শিল্প খাতে আমদানি পর্যায়ে আগাম কর প্রত্যাহারের দাবি ব্যবসায়ীদের

আগাম করসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করুক এনবিআর

আসন্ন বাজেটে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে এক বৈঠকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) শিল্প খাতে আমদানি পর্যায়ে আগাম কর প্রত্যাহারের দাবি করেছে। এর আগের বছরগুলোতেও একই দাবি করে আসছেন তারা।  ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আগাম কর সমন্বয়ের অপারগতা এবং উৎসে কর্তিত মূসক রিফান্ড নিতে না পারার কারণে উৎপাদন-পরবর্তী সমন্বয় চেইন ভেঙে পড়েছে ও মূলধন দায় বেড়ে যাচ্ছে। আগাম কর রাজস্ব ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, যা বিশ্বের প্রায় দেশেই অনুসরণ করা হয়। বাজেট বাস্তবায়নকে মসৃণ করতেই এটি প্রয়োজন। অর্থ ফেরত পাওয়াসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন এবং প্রক্রিয়াটি সহজীকরণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দ্রত মনোযোগ দিতে হবে। 

আমদানি পর্যায়ে পরিশোধ করা আগাম কর ফেরত পাচ্ছেন না শিল্প মালিকরা। ভ্যাট আইনে ছয় মাসের মধ্যে রিফান্ড দেয়ার বিধান থাকলেও মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ভিন্ন। সবচেয়ে বেশি জটিলতার মধ্যে পড়েছে নাকি ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান। নতুন ভ্যাট আইনে বলা হয়েছে, প্রত্যেক নিবন্ধিত আমদানিকারক নির্ধারিত পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট কর মেয়াদে মূসক দাখিলপত্রে পরিশোধিত আগাম করের সমপরিমাণ অর্থ সমন্বয় করতে পারবেন। যারা নিবন্ধিত নন, তারা কমিশনারের কাছে আগাম কর ফেরত পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলছেন, আইনেই আছে, আগাম পরিশোধের ছয় মাস পর তা ফেরত দেয়া হবে। এ হিসাবে, জুলাইয়ে আমদানির বিপরীতে যে আগাম কর পরিশোধ করা হয়েছে, তা জানুয়ারিতে ফেরত পাওয়ার কথা। কিন্তু এখনো টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেন। এর বিপরীতে মোটা অংকের সুদ গুনতে হয়। এত বিপুল অংকের টাকা সরকারের কাছে আটকে থাকার কারণে একদিকে সুদ বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা মূলধন সংকটে পড়েছেন। বাংলাদেশে টাকা ফেরতের প্রক্রিয়াটি জটিল। উদাহরণস্বরূপ নিট খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য গ্যাস-বিদ্যুৎ বিলের ভ্যাট ফেরত দেয়ার বিধান আছে। কিন্তু এ টাকা ফেরত পেতে এত হয়রানি হতে হয় যে একপর্যায়ে ব্যবসায়ীরা হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এ কারণে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ বাড়ছে বলে অভিযোগ উঠছে। আর শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমছে। 

বিশ্বের অনেক দেশে আগাম বা অগ্রিম কর দেয়ার বিধান চালু রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ বিধান রয়েছে। তবে দেশগুলোর রিফান্ড ব্যবস্থাও শক্তিশালী এবং ডিজিটালাইজড। বাংলাদেশেও আগাম কর ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। ব্যবসায়ীদের হয়রানি রোধ ও অর্থ আটকে থাকার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব এনবিআরের রিফান্ড প্রক্রিয়া সহজ করা দরকার। নইলে প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ও হয়রানি বাড়তে থাকবে। বিশেষ করে ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের এ বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত রাখা যেতে পারে। উপরন্তু আগাম কর নেয়ার পর পণ্য আসার এক মাসের মধ্যে সেটি ফেরত দেয়ার বিধান করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হয়রানি এবং কর ফাঁকির প্রবণতা রোধে পুরো প্রক্রিয়াটির ডিজিটালাইজেশন জরুরি। অভিযোগ মিলছে, অনেক ব্যবসায়ী পণ্য আমদানির পর আর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। অতিরিক্ত কর এড়াতেই এমন প্রবণতা বলে খবর মিলছে। অগ্রিম আয়কর নিয়ে প্রায় সব বড় ও বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ঝামেলায় আছে। আয়কর অধ্যাদেশে নির্দিষ্ট সময়ে অগ্রিম আয়কর সমন্বয় কিংবা ফেরতের নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ না থাকায় ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, যা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। অগ্রিম আয়কর এখন পরোক্ষ করে রূপান্তরিত হয়ে উদ্যোক্তাদের চলতি মূলধনে সংকট সৃষ্টি করছে। এতে ব্যবসা সচল রাখার জন্য বিকল্প উৎস থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে হচ্ছে। ফলে ব্যবসা করার ব্যয় কয়েক গুণ বাড়ছে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি বাড়ে, যা ভোক্তাসাধারণ, সার্বিক শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থীও বটে। 

আগাম কর রিফান্ডসংক্রান্ত জটিলতা অবসানে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে একটি আদেশ জারি করে এনবিআর। নির্দেশনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভ্যাট আইন ও বিধিমালার আওতায় প্রতি মাসে আমদানীকৃত পণ্যের বিপরীতে আদায়কৃত আগাম করে তথ্যাদি সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউজ বা শুল্ক স্টেশন ওই পণ্যের আমদানিকারক যেই মূসক কমিশনারেটে নিবন্ধিত সেই মূসক কমিশনারেটে পরবর্তী মাসের ৫ তারিখের মধ্যে প্রেরণ করবে। বৃহৎ করদাতা ইউনিট (মূসক) নিবন্ধন প্রদান করে না এবং এর অধিক্ষেত্র দেশব্যাপী। এ কারণে মূসকভুক্ত প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নম্বরসংবলিত তালিকা সংরক্ষণ করে। তাই এসব নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে আদায় করা আগাম করসংক্রান্ত তথ্য কাস্টম হাউজ বা শুল্ক স্টেশন পরবর্তী মাসের ৫ তারিখের মধ্যে বৃহৎ করদাতা ইউনিটে প্রেরণ করবে। এজন্য বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (মূসক) অধিক্ষেত্রভুক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা, নিবন্ধন নম্বরসহ হালনাগাদ তালিকা সব কাস্টম হাউজ ও শুল্ক স্টেশনে প্রেরণ করবে। প্রত্যেক মূসক কমিশনারেট কাস্টম হাউজ বা শুল্ক স্টেশন থেকে তার অধিক্ষেত্রে নিবন্ধিত এমন আমদানিকারক হতে আদায়কৃত আগাম করের তথ্য সংগ্রহ করে নিজ নিজ রাজস্ব বিবরণীতে প্রদর্শন করবে। সংশ্লিষ্ট মূসক কমিশনারেট ওই আইন ও বিধিমালার আওতায় যথাযথ পদ্ধতি ও আইনি বিধিবিধান অনুসরণ করে করদাতাদের অনুকূলে আগাম কর ফেরত প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। হতাশাজনক বিষয় হলো, গত তিন বছরে এসব নির্দেশনার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। 

আমদানির ওপর আগাম কর চালু হয়েছে এক দশক আগে। পণ্য আমদানি করার পর সেটি চিহ্নিত করতে এনবিআরকে বেগ পেতে হতো সে সময়ে। রাজস্ব আহরণ দূরে থাক পণ্য চিহ্নিত করাও কঠিন হয়ে পড়ত সরকারের পক্ষে। কী পরিমাণ পণ্য আনা হয়েছে সেটিও নিরূপণ করা যেত না। এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য আগাম করারোপের বিষয়টি সামনে আনা হয়। এতে রাজস্বও বাড়ে এবং আমদানি পণ্য চিহ্নিত করাও সহজ হয়ে ওঠে। মাঝে কর রেয়াত পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো জটিলতায় পড়ে যায়। তাদের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আটকে থাকছে, যা উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে তুলছে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রক্রিয়াটি নিয়ে আরো ভাবনা-চিন্তার অবকাশ রয়েছে। যেকোনো নিয়মের কিছু ভালো ও কিছু মন্দ দিক থাকে, কোনটি শক্তিশালী হবে সেটি নির্ভর করে বিধানটির প্রয়োগের ওপর। আগাম করসংক্রান্ত ব্যবসায়ীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে এতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা প্রয়োজন। 

আগাম করের প্রভাব পণ্যের দামের ওপর পড়ছে। এতে ভোক্তার দায়ও বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে প্রায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে প্রক্রিয়াটির সংস্কার এবং সহজীকরণ প্রয়োজন। এনবিআরের পাওনা হলে তা আদায়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা আইন আছে; আর ব্যবসায়ীরা পেলে তখন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই বা অনুসরণ করা হয় না বলে যে অভিযোগ মিলছে তা রাজস্ব ব্যবস্থার জন্য সুখকর নয়। এক দেশে দুই নীতি হতে পারে না। এছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস কমানোর জন্য এনবিআরকে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন