিজপণ্য আর কিছু সেবাখাতে অগ্রসর হচ্ছে। দুর্ভাগ্য যে, ব্যক্তি উদ্যোগে বেড়ে ওঠা এসব শিল্প এখনো উৎপাদনশীল ও টেকসই হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের এসএমই শিল্প অর্থলগ্নি, ব্যাংক ঋণ, কাঁচামাল নির্ভরতা, বহুমুখীতার অভাব, গুণগতমান রক্ষার সমস্যায় প্রায় দুদশক ধরে সংগ্রাম করে আসছে। উপরন্তু, করোনা মহামারি ছিল এ বিশাল দেশীয় সম্ভাবনাময় শিল্পখাত ও কর্মসংস্থানের জন্য একটা বিরাট ধাক্কা। এ শিল্পের জন্য একটি টেকসই শিল্প-বাণিজ্য নীতি ও উদ্ভাবন রোডম্যাপ দেশীয় অর্থনীতিতে পণ্য উৎপাদন, প্রতিযোগিতা, রপ্তানিযোগ্য পন্যের পরিমাণ, স্বনির্ভরতার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে পারে।

শিল্পের বিকাশ ও পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বাজার অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বৈষম্যহীন প্রতিযোগিতার ভারসাম্য বজায় রাখা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করা। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সুরক্ষার মাধ্যমে প্রতিযোগিতা, ক্ষুদ্রশিল্পের দক্ষতা ও সৃষ্টিশীল পণ্য উৎপাদনে তাদেরকে বিশেষ আর্থিক ও আইনগত সুবিধা দেয়া যায়। উন্নত বিশ্বের বাজার ব্যবস্থায় নতুন পণ্যের সুরক্ষা ও বাজারজাতকরণে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনের প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার দেয়ার একান্ত উদ্দেশ্যই হলো- সৃজনশীল কাজকে অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেয়া, যা কিনা পরবর্তী গবেষণা ও উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করে শিল্প-উৎপাদন ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে।

বিশ্বে উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে এখন বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচককে (গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স) বিবেচনা করা হয়। যে দেশের উদ্ভাবনী গবেষণা ও সৃষ্টি যত বেশি, সেখানে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি তত বেশি। সূচকে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান যেমন প্রথম সারি দখল করে আছে, তেমনি চীন কিংবা ভারত ও তাদের অবস্থানের অগ্রগতিতে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে, তারা তাদের উৎপাদন ব্যবস্থায় দেশীয় পণ্যের বিকাশ, প্রযুক্তিগত গবেষণা-উদ্ভাবন, শিল্পায়নে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা অব্যাহত রেখেছে।

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের পর বাংলাদেশেও সবধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির চর্চা ও প্রয়োগ আরো কার্যকর ও শক্তিশালী হবে। যাতে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির মালিকের অনুমতি ব্যতীত কোনো পণ্য বা সেবা প্রণালীর উৎপাদন, পুনঃউৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, বিক্রয় বা বিতরণ করা যাবে না। আর তাই উন্নয়নশীল পরবর্তী সময়ে এসএমই শিল্পগুলোকে তাদের উৎপাদন ও বিপণনে বৃহৎ শিল্পের অনুকরণের পরিবর্তে মৌলিকত্ব ও সৃজনশীলতার দিকে ধাবিত হতে হবে। যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর। সে লক্ষ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত আইনকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যেন একদিকে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূরণ হয়, অন্যদিকে এসএমই শিল্পের স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দেশীয় অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় থাকে। আর এসএমই শিল্পের বিকাশ তখনই সম্ভব হবে যখন দেশীয় বাজারে উৎপাদন ও বিপণনে একটি বৈষম্যহীন ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ বিরাজ করবে এবং তাদের উদ্ভাবনী সক্ষমতা তৈরি হবে। অন্যথায় বৃহৎ শিল্পের প্রভাবান্বিত একচেটিয়া বাজার ব্যবস্থায় এ শিল্প ক্রমেই বিলীন হয়ে যাবে। তাই এসএমই শিল্পের স্বয়ংসম্পূর্ণ উদ্ভাবনী সক্ষমতা মানে দেশীয় প্রবৃদ্ধির সমূহ সম্ভাবনা।

জাতীয় অর্থনীতির এ ক্রান্তি লগ্নে এসএমইসহ প্রতিটি শিল্পের পৃথক বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রণয়ন করে, স্বকীয় উৎপাদন ও বিপণন কাঠামো গড়ে তুলতে মালয়েশিয়া, ভারত, সিঙ্গাপুর ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের জন্য অনুকরণীয়, যেমনÑ সংশ্লিষ্ট শিল্পকে সরকারি প্রনোদনা, কর রেয়াত বা পুরস্কার হিসেবে বিশেষ সুবিধা দেয়া, যা অন্যান্য শিল্প বা উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত করবে। তাই এখন করণীয় হচ্ছে- দেশীয় উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনা এবং অধিকার লঙ্ঘনের সম্ভাব্য প্রতিরোধ ও প্রতিকার নিয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া, যাতে তারা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তিকে একটি সফল ব্যবসায়িক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। সেই সাথে, বৈদেশিক বাণিজ্য ও বাজারসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদেরকে দক্ষ করে তুলতে পর্যাপ্ত আইনগত ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ব্যবস্থা রাখা চাই। এছাড়াও কৃষিজ, ঐতিহ্যগত ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের পণ্যের জন্য, বাজার ব্যবস্থায় বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সর্বোপরি, উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবন নির্ভর এসএমই শিল্প পুনর্গঠনে বাংলাদেশ এখন যত্মশীল হবে এমনটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখকদ্বয় যথাক্রমে গবেষক, আইনজীবী ও আইপি কনসালটেন্ট, বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর; এবং তুরস্কের আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনে উচ্চ শিক্ষারত।

সৌজন্যে: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন