ইকোনমিক জোনে যে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় তা বাইরে মিলবে না

প্যাক্ট গ্রুপ মূলত কাজ করে সার্কুলার ইকোনমি এবং টেকসই পণ্য নিয়ে। সার্কুলার ইকোনমি পরিবেশের ওপর থেকে নেতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি দূর করতে সক্ষম। হ্যাঙ্গারে প্রচুর প্লাস্টিকের ব্যবহার রয়েছে। আর প্লাস্টিকের ব্যবহার যত বেশি হয় তত ল্যান্ডফিল হয়, কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়ে। আমাদের হ্যাঙ্গার প্রজেক্টটা মূলত রিইউজ প্রজেক্ট। একটা হ্যাঙ্গার যদি এখানে উৎপাদন হয়, তখন তৈরি পোশাকের সঙ্গে বিদেশে যায়, রফতানি হয়। আর যখন খুচরা বাজারে পোশাকটা বিক্রি হয়, তখন হ্যাঙ্গারটা আবার আমাদের কাছেই আসে। তারপর আমরা সেটিকে আবার প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করি 

মো. রফিকুজ্জামান

কান্ট্রি ম্যানেজার, প্যাক্ট গ্রুপ

অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি প্যাক্ট বাংলাদেশে বিনিয়োগ কারখানা স্থাপনের কারণ কী?

বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ বাংলাদেশ। এখানে আমাদের কোনো কারখানা ছিল না। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ব্যবসা করতাম। তবে আমাদের ব্যবসার আকার বাড়ার পর এদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর জন্য লিডটাইম (সঠিক সময়ে পণ্য দেয়া) ম্যানেজ করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। তাই ২০১৭ সালে এখানে নিজেদের কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিই।

কারখানা স্থাপনের জন্য মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনকেই কেন বেছে নিলেন?

এদেশে ২০১০ সালে আমরা কার্যক্রম শুরু করলেও কারখানা স্থাপনের জন্য ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মেঘনা গ্রুপের সঙ্গে একটি
চুক্তি স্বাক্ষর করি। ওই বছরের নভেম্বরে আমরা উৎপাদনে চলে যাই। এত দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে পারাটা অনেক বড় একটি সাফল্য। এর জন্য মেঘনা গ্রুপের অবদান রয়েছে, অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। তারা অনেক বেশি অ্যাক্টিভ। তাদের স্ট্যান্ডার্ডটাও আমার কাছে মনে হয়েছে আন্তর্জাতিকমানের। এখানে আমাদের দুটি কারখানা রয়েছে। ২০২১ সালে দ্বিতীয়টির কার্যক্রম শুরু করি এবং একই বছর উৎপাদনে যাই।

এখানে আসার ক্ষেত্রে স্থানগত যোগাযোগ সুবিধার বিষয়টিও আমাদের প্রভাবিত করেছে, রাজধানী থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে। লোকেশনটা আমাদের কাছে বেস্ট মনে হয়েছে। আবার আমরা যখন মেঘনা গ্রুপের কাছে যাই এখানে বিনিয়োগের বিষয়ে তাদের অ্যাটিচিউডটাই ছিল অন্য রকম। বিনিয়োগকারীদের তারা নিজেরাই যে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে সেগুলো আমাদের খুবই আকৃষ্ট করেছে। বিশেষ করে মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনের নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কামাল সাহেব, তিনি নিজে সবকিছু তদারক করেন। এখানে যখন আমরা অবকাঠামোর কাজ করছি তখন তিনি নিজে এসে সেগুলোর অগ্রগতি দেখতেন, খোঁজখবর নিতেন। তিনি ওনার টিম নিয়ে কাজ করেছেন যেন এটা প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যেই শেষ হয়। ফলে আমাদের দ্বিতীয় কারখানাটি অন্য কোনো ইকোনমিক জোনে করার কথা চিন্তাই করিনি। সেটিও মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনেই করেছি।


কারখানা স্থাপনের ফলে এখানে অর্থনৈতিক কার্যক্রম কেমন হচ্ছে। আপনাদের মাধ্যমে কর্মসংস্থানই বা কেমন তৈরি হয়েছে?

আমাদের পণ্য হলো তৈরি পোশাকের হ্যাংগার। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের কোনো কারখানা না থাকায় তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য হয়েই এসব আমদানি করতে হতো। যখন এদেশে আমরা কারখানা স্থাপন করি তখন আর তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীদের হ্যাংগার আমদানির প্রয়োজন পড়ছে না। এলসি করার জটিলতায়ও পড়তে হচ্ছে না। আমাদের তারা বাংলাদেশী টাকায় পেমেন্ট দিচ্ছে। ফলে তাদের অনেক খরচ সময় বেঁচে যাচ্ছে। এদেশের টাকাগুলো আর বিদেশে চলে যাচ্ছে না।

হ্যাংগার উৎপাদন করে প্রতি মাসে আমাদের টার্নওভার প্রায় থেকে মিলিয়ন ডলার। এটা আমরা বাংলাদেশের কারখানা থেকেই সাপ্লাই করি। মূলত এদেশের করখানাগুলোই আমাদের পণ্য কেনে। এটা সরাসরি এক্সপোর্ট না, ডিএনডি এক্সপোর্ট (প্রচ্ছন্ন রফতানি) বলে। এছাড়া আমরা সরাসরি কিছু রফতানি করে থাকি। যেমন চীন, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত ইত্যাদি। অর্থাৎ বাংলাদেশের কারখানাগুলো কিনে নেয় ৮০ শতাংশের বেশি পণ্য, বাকি ১০ শতাংশ আমরা রফতানি করে থাকি। আর কর্মসংস্থানের বিষয়ে যদি বলি তাহলে আমাদের এখানে মুহূর্তে ৭০০-৮০০ শ্রমিক কাজ করেন।

ইকোনমিক জোনের ভেতরে এবং বাইরে কারখানা থাকার সুবিধা-অসুবিধাগুলো কী বলে মনে করেন?

প্রথমত আমরা বাংলাদেশে কারখানা করার চিন্তা যখন করি, তখন ইকোনমিক জোনে কী সুবিধা পাব সেটি চিন্তা করিনি। আমাদের একটাই চিন্তা ছিলএখানে কারখানা করতে হবে, তার জন্য কিছু নিরাপদ জায়গা দরকার। বলতে গেলে আমরাই প্রথম অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। আমার মনে হয়, এখন পর্যন্ত আমরাই একমাত্র অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী। ফলে স্বাভাকিভাবেই একটু ভয় কাজ করে। নিরাপত্তার কাথা ভেবেই ইকোনমিক জোনের দিকে আসার সিদ্ধান্ত নেই। এরপর যখন ইকোনমিক জোনে কারখানা করার বিষয়ে আলোচনা করতে এলাম, তখন তারা (মেঘনা গ্রুপ) এখানকার সব সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জানালো। আমরা দেখলাম, ডিউটি ফ্রি সুবিধা পাচ্ছি, ভ্যাট এক্সাম্পশান আছে, ওএসএস সার্ভিস আছে। তো সব মিলে খুবই ভালো একটি ব্যবসার পরিবেশ আছে এখানে। ইকোনমিক জোনের বাইরে কিন্তু সুবিধাগুলো নেই।

সরকারের দিক থেকে নীতিগত কোনো পরিবর্তন বা পরিমার্জন প্রয়োজন মনে করেন?

বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা) শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সব সহযোগিতা করে যাচ্ছে। আমরা তাদের কাছে যখন কোনো কাজ নিয়ে যাই, তারা খুবই ইতিবাচক এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক অনেক জটিলতার কথা বলা হয়ে থাকে, সে জায়গায় বেজার কাছে আমরা সে ধরনের কোনো জটিলতা পাইনি। আমার মনে হয়, বেজার ওয়ান স্টপ সার্ভিসের (ওএসএস) আওতায় যদি সব সেবাই চলে আসে তাহলে বিনিয়োগকারীদের জন্য বেশ ভালো হয়।

হ্যাঙ্গার তৈরির ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহার রয়েছে। পরিবেশ নিয়ে আপনারা কী ভাবছেন?

প্যাক্ট গ্রুপ মূলত কাজ করে সার্কুলার ইকোনমি এবং টেকসই পণ্য নিয়ে। সার্কুলার ইকোনমি পরিবেশের ওপর থেকে নেতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি দূর করতে সক্ষম। হ্যাংগারে প্রচুর প্লাস্টিকের ব্যবহার রয়েছে। আর প্লাস্টিকের ব্যবহার যত বেশি হয় তত ল্যান্ডফিল হয়, কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়ে। আমাদের হ্যাংগার প্রজেক্টটা মূলত রি-ইউজ প্রজেক্ট। একটা হ্যাংগার যদি এখানে উৎপাদন হয়, তখন তৈরি পোশাকের সঙ্গে বিদেশে যায়, রফতানি হয়। আর যখন খুচরা বাজারে পোশাকটা বিক্রি হয়, তখন হ্যাংগারটা আবার আমাদের কাছেই আসে। তারপর আমরা সেটিকে আবার প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করি। একটা হ্যাংগার দেখা যায় সার্কেলে অন্তত পাঁচবার ঘুরছে। কারণ ৭০-৮০ শতাংশ হ্যাংগার সাইকেলে আমাদের কাছে ফেরত আসে। তো আমরা দুভাবেই কাজ করে থাকিএকটা হচ্ছে নতুন পণ্য উৎপাদন, আরেকটা পুনঃব্যবহার করি। আমরা সবসময় চেষ্টা করি
রি-সাইকেল করতে, যে হ্যাংগারগুলো ফেরত আসে সেগুলো আবার ব্যবহার উপযোগী করে বিক্রি করতে। তবে যে ২০-৩০ শতাংশ ফেরত আসে না সেগুলোর ঘাটতি পূরণে নতুন উৎপাদন করি। আমাদের টিক ম্যানুফ্যাকচারিং বাংলাদেশ লিমিটেড পুরোপুরি নতুন পণ্য তৈরির কাজ করে। আর টিক ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ লিমিটেড কাজ করে রি-সাইকেলিং প্রডাক্ট নিয়ে। দুটি প্রজেক্ট আপাতত আমাদের এখানে আছে।

এখন যদি বলেন হ্যাংগার পুনরায় সংগ্রহ হয় কীভাবে? দেখেন, আমরা হ্যাংগার বিক্রি করি তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর কাছে। তারা এটিকে একটি পোশাকের সঙ্গে দিয়ে দোকানে পাঠায়। দোকানে পোশাকটি প্যাক করে ক্রেতাকে দিয়ে দেয়া হয়। দোকানে একটা ড্রব বক্স থাকে, হ্যাংগারটা সেখানে রেখে দেয়। দিন শেষে সেগুলো একটি বড় বক্সে রাখা হয়। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আমরা এগুলো রিটার্ন নিয়ে আসি। চায়না এবং শ্রীলংকায়ও আমাদের হাব আছে। তখন আইটেম অনুযায়ী, কালার অনুযায়ী, সাইজ অনুযায়ী এগুলো আবার রি-প্যাক করা হয়। একটা হ্যাংগার দেখা গেল তার সাইকেলে পাঁচ-ছয়বার ঘুরছে। আমাদের যদি রিইউজ প্রক্রিয়া না থাকত তখন ছয়বারই নতুন হ্যাংগার তৈরি করা লাগত। এটা পরিবেশের জন্য হতো মারাত্মক ক্ষতিকর।

বাংলাদেশে আগামীতে আর কোন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে আপনাদের?

আপাতত দুটি নিয়েই কাজ করতে চাই। আগামীতে দুটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আরো বাড়ানোই এখন মূল কাজ। চীন শ্রীলংকায় যে দুটি প্রজেক্ট আছে সেগুলো কিছুটা ছোট করার পরিকল্পনা করছি আমরা। কারণ বাংলাদেশে অনেক বেশি চাহিদা এবং এখানেই আমরা আমাদের কার্যক্রম বাড়াতে চাই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন