পায়রায় এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ

চূড়ান্ত চুক্তির কাছাকাছি এক্সিলারেট এনার্জি

আবু তাহের

দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহে কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান দুটি টার্মিনাল রয়েছে। এগুলোর দৈনিক সক্ষমতা এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। দেশে গ্যাসের সংকট সমাধানে বিদেশ থেকে আরো বেশি এলএনজি সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা। তাই নতুন করে আরো দুটি ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত সরকারের, যার একটি নির্মাণ করবে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি। এরই মধ্যে কোম্পানিটির প্রস্তাব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছে পেট্রোবাংলা। মাসখানেকের মধ্যেই বিষয়ে প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষর হবে বলে নিশ্চিত করেছে সংস্থাটির একটি সূত্র।

বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দেশের গভীর সমুদ্র এলাকায় ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণে দুটি কোম্পানি অনেক আগেই প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু নানা কারণেই প্রস্তাব নিয়ে আর এগোয়নি সরকার। বর্তমানে এলএনজি সরবরাহ বাড়াতে আরো এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সক্ষমতার দুটি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর একটি হবে পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায়, অন্যটি মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে। বতর্মানে যে দুটি কোম্পানি বিদ্যমান টার্মিনাল পরিচালনা করছে তারাই মূলত নতুন দুটি টার্মিনাল নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী কামরুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তিতে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে সরকার। এখন তাদের সঙ্গে টার্মশিট এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হবে। পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে প্রস্তাবের বিষয়ে যাচাই-বাছাই শেষ হয়েছে। এখন এটি আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে ভেটিংয়ের জন্য। কোনো ধরনের আইনি জটিলতা রয়েছে কিনা, সে বিষয়ের ওপর সেখানে মতামত নেয়া হবে। 

টার্মশিট এগ্রিমেন্ট মূলত যেকোনো চুক্তির প্রাথমিক পদক্ষেপ। অর্থাৎ প্রস্তাবের প্রাথমিক দিকগুলো বিশ্লেষণ করে তৈরি এক ধরনের খসড়া। চুক্তির শর্তাবলি স্বাক্ষরের পর চূড়ান্ত চুক্তির পক্ষে অগ্রগতি হয়।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে এক্সিলারেট এনার্জির যে এলএনজি টার্মিনালটি রয়েছে সেটির দৈনিক সরবরাহ সক্ষমতা ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে পায়রা এলাকায় বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সেখানে এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ফলে ওই এলাকায় ব্যাপক হারে গ্যাসের চাহিদা তৈরি হবে। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই মার্কিন কোম্পানিটি পায়রায় এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে আগ্রহ দেখায়।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বলেছিলেন, পায়রায় ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণের জন্য এক্সিলারেটের প্রস্তাব এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। খুব দ্রুতই একটি টার্মশিট স্বাক্ষরিত হবে। এক-দেড় মাসের মধ্যে -সংক্রান্ত চুক্তি হয়ে গেলে আমরা চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের দিকে এগোব। 

পেট্রোবাংলার অন্য এক সূত্র বলছে, এক্সিলারেটের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই সিদ্ধান্ত আসতে পারে। আর সেটি হলে টার্মিনাল নির্মাণ শেষ করে অপারেশনে যেতে সময় লাগবে কমপক্ষে আড়াই বছর। সে অনুযায়ী, চুক্তিটি যদি সঠিক সময়েও বাস্তবায়ন হয়, সেক্ষেত্রে এক্সিলারেটের টার্মিনাল নির্মাণকাজ শেষ হতে ২০২৬ সালের শেষ পর্যন্ত লেগে যাবে।

মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে পেট্রোবাংলার সঙ্গে এক্সিলারেট এনার্জি চুক্তি করেছিল ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই। নির্মাণ শেষে ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট গ্যাস সরবরাহ শুরু করে কোম্পানিটি। ১৫ বছর মেয়াদি টার্মিনাল দিয়ে গ্যাস সরবরাহের চুক্তি রয়েছে ২০৩২ সাল পর্যন্ত। তবে এক্সিলারেট এনার্জি সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে চুক্তির মেয়াদ ২০৩৮ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এলএনজি টার্মিনালের মেয়াদ বাড়ানোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

একই প্রযুক্তি মেনে স্থানীয় জ্বালানি খাতের কোম্পানি সামিট গ্রুপ মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল চুক্তি সই করে। গ্যাস সরবরাহ শুরু করে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল। ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার টার্মিনালের মেয়াদ রয়েছে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত। নতুন করে আরো একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে সামিট। ওই টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়টি নিয়েও দুই পক্ষের মধ্যে পুনরায় আলোচনা শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এটির বিষয়েও সিদ্ধান্ত আসবে বলে জানা গেছে।

দেশে বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। যদিও আমদানীকৃত এলএনজি স্থানীয় সরবরাহ দিয়ে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি আগামী তিন বছরেও এর চেয়ে বেশি গ্যাস গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হবে না বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। স্থানীয় গ্রিড লাইনের বিদ্যমান সক্ষমতা এবং এলএনজি সক্ষমতা না থাকাই এর বড় কারণ।

দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি অনুযায়ী, কাতার ওমান থেকে বর্তমানে সাড়ে তিন মিলিয়ন টন বার্ষিক এলএনজি আমদানি চুক্তি রয়েছে। যদিও আড়াই মিলিয়ন টনের বেশি গ্যাস আনা যাচ্ছে না। এদিকে স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ (মিলিয়ন মেট্রিক ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) এলএনজির দাম নেমে এসেছে সাড়ে ১২ ডলারে, যা তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে। কিন্তু তা কিনে দেশে এনে সরবরাহ করার মতো সক্ষমতা নেই বর্তমানে। ফলে অবকাঠামোগত সংকটে বিশ্ববাজারে সস্তা এলএনজি কেনার সুযোগ দেশ নিতে পারছে না বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। কারণেই দ্রুত গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা বাড়াতে চায় সরকার।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন