শহীদ মিনার

নভেরা আহমেদ তার প্রাপ্য সম্মান পাননি

নভেরা আহমেদ ছবি: নভেরা বিভুঁইয়ে স্বভূমে বই থেকে

বিস্মৃতির অতলে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া ভাস্কর নভেরা আহমেদকে নতুন করে সামনে নিয়ে আসতে দেশের একদল শিল্পানুরাগী উদ্যোগী হন নব্বইয়ের দশকে। তাদের মধ্যে অন্যতম লেখক ও শিল্পসমালোচক আনা ইসলাম। খুঁজে খুঁজে তিনিই প্রথম পৌঁছে যান প্যারিস প্রবাসী নভেরার দরজায়। তাকে নিয়ে লিখেছেন ‘‌নভেরা বিভুঁইয়ে স্বভূমে’ নামক গ্রন্থ। আজ ২৯ মার্চ নভেরা আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে প্রয়াত এ ভাস্কর ও শিল্পীকে নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার গ্রহণে রুহিনা ফেরদৌস

ভাস্কর নভেরা আহমেদ বিষয়ে আপনার আগ্রহের শুরু কবে থেকে এবং কেন?

১৯৭৬ সালে প্রথম ভাস্কর নভেরা আহমেদের কাজ দেখি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের পেছনে ভাঙা ইট-সুরকি, লতাগুল্মে ভরা জায়গাটা। জ্যামিতিক গঠনের কিছু খিলানাকৃতি আর বড় বড় মানকচু পাতার আড়ালে বসে থাকা এক নারীমূর্তি। এসব শিল্পকৃতি নভেরা নামে একজন মানবী ভাস্করেরআমার খালা জানিয়েছিলেন।

প্যারিসে নভেরা আহমেদকে কীভাবে খুঁজে পান?

মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ ১৯৭৪ সালে ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে প্যারিস আসেন। তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী . কামাল হোসেন নভেরা আহমেদের টেলিফোন নম্বর দিয়ে শিল্পী শাহাবুদ্দীনকে বলেছিলেন যোগাযোগ করতে। প্যারিসে নভেরা আহমেদের সঙ্গে কথা বা যোগাযোগ করতে পারেননি তিনি। আমি প্যারিস আসি ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে। তখন থেকেই জানি নভেরা আহমেদ প্যারিসে। শিল্পী শাহাবুদ্দিন ফোন করেও তাকে পাননি। ঠিকানাবিহীন নভেরার সন্ধানে বাংলাদেশ দূতাবাস, পোস্ট অফিসে মিনিটেল (একটি যান্ত্রিক মাধ্যম ছিল) ঘেঁটে সার্চ করেছি, নভেরার নাম লিখে। আলোকচিত্রী বা অন্য পেশায় যুক্ত নভেরা নামের বহু ব্যক্তি পেয়েছি। কিন্তু ভাস্কর নভেরাকে পাইনি।

এরপর কার মাধ্যমে জানেন যে তিনি প্যারিসের কোথায় আছেন?

প্যারিস দূতাবাসের একজন কর্মচারী আমাকে ঠিকানা দিয়েছিলেন। অথচ একজন কর্মকর্তার কাছে তার ঠিকানা জানতে চাইলে বলেছিলেন, ‘কোথাকার কোন নভেরা। আমাদের এসব মনে থাকে!’

ওই ঠিকানায় গিয়ে নভেরাকে পেলেন?

ঠিকানা পেয়েই গিয়েছিলাম। দিনটি ছিল শনিবার, ১৯৯৭ সালের অক্টোবরের এক শীতের সন্ধ্যা। নভেরার স্বামী গ্রেগোয়ার দ্য ব্রুনস ছিলেন দোকানে। নভেরা ছিলেন না। আমার নাম-পরিচয় জানাই। খুব আন্তরিক ছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, নভেরা কারো সঙ্গেই দেখা করেন না। তবে তিনি আমার কথা তাকে জানাবেন। ১৯৭৩ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত নভেরার কাজের প্রদর্শনীর ক্যাটালগ দিলেন। তারপর নিয়ম করে প্রতি শনিবার বিকালে যেতাম। অন্যদিন সম্ভব ছিল না। আমার দুই মেয়ে তখন স্কুলে পড়ত। ছুটির দিন বলে শনিবার যেতাম। নভেরাকে কেন্দ্র করে প্রচুর আলাপ হতো। গ্রেগোয়ার তার স্ত্রী সম্পর্কে সব তথ্য জানাতেন। এভাবেই ভাস্কর নভেরাকে পাওয়ার সংযোগ সেতু হয়ে উঠেছিলেন গ্রেগোয়ার, বলেছিলেন ধৈর্য ধরতে। ঠিক নভেরার দেখা পাবে। আমার কথা তিনি নভেরাকে বলেছেন।

তাহলে কবে দেখা হয়? তিনি আপনাকে কীভাবে গ্রহণ করেন? বাড়িতে কি তার কাজ বা ভাস্কর্য ছিল?

প্রথম দেখা ১৯৯৭ সালের অক্টোবরেই। হঠাৎ গিয়েছিলাম। তবে শনিবার নয়। আমার মেয়েদের স্কুল বন্ধ ছিল। প্রায় আড়াই বছর ধরে নভেরার দেখা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব। অপেক্ষায় আছি। মনে আছে, দোকানের ভেতর কালো শাড়ি পরিহিতা এক নারী দেয়ালে ঝোলানো ছবি দেখছিলেন। কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করি, ‘শুভসন্ধ্যা বলেই জানতে চাই—‘‌আপনি কী নভেরা?’ বলাই বাহুল্য, তিনি আমার নামের সঙ্গে পরিচিতি ছিলেন গ্রেগোয়ারের মাধ্যমে। ওই মুহূর্তে গ্রেগোয়ার উপস্থিত ছিলেন না। অসম্ভব ইমোশনাল ছিলাম। বহুকাঙ্ক্ষিত জিনিস পেলে যেমন হয়। আমাকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। সুস্থির হতে সময় লেগেছিল আমার। তারপর গ্রেগোয়ার আসার পর আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখো, কেমন ইমোশনাল হয়ে পড়েছে। এখন মনে হয় আমার অকৃত্রিম আগ্রহের বিষয়টিও তাকে স্পর্শ করেছিল কোনোভাবে। আর দোকানেও কোনো ক্রেতা বা তাদের বন্ধুবান্ধব ছিলেন না সে সময়। 

আমরা শুনেছি তার পছন্দের পোশাক-খাবার ইত্যাদি বিষয় আপনি খোঁজ নিতেন। আপনাদের কী নিয়ে বেশি আলাপ হতো? কখনো কি তাকে তার নিভৃত জীবন বেছে নেয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছেন?

এরপর প্রতি শনিবার বিকালে যেতাম নভেরার সঙ্গে দেখা করতে। আগে টেলিফোন করে বা দেখা হলে পরবর্তী দেখা করার দিনক্ষণ জেনে নিতাম। কখনো বলতেন, ‘‌তুমি কাগজে লিখে পাঠাবে দেখা করতে চাও। গ্রেগোয়ারের কাছে দেবে।’ নভেরা তখন প্যারিসেই থাকতেন। প্যারিস আর্ট এলাকা, দোকানের পাশেই। শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। ভাস্কর্য, ছবি আঁকা নিয়মিত করতেন। কথা বলতেন কম, শুনতেন বেশি। আমার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিতেন। অনেক সময় গ্রেগোয়ার কথা বলতেন নভেরার হয়ে। তথ্য বাদ গেলে নভেরা মৃদু হেসে বলে দিতেন। শীত-গ্রীষ্ম ১২ মাস তিনি শাড়ি পরতেন। পোশাক, খাবার, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্যচর্চা নানা বিষয়ে কথা হতো আমাদের। দেশী খাবার খুব পছন্দ করতেন। তাই বিরিয়ানি, রসমালাই, মাছ বা আলুর চপ বানিয়ে নিয়ে যেতাম। রসগোল্লা ছিল তার প্রিয়। আমি কিনে নিয়ে যেতাম তার জন্য। নভেরা কালো শাড়ি পড়তেন সবসময়ই। একবার আমার হাতের অতিসামান্য দুটো কাচের লাল-কালো বালা দেখে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘‌কোত্থেকে কিনেছি?’ শিশুদের পছন্দ করতেন। বলতেন আমার মেয়েদেরও সঙ্গে নিয়ে যেতে। আমার সঙ্গে মেয়েরা গেছে। আমার মেয়ের ‘‌চর্যাপদ’ নামের ব্যাখ্যা শুনে চর্যাগীতিকা পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ছিল তার আরাধনা। গীতাঞ্জলীর ফরাসি অনুবাদ অঁদ্রে জিদের করা L'ffande Lyrique পেয়ে খুশি হয়েছেন। ১৯৯৮-তে ঢাকায় যাওয়ার আগে বললাম, দেশে যাচ্ছি, আপনার জন্য কী আনব? বললেন, ‘‌রাজশাহী সিল্ক। সবুজ রঙের।’ সবুজটা ঠিক কী রকম হবে তাও দেখিয়ে দিলেন। বিভিন্ন বর্ণের কয়েকটি ব্লাইজ প্রয়োজন। তাই মাপমতো বানাতে একটি ব্লাউজও দিলেন। ঢাকা থেকে এনে দেয়া শাড়ি খুব পছন্দ করেছিলেন।

আপনি তো তাকে নিয়ে লিখেছেন, বই করেছেন। আপনার প্রকাশিত লেখা তাকে দেখিয়েছেন?

তাকে নিয়ে বই লেখার কথা বলতাম। তিনি সবসময় বলতেন, ‘আমি এমন কেউ নই, যাকে নিয়ে বই লেখা যায়। ভোরের কাগজ (২৪ এপ্রিল ১৯৯৮) সানন্দায় ( জুলাই ১৯৯৮) প্রকাশিত আমার লেখা তাকে দেখিয়েছি। অপ্রকাশিত আত্মপ্রতিকৃতির ছবি দেখে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কোথায় পেয়েছি?’ বলেছি, ক্যাটালগ থেকে। প্যারিসে তার শেষ প্রদর্শনীর (২০১৪) ক্যাটালগে প্রকাশিত আমার লেখা দেখিয়েছি। নভেরা ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য আমাকে অনেকগুলো ছবি দিয়েছিলেন, অপ্রকাশিত থাকবে এই শর্তে। সেসব ছবি অনেক বছর পর গ্রেগোয়ারের অনুমতি নিয়েই প্রকাশ করেছি। কারণ নভেরা তখন প্রয়াত।

আপনি কি নভেরা আহমেদকে বলেছিলেন যে বাংলাদেশে তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে?

ফেলে আসা সময় নিয়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশের শিল্পীদের সম্পর্কে আলাদা করে কোনো আগ্রহ প্রকাশ তিনি করেননি। তবে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল। দেশের কথা শুনতে চাইতেন।

নভেরা আহমেদের সঙ্গে আপনার শহীদ মিনার নিয়ে কী কথা হয়েছিল? শহীদ মিনারের মূল শিল্পী কে, তা আজও আমরা সমাধান করতে পারিনি। কেন বলে আপনি মনে করেন?

শহীদ মিনারের নকশা নভেরা আহমেদের করা প্রসঙ্গে তিনি সবসময় মুখর ছিলেন। এই একটি বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া দেখেছি। নির্মোহ, নির্লিপ্ত নভেরা। বলছিলেন, ‘হামিদ তো ফ্রেসকো পেইন্টিং শিখেছে। কোনোদিন স্থাপত্য বা ভাস্কর্য করেনি। সে কী করে শহীদ মিনারের নকশা করে... নভেরা আহমেদ তার মৃত্যুর ছয় মাস আগে দেয়া শেষ সাক্ষাৎকারেও বলেছেন, ‘হামিদ ভাস্কর নয়। সে কী করে ডিজাইন করে। আমি শহীদ মিনারের একটি ছোট মডেল করে দিয়েছিলাম। হামিদের কাছেই আমার করা ড্রয়িংসহ সব কাগজপত্র ছিল।

নভেরার মৃত্যুর ছয় মাস আগে শেষ সাক্ষাৎকারেও বলেছেন, শহীদ মিনারের নকশার স্থপতি তিনি। সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন ফ্রেঞ্চ-অস্ট্রেলিয়ান তথ্যচিত্র নির্মাতা ডিভিয়ান ভাগ। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমি ডিভিয়ান। এটিনভেরা বিভুঁইয়ে স্বভূমে বইয়ের প্রকাশনা উৎসবের দিন ঢাকা জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়েছিল।নভেরা তথ্যচিত্রটি বছর প্যারিসের মুজ্যে কে ব্রনলি ফ্রান্সের জাতীয় গ্রন্থাগার আর্কাইভের জন্য কিনে নিয়েছে।

আপনি যখন শিল্পী হামিদুর রহমানকে নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, নভেরা আহমেদ কি সরাসরি কোনো উত্তর দিয়েছিলেন?

হামিদুর রহমান ভালো বন্ধু। শহীদ মিনার করার সময় হামিদুর রহমান ছিলেন সাহায্যের জন্য। হামিদুর রহমানের বড় ভাই নাজির আহমেদের কথা বলতেন নভেরা। তিনি নভেরাকে ভালোবাসতেন। তার সঙ্গেই ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটসে ভর্তি হতে গিয়েছিলেন। এছাড়া বন্ধু সাংবাদিক এসএম আলীর কথা তিনি বলতেন প্রায়ই।

নভেরা আহমেদের সমকালীন বন্ধু যারাআমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, সৈয়দ জাহাঙ্গীরতারা যে পরবর্তী সময় তার বিষয়ে কথা বললেন না বা তাকে কেউ মনে করলেন না, তার কারণটা কী বলে আপনার মনে হয়? বন্ধুদের নিয়ে নভেরা আহমেদ কি কিছু বলেছিলেন?

তার সমসাময়িক সতীর্থরা প্রকাশ্যে নভেরার বিষয়ে বলেননি। কিন্তু শহীদ মিনার বিতর্কে আমার প্রশ্নের সরাসরি স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর দিয়েছেন। হামিদুর রহমান তাদেরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। হয়তো অপ্রিয় সত্য বলা থেকে বিরত থেকেছেন বা বিরাগভাজন হতে চাননি। হামিদুর রহমান প্রয়াত হয়েছেন ১৯৮৮ সালে। বেঁচে থাকলে তার প্রতিক্রিয়া বোঝা যেত। তবে ভাইকে ইতিহাসের নায়ক করতে চেয়েছেন সাইয়িদ আহমেদ। শিল্পী হামিদুর রহমানও ঢাকায় টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে চলচ্চিত্র প্রকাশনা দপ্তরের প্রামাণ্যচিত্রে শহীদ মিনার প্রসঙ্গে নভেরার কথা বলেননি। হামিদুর রহমান চিত্রকর ম্যুরালশিল্পী। লন্ডনে ফ্রেসকো পেইন্টিং অধ্যয়ন করেছেন। দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্র ছিল তার চর্চার পরিসর। ত্রিমাত্রিক মাধ্যমে তিনি কখনো কাজ করেননি। অধ্যয়ন অনুশীলনের অভিজ্ঞতা ছিল না। তার পক্ষে জ্যামিতি-ব্যাকরণ মেনে ত্রিমাত্রিক নকশা রূপায়ণ অসম্ভব। নভেরা চার বছর ভাস্কর্য বিষয়ে পড়াশোনা করে ডিপ্লোমা করেছেন ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটসে থেকে। তার পক্ষেই সম্ভব শহীদ মিনারের নকশা করা। শিল্পী আমিনুল ইসলাম, সৈয়দ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের রেকর্ড আমার কাছে রয়েছে। সৈয়দ জাহাঙ্গীর লিখিত বক্তব্যে স্পস্ট জানিয়েছেন, ‘শৈল্পিক বাস্তব নকশা রচনা নভেরার... কাজটি দেওয়া হয়েছিল হামিদের নামে এবং সরকারি দফতরে যাওয়া-আসা, টাকা-পয়সা উঠানো, হিসাব রাখা কাজগুলো সে করত, সম্ভবত এজন্যেই হামিদের নামটাই শহীদ মিনারের স্রষ্টা হিসেবে উচ্চারিত হয়। কিন্তু আসল নকশা নভেরারই তৈরি এবং পরিচর্যাও করা তারই।...ওই সময় আমি এবং আমার বন্ধু (আমার থেকে দুই বছরের সিনিয়র শিল্পী) আমিনুল ইসলাম প্রায়ই বিকালে আমরা যেতাম হামিদ আর নভেরার সঙ্গে আড্ডা দিতে। একদিন দেখলাম নভেরা কাদা-মাটি দিয়ে শহীদ মিনারের একটা মডেল তৈরি করছে। মাটির প্রশস্ত চত্বর আর বেশকিছু লম্বা সিঁড়ি সামনে। পেছনের দিকে গাছের ছোট ছোট ডাল দিয়ে, যা বর্তমানে সিমেন্টের খুঁটি আর লোহার রড দিয়ে তৈরি হয়েছে, প্রায় একেবারে প্রাথমিক একটা নকশা তৈরি করেছে।

শিল্পী আমিনুল ইসলাম শহীদ মিনার পর্বের ইতিহাস দেখেছেন। নিজের দেখা অভিজ্ঞতাকে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘হামিদ আর নভেরা ইঞ্জিনিয়ারের ঘনিষ্ঠ ছিল আগে থেকেই। সে একটা তাঁবু বানিয়ে দিল নভেরার থাকার জন্য। রাত-দিন কাজ হচ্ছে। রাতে দলটি ১১টা পর্যন্ত থাকত। ওখানে তখন সাংবাদিক সাহিত্যিকরা যেত। কতদূর কাজ হলো...সাইয়িদই একটা বই লিখেছে হামিদের ওপর। সেটাতে আছে হামিদুর রহমান তেহরান বিয়েনালে প্রাইজ পেয়েছে। আরো ভুল তথ্য আছে। মিথ্যে কথা। হামিদ ছবিই দেয়নি। প্রথম প্রতিবাদ করেন ... ওনারা জানতেন শহীদ মিনারের নকশা নভেরার করা।...পৃথিবীতে অনেক মিথ্যাই সত্য হয়ে যায়। (বলে হাসেন তিনি)

সাইয়িদ আতীকুল্লাহ বহু বছর আগেই এই মানবী ভাস্করকে প্রথম এনেছিলেন কবিতা লিখে। শহীদ মিনারের নকশা সরকারিভাবে পাস করা হয় ১৯৫৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। তাতে ইংরেজিতে লেখা, ‘কম্পোজার হামিদুর রহমান, কোলাবরেশন উইথ নভেরা আহমেদ স্কাল্পটার। নথিপত্রে সহযোগী বলা হয়েছে। কিন্তু স্বচক্ষে যারা শহীদ মিনার গড়ে ওঠা দেখেছেন তারাও একসময় নভেরার কথা বলেননি। প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু দেননি। প্রভাবশালী পরিবারের দুই সন্তান সাইয়িদ আহমেদ হামিদুর রহমান এবং তাদের ক্ষমতাবান অনুগামীরা সচেতনভাবে সুযোগমতো ভাস্কর নভেরা আহমেদের নাম মুছে দিয়েছেন। তারা হয়তো ভাবেননি ইতিহাসের সব চিহ্ন মুছে ফেলা যায় না। কিছু প্রমাণ, সংকেত থেকে যায়। এছাড়া মনের মাধুরী মেশানো মিথ্যা গল্প বানিয়েছিলেন একজন চিত্রশিল্পী। তিনি বলেছেন, ১৯৭২ সালে প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসে নভেরাকে দেখেছিলেন লাঠি হাতে; দুহাত থরথর করে কাঁপছিল। অথচ নভেরা সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। নভেরাকে তার পারকিনসন রোগে আক্রান্ত বলে মনে হয়েছিল। অথচ ১৯৭২ সালে নভেরা সম্পূর্ণ সুস্থ। আমার কাছে কথা শুনে অধ্যাপক বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর আড়ষ্ট। কারণ উল্লেখিত ওই চিত্রশিল্পী তার বন্ধু। অনুচ্চ স্বর তার—‘‌বলাটা ঠিক হয়নি।

নভেরাকে নিয়ে বহু মনগড়া গল্প তৈরি করা হয়েছে। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আরেকটি ঘটনার কথা বলছি। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্যারিসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ। দেখা করতে হোটেল হিলটনে তিনি হেঁটেই এসেছিলেন। হোটেল চত্বরে আমি অপেক্ষা করছিলাম। গ্রেগোয়ার অপেক্ষা করেছেন গাড়িতে। নভেরা আহমেদ আমি লিফটে করে হোটেলের ওপরের তলায় সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে গিয়েছিলাম। নভেরা কোনো ক্র্যাচ ব্যবহার করেননি। প্রসঙ্গটি উল্লেখ করলাম, কারণ একজন লেখক তার রচনায় নভেরা ক্র্যাচ ব্যবহার করেছিলেন লিখেছেন, যা সম্পূর্ণ কল্পনানির্ভর।

ষাটের দশকে নভেরার ভাস্কর্য নিয়ে প্রদর্শনী হয়? তার পরও তার নামটা বিস্মৃতির মধ্যে চলে গেল কেন? এটা সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?

পারিবারিক সামাজিক নানা কারণেই তিনি দেশ থেকে দূরে ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্যারিসে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন। হাসপাতালে তিন মাস আর পরে ছয় মাস কাটাতে হয় পুনর্বাসন কেন্দ্রে। নভেরা একাকিত্বের অস্থির যন্ত্রণা উপলদ্ধি করেছেন স্বজনহীন প্রবাসে। একমাত্র নির্ভরতা, ভরসা ছিলেন বন্ধু গ্রেগোয়ার। দুর্ঘটনার পর তার জীবন-ভাবনা, শর্ত পাল্টে যায়। জীবনের অন্তিম সময়ে দেশে ফেরার আকুলতা নভেরার ছিল, কিন্তু শারীরিকভাবে অক্ষম ছিলেন তখন। দেশ তাকে ভুলে গেলেও তিনি দেশকে লালন করেই জীবন কাটিয়েছেন পরবাসে।

নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যগুলো কেন সংরক্ষণ করা হলো না, নষ্ট হলো? তার ভাস্কর্যগুলোর গুরুত্ব কি তখন আমরা বুঝতে পারিনি, নাকি একজন নারী ভাস্করকে ধারণ করা বা সমাজে তার ভাস্কর্য বোঝার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি?

৩৮ বছরেরও বেশি সময় নভেরা আহমেদের শিল্পকর্ম অবহেলা, অনাদরে পড়ে ছিল। দীর্ঘকাল দেশবিচ্ছিন্ন নভেরাকে তার ঘনিষ্ঠ সতীর্থরা মনে রাখেননি। উদ্যোগ নেননি দেশের প্রথম মানবী ভাস্করের অমূল্য সম্পদগুলো সংরক্ষণের। কেউ কেউ স্বস্তিতে ছিলেন তিনি মৃত ভেবে। সমাজগুরুদের কবজাগত বিধির আগলভাঙা মানবীদের মেধা, যোগ্যতা, অর্জন আর সমান অধিকার উপেক্ষিত হয়েছে বারবার। প্রসঙ্গে আরেকজন মেধাবী-মনন কবি সুরাইয়া খানমের কথা মনে হলো, তাকে নিয়েও স্থূল মনগড়া কাহিনীর চর্চা; বিষয় মেধা নয় তার সৌন্দর্য ব্যক্তিজীবনের প্রেম। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক আলো-মানবী নভেরা। নিজের শর্তে কাজ করতে চেয়েছেন। যাপনও করেছেন, যা সমাজপতি অনেক পুরুষের জন্য স্বস্তিকর ছিল না।

বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক দেয়? তিনি কি তা গ্রহণ করতে পেরেছিলেন?

১৯৯৭ সালে ভাস্কর নভেরা আহমেদকে একুশে পদক দেয়া হলেও তিনি গ্রহণ করেননি। ১৯৯৯ সালে প্যারিসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাকে যথাযথ সম্মান জানিয়ে একুশে পদক প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু তারপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি। নভেরা আহমেদের প্রয়াণের আট বছর হয়। সরকারিভাবে আজ পর্যন্ত ভাস্কর নভেরা আহমেদের প্রাপ্য একুশে পদক দেয়া হয়নি তার অবর্তমানে স্বামী গ্রেগোয়ার দ্য ব্রুনসের কাছে।

নভেরা আহমেদের প্রয়াণের পর এখন কি তার বাড়িতে যাওয়া হয়? গ্রেগোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ হয় আপনার?

হ্যাঁ, গ্রেগোয়ারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। তার শঁতমেলের বাড়ি বা নভেরা মিউজিয়ামেও বহুবার গেছি। জানুয়ারিতে গ্রেগোয়ার প্যারিসে এসেছিলেন। তার বয়স এখন ৮০। প্রয়োজন ছাড়া আসেন না নগর প্যারিসে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত নভেরা মিউজিয়ামের কাজ নিয়েই তার ব্যস্ত সময় কাটে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন