বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক ভাস্কর

শিকোয়া নাজনীন

সূর্যমূখী নারীরা, ১৯৭৩ সূর্যমুখী পুরুষ

শিল্পী নভেরার পূর্বপুরুষ এসেছিল চট্টগ্রাম থেকে, যে প্রদেশকে আমরা উত্তাল সমুদ্র জলরাশির গাঙ্গেয় বদ্বীপময় কোমল পলিমাটির দেশ জানি। যেখানে পাহাড় আর শৈল অরণ্য হাওয়ার বিন্যাসে সমুদ্র স্রোততাড়িত মানুষের জীবন-জনপদ খানিক কর্কশ হয়ে ওঠে, নভেরার জৈবিক উত্তরাধিকারের মধ্যে ছিল পর্বত-সমুদ্রবাহিত ঝড়ো-বিক্ষুব্ধ ভূমির গঠনসৌষ্ঠব। মনে করা যেতে পারে, নভেরা পরবর্তী জীবনে যে পেশা বেছে নিয়েছিলেন তার প্রস্ফুটনের বীজ প্রোথিত ছিল এই ভৌগোলিক বিন্যাসের প্রবাহে, যা ছিল খানিক প্রতিকূল নবোদ্গত। বদ্বীপ রচিত হওয়ার কালে যেখানে উপসাগর সরে গিয়ে নরম পলির স্তরে, অতল খাদের প্রতিবিম্বে, অখণ্ড নম্য গড়নের অবয়ব ফুটে থাকে, এমন একটি ভাস্কর্যপ্রবণ ভূমির দিগন্তে ছিল নভেরার পূর্বপুরুষের আবাস। সেখানে সমুদ্রের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ প্রাকৃতিক অনিশ্চয়তার অসীম দিকমণ্ডল নভেরার মনন গঠনে ভূমিকা রেখে থাকবে। কারণ শিল্পী নভেরা তার সময়ে একজন আপসহীন, অনমনীয়, দৃঢ়, স্বাধীন জীবন এবং অনন্য একটি পেশা বেছে নিয়েছিলেন। জানা যায়, এক মুসলিম পরিবারে ১৯৩০-এর দশকে নভেরার জন্ম। বাবা সৈয়দ আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। বাবার কাজের সূত্রে নভেরা কলকাতার কনভেন্টে লরেটোতে পড়েছেন। কিছুদিন কুমিল্লায় চট্টগ্রামে কেটেছে নভেরার কৈশোরকাল।

নভেরা লন্ডনে গিয়েছিলেন বোনের কাছে, ভাস্কর হওয়ার নিশ্চিত পরিকল্পনা ছিল না তখনো। কারণ শিল্পকলা বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তার। বিষয়ে অবচেতন প্রণোদনা জেগে থাকতে পারে মায়ের কারণে। জনশ্রুতি আছে, ছোটবেলায় মাকে তিনি মাটি দিয়ে পুতুল, পাখি ইত্যাদি নানা রকম ফর্ম তৈরি করতে দেখেছিলেন। ১৯৫১ সালে নভেরা ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টসের মডেলিং স্কাল্পচার বিভাগে ভর্তি হন। আমরা ধরে নিতে পারি, ষাটের দশকে পাশ্চাত্যে শিল্পের আন্দোলনের মধ্যে আধুনিকতার বাঁক পরিবর্তনের ঝোঁকটিকে নভেরা গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন তখন। জানা যায়, ছাত্রজীবনে নভেরা বিভিন্ন শিল্পীর স্টুডিওতে গিয়ে কাজ দেখা শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।

শিক্ষা শেষে তিনি ফিরে এসেছিলেন ঢাকায় ১৯৫৬ সালে। অবিভক্ত বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের উপনিবেশ। ঢাকা এক নিরাভরণ শিল্পহীন মফস্বল। একদিকে সাতচল্লিশের দেশভাগের দাঙ্গার বিস্রস্ত জনপদ, অন্যদিকে পরাধীন জাতির নিজ ভাষার জন্য তীব্র রৌদ্রদগ্ধ সংগ্রামী চেতনার দাবানল। বাঙালি জাতি তখন নিজের অধিকার আর পরিচয় অনুসন্ধানে যুদ্ধরত। অবিভক্ত প্রদেশ তখন পাকিস্তান, অমৃতসর, লাহোর, ঢাকা সাম্প্রদায়িক সংঘাতে দীর্ণ, দেশ হারানো উদ্বাস্তু মানুষের বিপন্ন সংকটকাল। শিল্পী জয়নুল আবেদিন কলকাতার শিক্ষা সমাপ্ত করে ফিরে এলেন ১৯৪৮ সালে। ঢাকায় শিল্পবিদ্যালয় স্থাপন করেন। যদিও সেখানে নারী শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হন ১৯৫৪-৫৫ শিক্ষাবর্ষে। আর পূর্ণাঙ্গ আর্ট কলেজে রূপান্তরিত হওয়ার পরে ভাস্কর্য বিষয়ে পাঠদান শুরু হয় ১৯৬৪ সালে। বাংলাদেশে চারুকলার ইতিহাসের সঙ্গে ভাস্কর্যচর্চার ইতিহাসের যেন কোনো সম্পর্ক নেই। দেশে আধুনিক ভাস্কর্যের সৃজনশীল পথ রচিত হলো যার হাতে তিনি প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকলেন সারা জীবন। পশ্চিমা আধুনিক ভাস্কর্যশিক্ষা দেশ কোনো কাজে লাগাতে পারল না। শিল্পী নভেরা পশ্চিমা দেশ থেকে শিক্ষা শেষ করে এসে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য নির্মাণ করেন এখানে। তার কাজের মধ্যে দেশজ আঙ্গিকে বাঙালির মানসলোকের অনুষঙ্গে আত্মপ্রত্যয়ী দার্শনিক কৃষক পরিবার, মানুষ, গরু ইত্যাদি বিষয়ে বাংলার বর্গাদার-মহাজন-প্রজার শ্রমবণ্টন, শোষণের রূপক ফর্মের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। শিল্পে তার রাজনৈতিক উদ্বেগ যৌবনের শেষ অবধি ছিল। শিল্প ইতিহাসের দৃষ্টিতে নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য অনুধাবন করতে একদিকে এই শহরের তৎকালীন সামাজিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বুঝতে হয়, অন্যদিকে বিশ্বশিল্পের (বিশেষত ইউরোপ রুশ শিল্পের) উন্মোচিত গ্রন্থিগুলোকে চিনতে হয়। সেখানে যারা শিল্পের প্রণোদনা জাগিয়েছিলেন তার মধ্যে দার্শনিক কার্ল মার্ক্স, জর্জ লুকাচ, মিশেল ফুকো, আরভাতব, নন্দনতাত্ত্বিক অ্যাডোরনো উল্লেখযোগ্য ছিলেন। যারা মানুষের শ্রমজীবিকা, শিল্প, দর্শন, রাজনীতি, সমাজ আর ব্যক্তিমানুষের ভবিতব্য নিয়ে বাস্তব সব নিরীক্ষার প্রণেতা। পশ্চিমা শিল্পশিক্ষায় আলোকিত নভেরা দ্রুতই সেসব দর্শনের মধ্যে নিজের জীবনাদর্শের অনুষঙ্গ খুঁজতে শুরু করেন।

ঢাকায় ফিরে নভেরা আহমেদ নানাবিধ সংকটের মধ্যে কাজ করেছিলেন। তার মধ্যে ভাস্কর্য উপাদানের দুষ্প্রাপ্যতা, রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিবেশ, প্রযুক্তির দৈন্য ছাড়াও ছিল একজন নারী শিল্পীর কাজের বিরুদ্ধ পরিবেশ। একদিকে শিল্পচর্চা ছিল ধর্মীয় অনুশাসনবিরোধী, অন্যদিকে শিক্ষার আলোবঞ্চিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম সমাজ। এর মধ্যেই নবনির্মিত পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে (বর্তমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) হামিদুর রহমান নভেরা আহমেদ একটি কমিশনের কাজ করেন। নভেরা প্রবেশপথের দেয়ালের ওপরে অর্ধেকটাজুড়ে একটা লো রিলিফের ম্যুরাল কাজ করেন। সাতান্ন সালে সেখানে তাদের একটি যৌথ প্রদর্শনী হয়। কিছুদিন পরে তারা শহীদ মিনারের কাজ শুরু করেন। চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলাম সৈয়দ জাহাঙ্গীর ছিলেন হামিদুর রাহমানের বন্ধু। নভেরার সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব ছিল। দুজনেই শহীদ মিনার গড়ে ওঠা সচক্ষে দেখেছেন। তারা জানান, শহীদ মিনারের পাশেই তাঁবু টানিয়ে কাজ করত নভেরা আর হামিদ। হামিদকে কাজটি দেয়ার পেছনে ছিল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সুপারিশ। সরকারিভাবে স্থাপনাটি নির্মাণের দায়িত্ব ছিল প্রকৌশলী জব্বার সাহেবের ওপর। হামিদ যোগাযোগ রাখত সব ধরনের সরকারি কার্যকলাপে আর নভেরা ব্যস্ত থাকত নকশা তৈরিতে। যদিও পরবর্তীকালে সরকারি নথিতে নভেরার নাম না থাকায় কাজের স্বীকৃতি তিনি পাননি।

নভেরা একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী করেছিলেন ১৯৬০ সালের আগস্ট। জেনারেল আজম শিল্পীকে উৎসাহিত করতে ১০ হাজার টাকার চেক দেন। সেটি ছিল এক ধরনের স্বীকৃতি। ঢাকায় কমিশনের কাজ করার সুযোগ ছিল কম। কারণ একটি প্রাদেশিক রাজধানীতে স্থাপত্য আর ভাস্কর্যকে উৎসাহিত করবার মতো সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল না। নভেরা আহমেদ কোনো কমিশন পাচ্ছিলেন না বলেই ফয়েজ আহমদ ফয়েজ তাকে লাহোরে যেতে আমন্ত্রণ জানান। ১৯৬১ সালে অল পাকিস্তান পেইন্টিং অ্যান্ড স্কাল্পচার"প্রদর্শনীর আয়োজন হলে নভেরাচাইল্ড ফিলোসফার নামে একটি আবক্ষ মূর্তির জন্য প্রথম পুরস্কার পেলেন।

প্রথম আধুনিক ভাস্কর হিসেবে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে শহরে আশ্চর্য সব ফর্ম তৈরি করেছিলেন, পুরস্কৃত হয়েছিলেন নভেরা। তিনি প্রথা ভেঙে এমন এক পথ তৈরি করেছিলেন যা ছিল বাংলায় নতুন এক সৃজনশীলতার ইতিহাস। আর তা তিনি করলেন খুব অল্প সময়ের মধ্যে, সদ্য শিক্ষা সমাপ্ত করে এসে এক রকম ভাস্কর্যের প্রাথমিক নিরীক্ষার কালেই। ভাস্কর হিসেবে ইউরোপের শিক্ষা, দর্শন নিয়ে দেশে ফিরে নভেরা কতটা অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন তা অনুধাবন করে নিতে হয়। কারণ তার শিল্প ভাবনা নিয়ে তিনি কোথাও কিছু বলেননি। প্রসঙ্গে ভাস্কর লালারুখ সেলিম জানান, যে সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা নভেরা ঢাকায় পেয়েছেন তার ওপর জীবন নির্বাহ করতে না পেরে নভেরা ঢাকার শিল্পজগৎ থেকে উধাও হয়ে যান। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র মনে করেনি যে নিজেদের বাসগৃহ বা কলকারখানা ভাস্কর্য দিয়ে অলংকৃত করবে। সরকারি কাজের সম্ভাবনা তেমন ছিল না। ষাটের দশকের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট একজন নারী ভাস্করের জন্য সহায়ক ছিল না। অতএব অনুমান করে নেয়া ভুল হবে না, নভেরা তার কাজের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দেশ ছেড়ে চলে যান। তার পর থেকে নভেরা নামটি দেশে বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭০ সালে তিনি ব্যাংককে ভাস্কর্য প্রদর্শনী করেন। তারপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে একসময় তিনি পাকাপাকিভাবে ফরাসি দেশে স্থায়ী হন।

দেশের বাইরে নভেরা যেসব ভাস্কর্য নির্মাণ করেন সেখানে তার শিল্পের ফর্ম সম্পূর্ণ বদলে যেতে দেখি আমরা। সেখানে তার দেশ-স্মৃতি অবঘাতের প্রত্যক্ষতায় অঙ্কিত হয়। একদিকে সেখানে এক নিরবধি শূন্যতার বোধ, তার স্বদেশলগ্নতাও নতুন নতুন ফর্মে ব্যাপ্ত হতে দেখি। অন্যদিকে তার ভাস্কর্য উপকরণের মধ্যে রোপিত ছিল সমগ্র পৃথিবীর বুর্জোয়া রাষ্ট্রকাঠমোর শোষণের চিহ্ন। শ্রেণী-শোষণ আর শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের প্রহসন। সেখানে তার ফেলে আসা জন্মভূমির ভৌগোলিক ভাগ্য শুধু আর তার চেতনাদেশ হয়ে থাকেনি, বরং সেখানে বিশ্বমানচিত্রের রাজনীতির প্রণোদনা জড়ো হয়। শিল্প নন্দনতত্ত্বের অতীন্দ্রিয় সত্তা কীভাবে পুঁজিবাদী বুর্জোয়া পৃথিবীর পণ্যভাষায় রূপান্তর হয় সেই কনস্ট্রাক্টিভিস্ট শিল্প আন্দোলনের মেটাফর হিসেবে নভেরা সময় তার ভাস্কর্যে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন ব্রোঞ্জ, কখনো ধাতব পাত ফাউন্ড অবজেক্ট। কারখানার উৎপাদিত পণ্য ব্রোঞ্জ বা ধাতব পাত সত্তা কখনো তার শিল্পের ফর্মের মতো অগ্রগণ্য আর বাঙ্ময় ছিল। যে ব্রোঞ্জ নিজেই শিল্প ইতিহাসের স্মারক, সেই ধাতু দিয়ে নভেরা ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। তার ভাস্কর্যের উপাদানের জং ধরা, চটে যাওয়া রঙ এক ধরনের আকস্মিক বর্ণস্পর্শময় নৃশংসতাকে প্রকাশ করে। ব্রোঞ্জৎ দেহে রয়েছে নিষ্প্রভ খরতা আর কর্কশতা। এর রয়েছে বিক্ষুব্ধ, বর্ণহীন সংবেদ আর দ্রবীভূত হওয়ার মতো নম্য ক্রীতদাসতুল্যতা। ধাতু হয়ে ওঠে শিল্পীর স্বাধীন চিন্তার অনুষঙ্গ। ধাতুর পাতে দগ্ধ, ভূমিচ্যুত, অনিকেত অনান্দনিক পৃথিবী ক্রমশই উদ্ভাসিত হতে দেখি আমরা নভেরার ভাস্কর্যে। স্পর্শগ্রাহ্যতা বা টেক্টাইল ইন্দ্রিয়ানুভূতি ব্রোঞ্জ ধাতুর অমসৃণ পৃষ্ঠতলে ফুটে ওঠে। ভাস্কর্যের অবয়বে কখনো অগ্নিময় ক্রোধ, অবঘাতের শূন্যতা প্রকাশ পায়; আবার কোথাও তার ভাস্কর্য ফর্মগুলো প্রলয়ের সংঘাতে বিধ্বস্ত। যেন অকস্মাৎ উন্মোচন হৃদয় নখর-দংশনে খুবলে নেয়া, তার ভাস্কর্যের ক্ষিপ্র ক্ষুরধার অভীপ্সার আর্তি আপাতদৃষ্টে ক্লিন্ন বিষাদময়। এভাবে তার ভাস্কর্যের জৈবপ্রকৃতি শিল্প নন্দনতত্ত্বের উচ্চমার্গে পৌঁছানোর পণ্যতুল্য প্রলোভনের পৃথিবীকে পরিত্যাগ করে। (সংক্ষেপিত)

শিকোয়া নাজনীন: গবেষক লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন