বিশ্বমানের সুবিধা দেবে আব্দুল মোনেম ইকোনমিক জোন

অর্থনৈতিক অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সুবিধাজনক স্থান নির্বাচন করতে পারা। আমাদের ইকোনমিক জোনটা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে এবং মেঘনা-গোমতী নদীর মোহনার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। বিনিয়োগকারীরা নদীপথ ব্যবহার করতে পারবে আবার মহাসড়কের মাধ্যমে সরাসরি বিমানবন্দর বা সমুদ্রবন্দরেও যেতে পারবেন। তাই আমি মনে করি আমাদের জোনের কানেকটিভিটি ভালো হওয়ায় স্থানীয় আন্তর্জাতিক বাজারে যোগাযোগ স্থাপন সহজ। আমরা এখানে ঢাকা থেকে ৩০ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে আছি। আমি মনে করি আব্দুল মোনেম ইকোনমিক জোনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্থানগত সুবিধা

এএসএম মঈনুদ্দিন মোনেম

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আব্দুল মোনেম লিমিটেড

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিজনেস সামিটে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ঘরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর ভূমিকা কেমন হতে পারে?


মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন তার সঙ্গে আপনার প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। বর্তমানে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বা শতাংশের মধ্যে। সে হিসাবে এখনো আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার কম করে হলেও শতাংশ বাড়াতে হবে। সেটি কোথা থেকে আসবে? সেক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রী শুধু স্বপ্নই দেখাননি, পদ্ধতিগতভাবেও তিনি অনেক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন। যার অন্যতম হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠা করা। তার সাথে সাথে রয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠা, আন্তঃবিভাগীয় রাস্তা তৈরি প্রশস্তকরণ, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাকরন, রেল যোগাযোগের উন্নতিসাধন। সবকিছুই একটা ইন্টিগ্রেট সিস্টেমের অংশ।

বর্তমানে আমাদের বিনিয়োগ জিডিপির হার হচ্ছে ৩৬ শতাংশ। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশের বেশিতে উন্নীত করতে হলে বিনিয়োগ জিডিপির হার ৪০ শতাংশের উপরে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত বিনিয়োগ। এই বাড়তি বিনিয়োগ আসতে পারে ১০০টি ইকোনমিক জোনে যে সকল বিদেশী কোম্পানি তাদের কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করবে তার মাধ্যমে। যদি প্রতিটি ইকোনমিক জোনে তিনশ থেকে পাঁচশ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়, তাহলে এই অতিরিক্ত বিনিয়োগ অতি সহজেই হয়ে যেতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য এটিই লক্ষ্যমাত্রা হবে যে কীভাবে একশটি ইকোনমিক জোন দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়। এর সাথে আরো নিশ্চিত করতে হবে কীভাবে যেসব সুবিধা প্রদান করলে দেশে বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ ত্বরান্বিত হবে তার ব্যবস্থা করা যায়। সেটি করতে পারলেই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত ১০ শতাংশ হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারব এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন পূরণ করতে পারব।


অর্থনৈতিক অঞ্চলের সুফল ভোগ করতে দেশে অবকাঠামোগত কোনো দুর্বলতা আছে বলে কি আপনি মনে করেন?


অবকাঠামো একটি ডাইনামিক প্রসেস। এটা দীর্ঘমেয়াদি অর্জনের জন্য একটি নির্দেশিকা। গত ১০ বছরে আমরা অনেক অগ্রগতি করেছি। মেট্রোরেল হচ্ছে, পদ্মা সেতুর মতো অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের প্রয়োজন অবকাঠামোগত সিমলেস কানেক্টিভিটি। যার ফলে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প, টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ, লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ, হালকা প্রকৌশল ইন্ডাস্ট্রিজগুলো তাদের উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী তারা স্থানীয় আন্তর্জাতিক বাজারে বিপণনের সুযোগ পাবে। তবে স্থানীয় আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য বন্দর এবং সংশ্লিষ্ট সুবিধাগুলো আরো সহজ করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী যে মাস্টারপ্ল্যান করেছেন সেটি যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি, আমি আশা করি আগামী - বছরের মধ্যে আমাদের সব ডটসের সংযোগ তৈরি করতে পারব। তখন ভিয়েতনাম, চায়না বা অন্যান্য বড় দেশের সারিতে আমরা চলে যেতে পারব। আমাদের অবকাঠামোগুলো এখন ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ে আছে। এটাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অবকাঠামো নিয়ে প্রচলিত চিন্তার পরিবর্তে বাণিজ্য, ট্রানজিট লজিস্টিকস মিলিয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম বা গাজীপুরে পণ্য পরিবহনের চিন্তা করেই বিষয়টি ভাবলে হবে না, বৃহত্তর আঙ্গিকে অবকাঠামোর উদ্যোগ থাকতে হবে। এমনভাবে অবকাঠামো থাকতে হবে, যাতে থেকে ঘণ্টার মধ্যে সারা দেশের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়।


আব্দুল মোনেম ইকোনমিক জোনে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরা কী ধরনের সুবিধা পাচ্ছেন? নতুন কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে আছে কি?


আমাদের জোনে দুটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে জাপানের হোন্ডা কোম্পানি চার বছর ধরে ভালো উৎপাদন করছে। এক্ষেত্রে তারা সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ, জমিসহ নানা সুবিধা পাচ্ছে। ফলে তারা ভারত থাইল্যান্ডে অবস্থিত তাদের কারখানার সমকক্ষ করে এখানেও হোন্ডা তৈরি করতে পারছে। এটি বিবেচনায় নিলে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি সঠিক গন্তব্য। এখন পরিকল্পনা অনুযায়ী যদি অবকাঠামো উন্নয়ন করতে পারি তাহলে আগামী দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে আরো অন্তত পাঁচটি বিদেশী প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আনতে পারব বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের তালিকায় কয়েকটি কোম্পানি আছে।



সব সুবিধা থাকার পরও বিনিয়োগ আসতে অনেক দেরি হচ্ছে বলে আপনার মনে হয় না?


নিজের সমালোচনা উত্তম কাজ। প্রধানমন্ত্রী যে স্বপ্ন নিয়ে আমাদের ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লাইসেন্সটি দিয়েছেন, সে অনুযায়ী আমরা আমাদের লক্ষ্যে যেতে পারিনি, এটি সত্য। আমাদের বড় বাধা গ্যাস বিদ্যুৎ সংকট। এখন পর্যন্ত যে সবঅফ সাইড ইনফ্রাস্ট্রাকচারপ্রদান করার কথা ছিল তা দেয়া হয়নি বলে আমরা গ্যাস বিদ্যুৎ সংকট নিরসন করতে পারিনি। এখনো তিতাসের কাছে আমাদের ফাইল পেন্ডিং আছে। বহু প্রতীক্ষার পর যে লাইন লাগানো হয়েছিল, তা ত্রুটিপূর্ণ থাকায় নতুন লাইন বসাতে হবে। এর জন্য নতুন করে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বেজা যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, সেই মাইন্ড সেটে অন্যরা এগোচ্ছে না।

আমি কারো প্রতি অভিযোগ করে বলছি না, ইকোনমিক জোনকে যদি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হয়, তাহলে প্রথমেই অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। যে কারণে আমরা বিদেশী বিনিয়োগকারী আনতে পারিনি। হোন্ডাকে আমরা বিদ্যুৎ দিচ্ছি নিজস্ব জেন সেটের (জেনারেটর) মাধ্যমে। জেন সেট কিনে এনে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সাপোর্ট দিচ্ছি তাদের। গ্যাস নেই, এলপিজি দিয়ে কাজ করছে তারা। এগুলো কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। সরকারের যে প্রতিষ্ঠানগুলো ইকোনমিক জোনে গ্যাস দেবে, বিদ্যুৎ দেবে, সে সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে তাদের নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। জোনের জন্য বিদ্যুতের সাব-স্টেশন হওয়া দরকার। আমদানি পর্যায়ে যে সুবিধাগুলো সরকার দিয়েছে, সেগুলোকে আরো বেশি কার্যকরী করতে হবে। আমাদের এখানে মাত্র দুটি কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে সত্যি, এটা খুবই কম কথাও সত্যি। আগামীতে যদি সরকারের সংস্থাগুলো ঠিকমতো কাজ করে, সুবিধাগুলোর উন্নয়ন হয় তখন বিনিয়োগকারী আসার ক্ষেত্রে বাধা থাকবে না।


আব্দুল মোনেম ইকোনমিক জোন নিয়ে আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?


আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে আমার বাবা যখন জীবিত ছিলেন, উনি ইকোনমিক জোনে এক কোটি লোকের কর্মসংস্থানের কথা বলেন। এটা স্বপ্ন, যে স্বপ্নের সঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন জড়িত। জোনে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কোয়ালিটি জব ক্রিয়েশন, মানবসম্পদের উন্নয়ন করা আমাদের পরিকল্পনা। সেই সঙ্গে ভালো ভালো কারখানা তৈরি করা। আমাদের স্বপ্ন হচ্ছে জোনের মাধ্যমে আমরা বিশ্বমানের কারখানা তৈরি করব। এর ফলে আমাদের ছেলেমেয়েরা যারা সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় যে মানের কারখানায় কাজ করে, একই মানের কাজ এখানে করতে পারবে। তখন মুন্সিগঞ্জে কাজ করা আর ব্যাংকক, ভিয়েতনাম বা থাইল্যান্ডে কাজ করার মাঝে কোনো তফাত থাকবে না। আব্দুল মোনেম ইকোনমিক জোন ওই স্বপ্নটা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর এবং তাই করব ইনশা আল্লাহ।


কার্যক্রম শুরু হওয়া ১২ বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারছে কি?


সব জোনেরই বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অবকাঠামো। কোনো বিনিয়োগকারীই আসবে না যদি রিলায়েবল পাওয়ার না থাকে, গ্যাস না থাকে, ভালো কানেক্টিভিটি না থাকে। যতগুলো জোন করা হচ্ছে তার অবকাঠামোগত দুর্বলতা রয়ে গেছে। অবকাঠামোর দুইটা দিক আছেএকটা অফসাইড, আরেকটা অনসাইড। আমাদের গ্যাসলাইন এখনো আসেনি। এখনো যে পাওয়ার নিচ্ছি আরইবি লাইনের মাধ্যমে, তা ৩০ বছরের পুরনো লাইন। শস্যখেত পার হয়ে এগুলো আসছে, পাখি বসলে এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। যে ১২টি জোন আছে, প্রায় সবাই কিন্তু রিলায়েবল পাওয়ার, সিমলেস কানেক্টিভিটি দিতে পারছে না। উপরন্তু তাদের অনেকগুলোই জমিসংক্রান্ত ঝামেলায় আছে। এখানে সরকারি প্রক্রিয়ায় ইকোনমিক জোনকে ভিন্নমাত্রায় দেখতে হবে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এফডিআই সম্পর্কে খুবই সচেতন। কিন্তু আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও মনে রাখতে হবে যে, তাদের কাজ সুবিধা দেয়া, একটি বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করে দেয়া, বাণিজ্য করা নয়। সরকারি খাত যেদিন থেকে মনে করবে, দেশ গড়ার জন্য আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সুবিধা দেয়াই আমাদের কাজ; সেদিন ১২টি কেন একশটি জোন হয়ে যাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে।


অর্থনৈতিক অঞ্চলের সফলতা ত্বরান্বিত করতে নতুন কোনো নীতি প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন?


জোনগুলোর সবচেয়ে বড় বাধা ২০০ থেকে ৩০০ একর জমি নিষ্কণ্টক করা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে এই ২০০ বা ৩০০ একর নিষ্কণ্টক জমি পেতে হলে দেখা যায় মাঝেমধ্যে দুই তিন একর খাসজমি আছে। সেক্ষেত্রে সরকারের খাসজমি কিনতে হবে। অকৃষি খাসজমি বন্দোবস্তের নীতিমালা, ১৯৯৫ () অনুচ্ছেদে বলা আছে, বাড়িঘর বা শিল্প-কারখানার জন্য দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত প্রদান করা যাবে। দীর্ঘমেয়াদি মানে ৯৯ বছর। এটা পরবর্তীতে অন্য একটি সার্কুলারে বলা আছে; তবে এটা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে কিছু কর্মকর্তার। আইনের মধ্যে স্পষ্ট বলা আছে, বাজারমূল্যের দেড় গুণ টাকা দিয়ে জমি কিনতে হবে। তার পরও সেটি সম্ভব হচ্ছে না। বাধা কোথায় আমরা বুঝছি না। খাসজমির নীতিমালাতে ইকোনমিক জোন অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। কারণে আমাদের অনেক বিনিয়োগকারী চলে গেছে। আমরা জমি দিতে পারিনি ঠিকমতো। এখন আমাদের জমির বাউন্ডারি করতে পারছি না। অনেক জমি একত্র করতে গিয়ে দেখছি ২০ একর জমির মাঝখানে আধা একর আছে খাসজমি। আমি মনে করি, ভূমির ক্ষেত্রে আইনের আরো পরিবর্তন আনা দরকার। আইন আছে তবে সেটি আরো স্পষ্ট করা দরকার। এটি করার জন্য বেজাকে এখানে একটা অধিকার দেয়া দরকার। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যেখানে খাসজমিগুলো আছে ওই আইন অনুযায়ী এগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে বন্দোবস্ত দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

সবচেয়ে বেশি ইকোনমিক জোন হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টে এবং এদের বেশির ভাগই নির্ভর করতে হয় আরইবি পাওয়ারের ওপর। এটার ন্যাচারাল কিছু অসুবিধা আছে। বহু বছরের পুরনো লাইন, ঝড়ে নষ্ট বন্ধ হয়ে যায়, পাখি বসলে নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের এখানে হোন্ডাতে দেখা গেছে এক মাসে ৪০ বার বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। তখন বাধ্য হয়ে আমরা নতুন জেনারেটর কিনেছি। তখন আমরা তেল জ্বালিয়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছি। এটা কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে টেকসই না। পাওয়ারের ক্ষেত্রে আমি মনে করি ক্যাপটিভ পাওয়ার নীতিমালা হওয়া দরকার। শুধু ইকোনমিক জোনের জন্য, ব্যবসায়ের জন্য না। ইকোনমিক জোনের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী পাওয়ার প্লান্ট দরকার। জমির ক্ষেত্রে একটা, আর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে একটা। এই দুইটা ক্ষেত্রে নীতিমালা দ্রুত হওয়া জরুরি।


সরকার রফতানি বহুমুখীকরণের বিষয়ে জোর দিচ্ছে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?


অনেক দেশ রফতানিতে বৈচিত্র্য আনায় সফল হয়েছে। পৃথিবীতে কোনো ব্যবসায় চ্যারিটি (দাতব্য সংস্থা) নেই। আপনি একটা টি-শার্ট কিনবেন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে। একটা টি-শার্টের দাম কত, ৩০ ডলার বা ৪০ ডলার? আপনি (ক্রেতা) সবসময় দামের জন্যই যাবেন। প্রতিযোগিতা এখানে। বাংলাদেশে রফতানি বৈচিত্র্যকরণে মূল যেটা সেটা হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতা এবং নীতিগত স্থিতিশীলতা। এখন বারবার যদি নীতি পরিবর্তন করেন তাহলে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে পারবেন না।

ইকোনমিক জোন করার ক্ষেত্রে এই যে অবকাঠামো নিয়ে কথা বলছি তার সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে যে পণ্য ডেলিভারির ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি ঠিক রাখা এবং আস্থা অর্জন করা। তাহলে যেটা হচ্ছে, আমি যদি প্রতিশ্রুতি দিই এত লাখ টি-শার্ট রফতানি করব ইতালিতে তখন যদি আমার সাপ্লাই চেইন ঠিক না থাকে, যদি আমার বন্দর ঠিকমতো কাজ না করে, যদি আমার শ্রমশক্তি ঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে আমি কীভাবে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করব? ফলে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সাপ্লাই চেইন নিয়ে আমাদের কালক্ষেপণ না করে ভালো পরিকল্পনার মাধ্যমে তা দ্রুত করতে হবে। এখন আমি এক্সপ্রেস হাইওয়ে করলাম। গাড়ি আটকে আছে আমিনবাজারে, হানিফ ফ্লাইওভারে। তাহলে হবে না, সিমলেস কানেক্টিভিটি নিশ্চত করতে হবে। আমার এখান থেকে গাড়ি চলা শুরু করবে আর আমি বলতে পারব এত মিনিটে এটি বন্দরে গিয়ে পৌঁছবে। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের ভিশন। এটাই স্বপ্ন আমাদের, আমরা আমাদের দেশকে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলব। এটাই স্বপ্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর।

এটা যখন নিশ্চিত করবেন তখন দেখবেন ইকোনমিক জোন এবং জোনের বাইরের ছোট মাঝারি শিল্প, হালকা প্রকৌশল শিল্পগুলো তাদের প্রয়োজনীয় সুবিধা এমনিতেই পেয়ে যাবে। এখন তো বিদ্যুৎ পাচ্ছে না, গ্যাস পাচ্ছে না; তখন আর এগুলোর সমস্যা থাকবে না। তখন দেখবেন কেউ ভালো করছে হালকা প্রকৌশলে, কেউ আইটিতে, কেউ সেবা খাতে। তখন আমাদের সক্ষমতা বাড়বে, কম মূল্যে আমাদের উদ্যোক্তারা পণ্য তৈরি করতে পারবে। কাজটা হচ্ছে অবকাঠামো, ইফেক্টটা হচ্ছে এফডিআই ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এটা যদি হয়, তাহলে দেখবেন যে দেশের ভেতরে-বাইরে সবাই এসে বিনিয়োগ করবে।


আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো যেমন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া যেটা দিতে পারছে সে তুলনায় আমরা কতটুকু পারছি?


দুইটা কথা বলব এখানে। একটা হচ্ছে কস্ট অব ডুইং বিজনেস, আরেকটা হচ্ছে ইজ অব ডুয়িং বিজনেস। এই দুইটা কথা বিশ্বে খুব প্রচলিত। অবকাঠামোতে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। তাহলে কি হচ্ছে, কস্টও (খরচ) বাড়ছে আবার পণ্য ডেলিভারির সময় বাড়ছে। ভিয়েতনাম যেটা করতে পারে আমরা সেটি পারি না কেন? সেটা হচ্ছে ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) বেজায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস থাকা সত্ত্বেও সরকারি দপ্তর থেকে কোনো একটি বিশেষ অনুমতি পেতে তিন বছরের বেশি সময় লেগেছে। তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে আপনার উপস্থিতি যদি নিশ্চিত করতে হয়, এই জটিলতাগুলোর সমাধান করতে হবে। সরকারকে বেসরকারি খাতে সুবিধা দিতে আসতে হবে। এই অথরিটিগুলো সব বেজাকে দিয়ে দিতে হবে। বিদ্যুতের একজন থাকতে পারে, গ্যাসের একজন থাকতে পারে যিনি বেজাকে রি-প্রেজেন্ট করবেন, ল্যান্ডের একজন থাকতে পারে। বলতে হবে বাংলাদেশে লাইসেন্স করতে দিন সময় লাগে। ভালো কথা, এই ছয়দিনেই নিশ্চিত করতে হবে। লাইসেন্স করতে গেলে অপ্রত্যাশিত দেরি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমি যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করি, চীন বা অন্য দেশ থেকে যে বিনিয়োগকারী আসবে তার সময় আরো অনেক বেশি। একটা মানুষ বিনিয়োগ করতে এলে তাকে ভিসার জন্য জটিলতায় পড়তে হয়; কাজ করতে এলে তার ট্যাক্স কত হবে তা জানতে হয়? এসব ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে সমাধান করে ফেলতে হবে। আর কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস একটা সীমাবদ্ধ মাত্রায় রাখতে হলে সুবিধা দিতে হবে বিশ্বমানের। সরকারকে এখানে কঠোর হতে হবে।


ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক প্রতিনিয়ত সুদের হার বাড়াচ্ছে, এতে বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব পড়েছে। কঠিন এ পরিস্থিতিতে আমাদের এখানে বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা কতটুকু?


আমি আসলে গ্লাস অর্ধেক খালি নয়, অর্ধেক ভরাটা দেখতে চাই। বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই চ্যালেঞ্জ। কারেন্সির ভারসাম্য না থাকার কারণে এবং বিনিময় হার, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে আমাদের এলসি হচ্ছে না আসলে। নির্মাণ খাতের অনেকেই এলসি করতে পারছেন না। স্টিলের এলসি হচ্ছে না। দাম ঊর্ধ্বমুখীখরচ প্রতিদিন বাড়ছে। ব্যবসায়ের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অবকাঠামোগত খরচ যেটা ছিল একশ কোটি, সেটি এখন দেড়শ কোটি হয়ে গেছে। এটা কিন্তু বিরাট চ্যালেঞ্জ।

বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে, বিশেষ করে ডলারের ওপর। এছাড়া ভারতসহ অন্য দেশগুলোর সঙ্গে আমরা নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করতে পারি কিনা সেটি দেখতে হবে। এখানে সরকারের নীতিগত বিষয় আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এখানে যুক্ত হতে হবে। কারণ আমাদের ৮০ শতাংশ কারখানা এলসির জটিলতায় ভুগছে। ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগার ঝুঁকি আছে। বর্তমানে আমাদের যে অনুপাতে সাপ্লাইয়ের প্রয়োজন, সে অনুপাতে কারখানাগুলো সাপ্লাই দিতে পারছে না এখন। যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তার ৩০ শতাংশ বা ৪০ শতাংশ করতে পারছে।


আপনার ইকোনমিক জোন অন্যদের থেকে বেশি সুবিধাজনক কেন বলছেন?


অর্থনৈতিক অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সুবিধাজনক স্থান নির্বাচন করতে পারা। আমাদের ইকোনমিক জোনটা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে এবং মেঘনা-গোমতী নদীর মোহনার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। বিনিয়োগকারীরা নদীপথ ব্যবহার করতে পারবে আবার মহাসড়কের মাধ্যমে সরাসরি বিমানবন্দর বা সমুদ্রবন্দরেও যেতে পারবে। তাই আমি মনে করি আমাদের জোনের কানেক্টিভিটি ভালো হওয়ায় স্থানীয় আন্তর্জাতিক বাজারে যোগাযোগ স্থাপন সহজ। আমাদের জোনটি ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরত্বে আছি। আমি মনে করি আব্দুল মোনেম ইকোনমিক জোনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্থানগত ভৌগোলিক সুবিধা।

 

সাক্ষাৎকার: তোফাজ্জল হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন