মোটরসাইকেল নিয়ে দ্বিমুখী নীতি

উচ্চক্ষমতার ইঞ্জিন অনুমোদন চলাচল নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ!

শামীম রাহমান

দেশে গত বছর পাঁচ লাখের বেশি মোটরসাইকেল নিবন্ধন দিয়েছে বিআরটিএ ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা প্রায় ৫৭ লাখ। এর মধ্যে ৪১ লাখই মোটরসাইকেল। শুধু ২০২২ সালেই পাঁচ লাখের বেশি মোটরসাইকেল নিবন্ধন দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ক্রমবর্ধমান মোটরসাইকেলের সংখ্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যখন উদ্বিগ্ন, তখন বাহনটি নিয়ে দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করেছে সড়ক পরিবহন মহাসড়ক বিভাগ। একদিকে ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচল অনুমোদন দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে সড়ক-মহাসড়কে বাহনটির চলাচল নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক পরিবহন সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভাগটি।

বর্তমানে দেশে চলাচলের জন্য নিবন্ধনের অনুমতি আছে ১৬৫ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেলের। কয়েক বছর ধরে সিসিসীমা একেবারে তুলে দেয়া অথবা ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে মোটরসাইকেল উৎপাদক বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই ধারাবাহিকতায় ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে দেশে উৎপাদিত এসব উচ্চক্ষমতার ইঞ্জিনবিশিষ্ট মোটরসাইকেল কেবল রফতানির অনুমতি দেয়া হয়েছে।

উৎপাদক বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চাইছে, বাংলাদেশেও এসব মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেয়া হোক। বিষয়টি নিয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠান সরকারকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবও দিয়েছে। এসব প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে গত সপ্তাহে একটি বৈঠক করেছে সড়ক পরিবহন মহাসড়ক বিভাগ। ওই সভায় দেশে ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে মহাসড়ক বিভাগের একটি সূত্র। সূত্রটি জানিয়েছে, ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেলের অনুমোদন চূড়ান্ত করতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আরেকটি সভা আহ্বানের পরিকল্পনা করেছে মহাসড়ক বিভাগ।

যদিও ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচল অনুমোদনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী।

দেশে উচ্চসিসির মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দিতে চলমান উদ্যোগের মধ্যেই মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালা-২০২৩ নামে একটি নীতিমালা তৈরির কাজও শুরু করেছে সড়ক পরিবহন মহাসড়ক বিভাগ। মূলত সড়ক নিরাপত্তা অবস্থার উন্নতির জন্য মোটরসাইকেল চলাচল নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা।

এরই মধ্যে নীতিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে শহরের মধ্যে চলাচলের জন্য মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতি নির্ধারণ করা হয়েছে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। খসড়া নীতিমালায় স্কুটি মোটরসাইকেল ব্যবহার বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, স্কুটি মোটরসাইকেল জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে উৎপাদন, সংযোজন আমদানি পর্যায়ে শুল্ক সুবিধা প্রদান এবং স্পোর্টি মোটরসাইকেলের শুল্ক বাড়ানো যেতে পারে।

অন্যদিকে মহাসড়কে চলাচলের জন্য মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনক্ষমতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। মহাসড়কে কেবল সিরিজ বা সর্বনিম্ন ১২৬ সিসি ইঞ্জিন বা সমতুল্য ইঞ্জিনক্ষমতার মোটরসাইকেল চালানো যাবে। এতে বলা হয়েছে, মহাসড়কে চলাচলের জন্য মোটরসাইকেলে অ্যান্টি-লক ব্রেকিং সিস্টেম বা এবিএস থাকতে হবে। চালক কোনো আরোহী বহন করতে পারবে না। চালককে চেস্ট গার্ড, নি গার্ড, এলবো গার্ড, গোড়ালি ঢাকা জুতা বা কেডস, সম্পূর্ণ আঙুল ঢাকা গ্লাভস এবং ফুলপ্যান্ট ফুলশার্ট ব্যবহার করতে হবে। রাতে মোটরসাইকেল চালানোর সময় রেট্রোরিফ্লেক্টিভ জ্যাকেট ব্যবহার করতে হবে। মোটরসাইকেল বাম লেনে চালাতে হবে। সঙ্গে ফার্স্ট এইড কিট বহন করতে হবে।

আরো বলা হয়েছে, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, দুর্গা পূজা ইত্যাদি পার্বণকালীন আগে পরে মোট ১০ দিন জাতীয় আঞ্চলিক মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানো যাবে না।

যদিও সড়ক পরিবহন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল জানিয়েছেন, আসন্ন ঈদুল ফিতরে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলে বিধিনিষেধ থাকছে না। শুধু পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চালানো যাবে না। গতকাল বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে ঈদ উপলক্ষে সড়কপথে যাত্রীদের যাতায়াত নিরাপদ করার জন্য এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন তিনি।

কয়েক বছর ধরেই দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। বিআরটিএ থেকে তৈরি করা গত মার্চের সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাসে সব মিলিয়ে ৫৩৬টি যানবাহন দুর্ঘটনায় পড়ে। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল ১০৩। মার্চে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪১৫ জনের ৮৭ জনই ছিলেন মোটরসাইকেল চালক আরোহী।

এমন প্রেক্ষাপটে উচ্চইঞ্জিন সক্ষমতার মোটরসাইকেল চলাচল অনুমোদন কিংবা মোটরসাইকেল চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপের বদলে বাহনটির ব্যবহার সীমিত করার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক . সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের সড়কে শৃঙ্খলা নিরাপত্তার জন্য বর্তমানে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে মোটরসাইকেল। পৃথিবীর অনেক দেশই এখন মোটরসাইকেল ব্যবহার সীমিত করে ফেলছে। বাংলাদেশেরও সে পথে অগ্রসর হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন