দেশের শিল্পায়নে অনেক বড় ফুটপ্রিন্ট রাখতে যাচ্ছে সিটি গ্রুপ

সিটি গ্রুপ মোট তিনটা বেসরকারি ইকোনমিক জোনের ডেভেলপার। মেঘনা গ্রুপও তিনটা ইকোনমিক জোনের ডেভেলপার, বসুন্ধরা গ্রুপ আছে, আরো অনেক গ্রুপ আছে। বাংলাদেশ অনেক ভালো করেছে এফডিআই আকর্ষণের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোন। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে ভোগ্যপণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সিটি গ্রুপের খুব সুনাম আছে। সয়াবিন তেল হোক বা আটা, ময়দা, চিনি অথবা পশুখাদ্য মোট চাহিদার ৩০-৪০ শতাংশ একাই সরবরাহ করে। বলা যায় ছয় কোটি মানুষের চাহিদা একাই পূরণ করে সিটি গ্রুপ। খাতের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি ইকোনমিক জোনে আছে। সিটি ইকোনমিক জোনে তা পুরোপুরি সংযুক্ত। প্রথম যেটা লাইসেন্স পায় সেখানে সবগুলোয় সিটি গ্রুপের নিজস্ব বিনিয়োগ। পরবর্তী সময়ে হোসেন্দী প্রাইভেট ইকোনমিক জোনে ঢাকা সুগার মিল, পেপার মিল, এলপিজি হয়েছে, এখন সিমেন্ট মিল হচ্ছে। সেখানে শিপ বিল্ডিং হয়েছে। জায়গায় কিছু জয়েন্ট ভেঞ্চার হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ আছে। এরই মধ্যে একটা কারখানা চালু আছে আর একটি শিপ বিল্ডিং চালু হয়েছে

পবন চৌধুরী

প্রধান উপদেষ্টা, সিটি গ্রুপ

 

অর্থনৈতিক অঞ্চল ধারণা বাস্তবায়নের শুরু থেকেই আপনি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখন পর্যন্ত অভিজ্ঞতা কেমন?

আমি বলব এটা খুবই উৎসাহমূলক। বাংলাদেশের শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক কাঠামো পুরোপুরি পরিবর্তন করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে একটা আইন করে, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস অ্যাক্ট ২০১০ এর আগেও বাংলাদেশে শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা হয়েছে এবং বাংলাদেশের মতো চেষ্টা খুব কম দেশে হয়েছে। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের সময়ে যখন শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তখন বিসিক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প করপোরেশন) হয়। সেটা খুব বড় একটা উদ্যোগ বলে আমি মনে করি এবং একটি মৌলিক উদ্যোগ। সেখান থেকে ধীরে ধীরে অর্থনীতি বড় হতে থাকে। ১৯৮০ সালে তৎকালীন সরকার নতুন একটা আইন নিয়ে আসে। বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অ্যাক্ট। তখন অন্য অনেক দেশ মডেলে সফল হচ্ছিল। এক্সক্লুসিভ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন করে তারা তাদের দেশের এক্সপোর্ট বাড়ানোর ক্ষেত্রে সফলতা পাচ্ছিল। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো যাদের অতিরিক্ত মূলধন ছিল তারা অন্য দেশে বিনিয়োগ করে মূলধন বাড়ানো বা সম্পদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। সেই সুযোগটা করে দেয়ার জন্য বাংলাদেশও কাজ করে। এতে আরেকটা কাজ হয়, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে তখন এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন হতে থাকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। এরপর আর বাংলাদেশে কোনো এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন হয়নি। 

তারপর এসে বিওআই হয় ১৯৮৯-এ। ১৯৯৬ তে আরেকটা আইন হয়, বেসরকারি ইপিজেড প্রতিষ্ঠা। আমি বলব এটা সরকারের আরেকটা সাহসী পদক্ষেপ, যে ব্যক্তিও ইপিজেড প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কিন্তু ভালো উদ্যোগ হওয়া আর ভালো ফল পাওয়া কিন্তু এক না। যেকোনো কারণে হোক যে সম্ভাবনা নিয়ে এটা তৈরি হয়েছিল, তা আর এগোয়নি। এখনো একটা বেসরকারি ইপিজেডই আছে। সেটাও যে পুরো সম্ভাবনা নিয়ে বাস্তবায়ন হয়েছে, তা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না। একজন কোরিয়ান বিনিয়োগকারী চট্টগ্রামের আনোয়ারায় তা বাস্তবায়ন করেন, এরপর দ্বিতীয় কোনো বেসরকারি ইপিজেড হয়নি। এরপর আরেকটা অথিরিটি তৈরি হয়। ২০১১ সালে সৃষ্টি হয় বেজা (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ) 

দেশের সম্ভাবনাময় অঞ্চলগুলোয় ১০০টি ইকোনমিক জোন করার জন্য একটা নীতিগত অবস্থান আমরা ঘোষণা করেছি। তার মধ্যে প্রায় ২৮টি ইকোনমিক জোন হয়েছে। ৯৭টি সাইট সিলেকশন হয়েছে। এগুলো করতে গিয়ে আমরা বুঝেছি, জায়গাতেও সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি খুব বেশি প্রয়োজন। এবং এটার ফলোআপ প্রয়োজন। সরকারের সহায়তা ছাড়া যা সম্ভব না। অথরিটির কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু অনেক জায়গায় অথিরিটি থাকে না। অনেক জায়গায় চাইলেও অনেক কিছু করা যায় না, আবার চাইলে যে অনেক কিছু করা যায় তার প্রমাণ হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর। যেটা অনেক সক্ষমতা নিয়ে তৈরি হচ্ছে। বলা যায় একাই একশটি ইকোনমিক জোনের সমান। জাপান ইকোনমিক জোন, চাইনিজ ইকোনমিক জোন হচ্ছে, ইন্ডিয়ান ইকোনমিক জোন হচ্ছে, অনেক প্রাইভেট ইকোনমিক জোন হচ্ছে। বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত লাইসেন্স হয়েছে ১২টির এবং প্রাথমিক লাইসেন্স হয়েছে আরো নয়টির। মোট ২১টি বেসরকারি ইকোনমিক জোন, এর মধ্যে সিটিসহ ১১টি উৎপাদনে আছে।

আমরা বিসিক করেছি, ইপিজেড করেছি, বিওআই করেছি, বেসরকারি ইপিজেড করেছি। আমরা বারবার রকম বদলাচ্ছি, প্রক্রিয়া বদলাচ্ছি, কিন্তু মূল লক্ষ্য একটাই, শিল্পায়ন, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, অ্যাডভান্স প্রযুক্তি নিয়ে আসা। হ্যাঁ, একটি বিষয়ে কথা হতে পারে, এতগুলো অথিরিটি প্রয়োজন ছিল কিনা। সরকারের এতগুলো অথিরিটি না করে, ব্যয় বৃদ্ধি না করে, কীভাবে এক ছাতার নিচে ভিন্ন ভিন্ন মডেলের শিল্পাঞ্চল গঠন করা যায়, সেটি দেখা যেত। এখনো করা যায় কিনা ভাবতে হবে। 


ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) নিশ্চিত করার জন্য সব অথরিটিকে এক ছাতার নিচে আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন কিনা?

ওএসএসের বিষয়টা আমরা জাপানেও দেখেছি। দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ীদের মধ্যে সব সেবা এক জায়গায় আনার দাবি দীর্ঘদিনের। সমস্যা সমাধানে বেজা একটা আইনের খসড়া তৈরি করে বাংলাদেশ ওয়ান স্টপ সার্ভিস অ্যাক্ট নামে। এটি ২০১৮ সালে আইনে পরিণত হয়। ভালো উদ্যোগের ব্যাপারে সবাই বলে যে এত ভালো উদ্যোগ আর হয় না। কিন্তু যখনই নিজস্ব, ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার বিষয় আসে, তখনই এটা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাটা উপভোগ করার জায়গাটায় যে উদারতা বিনিয়োগকারীকে সেবার মানসিকতা থাকতে হবে সেটার কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। তাই ওএসএস অ্যাক্ট হয়েছে, ওএসএস সেন্টার হয়েছে, কিন্তু নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের সেবা ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সেবাগুলো সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়ে গেছে। অথচ এটা একবারেই দূর হয়ে যাওয়া উচিত। আমরা এভাবে চেষ্টা করেছিলাম সব বিনিয়োগকারীর জন্য। বিদ্যুৎ, পরিবেশ এত অথরিটি না। একটি নির্দেশনাই যথেষ্ট। সেটি অবশ্যই ওএসএস এবং এক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। কিন্তু আমাদের এখানে যতটা সেবা, বলা যায় যে তার কাছাকাছি অথরিটি আছে। এত লোকের কাছে গিয়ে বিনিয়োগকারী মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ঘুরবেন আর আমরা এদিকে বিদেশী বিনিয়োগ আশা করব, তা হতে পারে না। তার বিনিয়োগের অনেক জায়গা আছে, পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে। কেন সে জমি পেতে এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করবে, কেন রেজিস্ট্রেশন বা ট্যাক্স পেমেন্টের ক্ষেত্রে এত দেরি হবে অথবা কোনো মামলা হলে কেন সেটি নিষ্পত্তি ক্ষেত্রে বিলম্ব হবে। এসব মৌলিক কাজ আমাদের সমাধান করতে হবে। এগুলো হলেই বিদেশী বিনিয়োগ গতি পাবে। 

সক্রিয় বেসরকারি গ্রুপগুলোর মধ্যে সিটি গ্রুপের অর্থনৈতিক অঞ্চল অন্যতম। এখন পর্যন্ত এগুলোয় বিনিয়োগ বাস্তবায়ন সম্পর্কে জানতে চাই।

সিটি গ্রুপ মোট তিনটা বেসরকারি ইকোনমিক জোনের ডেভেলপার। মেঘনা গ্রুপও তিনটা ইকোনমিক জোনের ডেভেলপার, বসুন্ধরা গ্রুপ আছে, আরো অনেক গ্রুপ আছে। বাংলাদেশ অনেক ভালো করেছে এফডিআই আকর্ষণের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোন। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে ভোগ্যপণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সিটি গ্রুপের খুব সুনাম আছে। সয়াবিন তেল হোক বা আটা, ময়দা, চিনি অথবা পশুখাদ্য, মোট চাহিদার ৩০-৪০ শতাংশ একাই সরবরাহ করে থাকে। বলা যায় ছয় কোটি মানুষের চাহিদা একাই পূরণ করে সিটি গ্রুপ। খাতের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি ইকোনমিক জোনে আছে। সিটি ইকোনমিক জোনে তা পুরোপুরি সংযুক্ত। প্রথম যেটা লাইসেন্স পায় সেখানে সবগুলোয় সিটি গ্রুপের নিজস্ব বিনিয়োগ।

পরবর্তী সময়ে হোসেন্দী প্রাইভেট ইকোনমিক জোনে ঢাকা সুগার মিল, পেপার মিল, এলপিজি হয়েছে, এখন সিমেন্ট মিল হচ্ছে। সেখানে শিপ বিল্ডিং হয়েছে। জায়গায় কিছু জয়েন্টভেঞ্চার হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ আছে। এরই মধ্যে একটা কারখানা চালু আছে আর একটি শিপ বিল্ডিং চালু হয়েছে। আমরা চলতি বছরে আশা করছি আরো পাঁচটা ইউনিট কমপক্ষে চালু হবে। এখানে বিদেশী বিনিয়োগ জয়েন্টভেঞ্চার হিসেবে আছে। আর নতুন ইকোনমিক জোনের প্রাথমিক লাইসেন্স পেয়েছে। আমরা আশা করছি তারা শিগগিরই ফাইনাল লাইসেন্স পাবে। ফাইনাল লাইসেন্স পেলে সেখানেও শিল্প স্থাপন প্রক্রিয়া শুরু হবে। এছাড়া হাই-টেক পার্ক অথরিটির একটা লাইসেন্স তাদের আছে। যাত্রাবাড়ীর খুব কাছে, ডেমরা রোডে। সেখানে প্রায় ১০০ একর জমিতে হাই-টেক পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে অনেক বড় ফুটপ্রিন্ট রাখতে যাচ্ছে সিটি গ্রুপ। তারা অনেক বৈচিত্র্যও আনছে। সিমেন্ট-হাই-টেকপার্কসহ আরো নতুন নতুন অনেক খাতে তারা বিনিয়োগ করছে। আমরা আশা করছি, ভবিষ্যতে তারা ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতেও আসবে। 

সফল বিনিয়োগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যদি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ভাবা হয়, একটি গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি হচ্ছে মেঘনা। তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

বাংলাদেশের বিশেষ করে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে দুটি গ্রুপ বেশি এগিয়েছে তাদের একটি সিটি গ্রুপ আরেকটি মেঘনা গ্রুপ। মেঘনা গ্রুপও প্রচুর খাদ্যপণ্য উৎপাদন করে থাকে। তবে তারা একটা বৈচিত্র্য এনেছে বেজার উৎসাহে। সেটি হচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগে ১১টি কারখানা হয়েছে। সেখানে ইউরোপীয়, অস্ট্রেলিয়া, ইন্ডিয়ান, জাপানিজ বিনিয়োগ রয়েছে। এটি ইকোনমিক জোন বা বাংলাদেশের জন্য একটা ভালো উদাহরণ তৈরি হয়েছে।

সিটি গ্রুপের অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নতুন পরিকল্পনা কী?

সিটি গ্রুপের হোসেন্দী বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মধ্যে অনেক ভালো এবং বড় বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দুটি ইউনিট এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া পেপার মিলের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পেপার মিল হতে যাচ্ছে। সুগার মিলও বছর উৎপাদনে যাচ্ছে। এটিও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুগার মিল হতে যাচ্ছে। এগুলো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বাড়তি চাহিদা, বাড়তি জনবলের চাহিদা, ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের ফলে বা সমধারার যে ইন্ডাস্ট্রিগুলো আছে সেগুলোর চাহিদা, যেমন কোমল পানীয়, ফার্মাসিউটিক্যাল এগুলোয় চিনি লাগে, এগুলোর চাহিদা পূরণ করার ক্ষেত্রে হোসেন্দী বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। আমাদের এনার্জি নিয়ে বড় সমস্যা আছে, সেখানে এলপিজিতে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে। পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে জাহাজ যেহেতু ভালো ভূমিকা রাখে, তাই সেখানে বড় আকারের শিপ বিল্ডিং হচ্ছে। আমরা আশা করছি, এখানে বড় সিমেন্ট কারখানা হবে। আপাতত হয়তো ইন্ডাস্ট্রিতে সিমেন্টের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি আছে চাহিদার চেয়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেহেতু এগোচ্ছে, গত ১৫ বছর ধরেই জিডিপির গ্রোথ রেট ভালো অবস্থায় রয়েছে। যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয় তাহলে আরো ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি আরো গতি পাবে। নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদাও বাড়বে। সে বাড়তি চাহিদা ভবিষ্যতে দ্বিগুণ হতে পারে। সেখানে খুবই বড় একটা সিমেন্ট কারখানা হচ্ছে। আমরা আশা করছি দুই বছরের মধ্যে উৎপাদনে যাবে।

হোসেন্দী ইকোনমিক জোনে দুই কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে মেঘনা নদী। এটি খুবই সম্ভাবনাময়। এছাড়া পুবগাঁও যে ইকোনমিক জোন লাইসেন্স পেয়েছে শীতলক্ষ্যার পাড়ে, সেখানে আমাদের লক্ষ্য থাকবে দেশীয় বাজার এবং বিদেশী বাজারকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। দেশীয় বাজারে সিটি গ্রুপ অনেক কাজ করেছে। এবার রফতানি সংশ্লিষ্ট কিছু কারখানা আমরা পুবগাঁও ইকোনমিক জোনে দেখতে চাই। 

একসময় নীতি প্রণয়ন আর এখন ব্যক্তি খাতের বড় করপোরেট গ্রুপের মাধ্যমে বাস্তবায়ন, দুই প্রেক্ষাপটেরই চ্যালেঞ্জগুলো জানতে চাই।

কোনো চ্যালেঞ্জ আমরা সেভাবে দেখি না, কারণ প্রুতিটি চ্যালেঞ্জই একেকটি কাজ করার সুযোগ। সমস্যা যদি না থাকে, বিশেষ করে উচ্চপর্যায়ে, তাদের কাজ করার কোনো প্রয়োজনই নাই। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পর, বেসরকারিতে কাজ করার যে অভিজ্ঞতা, সেখান থেকে বলতে পারি আসলে চ্যালেঞ্জ জিনিসটা সব জায়গাতেই আছে। সরকারিতেও আছে সেটি ভিন্ন ফর্মে। বেসরকারি খাতে আসল চিত্রটা আরো বেশি অনুভব করা যায়। এবং বাধাগুলো আরো ভালোভাবে অনুভব করা যায়। আমাদের বিদ্যমান পরিস্থিতি, ওয়ে অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সেটি শিল্প স্থাপনে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাস্তবে কতটুকু সুবিধাজনক পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করছে এবং কোথায় কোথায় কাজ করা দরকার আরো সেটি ভালোভাবে অনুভব করা যায়।

অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে নীতিবৈষম্য একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, আপনার মূল্যায়ন কী?

অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া মূলত শুরু হয় রফতানি খাতকে প্রমোট করার জন্য। চীনে যখন ইপিজেড হয় বা এসিজেড হয়, তখন কিন্তু আজকের চীন ছিল না। তখন তার অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক খারাপ ছিল। গত বছর ভিয়েতনাম ৩৭১ বিলিয়ন ডলার রফতানি করেছে। যখন সেখানে প্রথম এসিজেড তৈরি হয়, তখন রফতানিতে তার উল্লেখ করার মতো কিছুই ছিল না। বাংলাদেশের কাছাকাছি অর্থনীতির একটি দেশ ছিল। বাংলাদেশ এখন ৫২ বিলিয়ন ডলার রফতানি করে আর ভিয়েতনাম করে ৩৭১ বিলিয়ন। এটি শুধু তাদের ইপিজেড এবং এসিজেডের কারণে সম্ভব হয়েছে। তবে ইপিজেড, এসিজেড কখনোই স্থায়ী সমাধান নয়। এগুলো বিশেষ সুবিধা দেয়। বিশেষ করে বিনিয়োগ সৃষ্টি এবং অনেক বড় একটি অংশের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আবশ্যিকভাবে একটি বৈষম্য তৈরি হয়। এসিজেড, ইপিজেডের বাইরে যে কারখানা হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই একটা বৈষম্য তৈরি হয়। অনেকেই মনে করে ট্যাক্স বা ডিউটির ক্ষেত্রে বা বন্ড সুবিধার ক্ষেত্রে অথবা শুধু রাস্তাঘাটের ক্ষেত্রে বৈষম্য হয়। কিন্তু না, আরো বৈষম্য আছে। যেমন কেউ এখন একটা শিল্প করতে চাইছে। কিন্তু জমি দরকার। সরকার থেকে মাঝে মাঝে ঘোষণা থাকে কৃষি জমিতে করা যাবে না। বাংলাদেশে কৃষি হয় না, এমন জমি নেই বললেই চলে। তাহলে শিল্প তৈরির জন্য জমি আসবে কোথা থেকে। সরকারি সংস্থাগুলোর আবার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে। কতটুকু জমি তারা শিল্পের জন্য দিতে পারবে, তারাই বা কতটুকু সুযোগ পাচ্ছে শিল্পের জন্য বিশাল ল্যান্ড ব্যাংক উন্নয়নে? আমরা দেখেছি, বেজা ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার একর জমি নেয়। তার মধ্যে ৩৫ হাজার একরের মতো জমি শিল্প হওয়ার উপযুক্ত। বাকি ২৫ হাজার একরের মতো জমিতে শিল্প-কারখানা হবে না। জমি যদি না পায়, তারা যে অসুবিধা ভোগ করছে, এসিজেডে বা ইপিজেডে যারা জমি পাচ্ছে, তারা যে সুবিধাগুলো পাচ্ছে, বৈষম্য বিশাল। এখানে তো বিদ্যুতের যে সুবিধা তুলনামূলক সহজেই পাচ্ছে। গ্যাসলাইন থাকলে সেটি পাচ্ছে, রাস্তাঘাটগুলো পাচ্ছে।

এছাড়া পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা সংস্থাগুলো দেখছে যে ইপিজেড একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। তারা এটাকে ভালো প্রোটেকশন দেয় বা ভালো সেবা দেয়। বেসরকারি শিল্পের ক্ষেত্রে সে সহায়তাটা সেভাবে তারা পায় না। এজন্য এসিজেড বা ইপিজেডের বাইরে কারখানা করা দিন দিন কঠিন হবে। তাদের পরিস্থিতি চিন্তা করে যারা বড় বড় বিনিয়োগকারী তাদের জন্য সরকারের কিছু রিলিফ মেজার নিয়ে আসা খুব বেশি জরুরি। চাকরির বাজারে প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ যুবক যোগ হচ্ছে তাদের যদি আমরা কর্ম দিতে না পারি, তাহলে তো পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে যাবে। 

যে দেশগুলো ইপিজেড বা এসিজেডের ভেতর-বাইরে সুবিধাগুলো একই রকম করতে পেরেছে, সেখানে এসিজেড বা ইপিজেডের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের এখানে এখনো আমরা শিল্পায়নের যে স্তরে আছি, আমি বলব আমরা অনেক পিছিয়ে। 

বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্ভাবনা ফিকে হয়ে আসার কোনো শঙ্কা দেখেন?

সব সমস্যাই সুযোগের তৈরি করে। এখন ইউক্রেন যুদ্ধের কথা, কভিডের কথা যদি বলি। একই সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার যে সম্পর্ক বা যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চীনের যে সম্পর্ক এর কারণে ওই দেশগুলোর অনেক বিনিয়োগ চীন থেকে সরে যাচ্ছে। ভিয়েতনাম সুযোগটা ভালো করেই নিতে পেরেছে। আমাদেরও যোগ্যতার জায়গাটুকু নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের যে এজেন্সিগুলো ভূমি থেকে শুরু করে, পানি বা বিদ্যুৎ সেবাগুলো দেবে তাদের সরকারের দিক থেকে ওই ওরিয়েন্টেশন দেয়া দরকার। তাদের বোঝাতে হবে, তোমার কাজ জনগণকে সেবা দেয়া, ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে সেবা দেয়া। অথরিটি আমরা নাম নিয়ে বসে থাকি, রেগুলেটর হয়ে বসে থাকি, রকম না। এটা ডি রেগুলেট করতে হবে। আমাদেরকে মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিযোগিতার জায়গা উন্মুক্ত রাখতে হবে। ব্যবসায়ী হোক বা অন্য কেউ, কারো যেন একক আধিপত্য না থাকে। সেটা যদি আমরা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে এখানে অনেক বড় বড় শিল্প এবং বড় উদ্যোক্তা ভবিষ্যতে তৈরি হবে। 

জ্বালানি অনিশ্চয়তাসহ অপ্রতুল পরিষেবা, এসব বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ আসলে কতটুকু সম্ভব হচ্ছে?

দেশীয় বিনিয়োগের হয়তো কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সে ইন্ডাস্ট্রি করবে। কিন্তু বিদেশী বিনিয়োগকারীর কি বাধ্যবাধকতা আছে, যে বাংলাদেশেই আসতে হবে? সে ভিয়েতনামে যেতে পারে, ইন্ডিয়া, কম্বোডিয়ায় যেতে পারে। বিনিয়োগের জন্য শুধু নির্দিষ্ট একটা ইস্যু প্রযোজ্য না। শুধু অ্যান্ড অর্ডার বা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বা এনার্জির নিশ্চয়তা বা গভর্নমেন্ট ইস্যু। কোনো একটা বিষয় না, সব বিষয় মিলেই বিদেশীরা সিদ্ধান্ত নেয়। তাই আমাদের পুরো পরিবেশ পাল্টানোর জন্য কাজ করতে হবে। ব্যবসা করার যে সহজ পরিবেশ, দুর্নীতিমুক্ত, ঝামেলামুক্তভাবে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এখানে আমরা যারা আছি বিনিয়োগকারীরা যেন তাদের বন্ধু হিসেবে মনে করে। পরিবেশ যদি নিশ্চিত করতে পারি তাহলে বিদেশী বিনিয়োগ পাওয়া কঠিন নয়। বাংলাদেশে জাপানিজ ইকোনমিক জোন (এসিজেড) যেটা হয়েছে সেটি তার উদাহরণ। ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন চার দেশের মধ্যে জাপান বাংলাদেশকে পছন্দ করছে।

 

শ্রুতলিখন: তোফাজ্জল হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন