নীতিমালা-পরিকল্পনাহীনতায় সংকটে ঢাকার সবুজ পরিসর

সবুজ পরিসর ধ্বংসের আরো চড়া মূল্য দিতে হবে

বিশ্বে যে দেশগুলোর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বাংলাদেশ তার অন্যতম। মেগাসিটি রাজধানী ঢাকায় এর প্রভাবটা আরো বেশি। একদিকে গাছপালা কেটে নতুন নতুন দালানকোঠা নির্মাণ, অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন এ নগরীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছে। তাই নগরীতে এখন আগের মতো ঋতুবৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় না। একটি আদর্শ শহরের মোট আয়তনের অন্তত ২০ শতাংশ সবুজ স্থান থাকতে হয়। এ সবুজ শহরের ব্যস্ত নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও মানসিক প্রশান্তি রক্ষায় যেমন ভূমিকা রাখে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্যও বজায় থাকে। রাজধানী ঢাকায় সেই সুবজ রয়েছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশেরও কম স্থানে। আবার যেটুকু রয়েছে সেখানেও নেই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ তদারকি। এ কারণে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য নগরীর তালিকায় ওপরে অবস্থান করছে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণে বিপর্যস্ত ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। এর মূল্য দিতে হচ্ছে মানুষকে। এখনই উদ্যোগ না নিলে সবুজ পরিসর ধ্বংসের আরো চড়া মূল্য দিতে হবে। 

একসময় ঢাকা নগরীকে সবুজ নগরী (গ্রিন সিটি) বলা হতো। বিদেশীরা ঢাকায় এসে সবুজের সমারোহ দেখে বিমোহিত হতেন। কয়েক দশক আগেও বহুতল ভবনের ছাদ থেকে তাকালে মনে হতো সবুজ চাদরে ঢেকে আছে ঢাকা নগরী। একসময়ের সবুজ নগরী ঢাকায় এখন সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা শহরে জন্ম, বেড়ে ওঠার সুবাদে সবুজ নগরী ঢাকা এবং সবুজ নগরীখ্যাত ঢাকা সবুজের তিলে তিলে ধ্বংস দুটোই দেখেছি। সবুজ নগরী ঢাকাকে এখন ইট-বালি-সিমেন্ট-লোহায় নির্মিত ইমারতের নগরী বা কংক্রিটের জঙ্গল বলাই যথার্থ। সবুজ নগরী ঢাকাকে ধ্বংস করে ইমারতের নগরী বা কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত করার ফল কী হয়েছে তা খতিয়ে দেখলে ঢাকাকে বাঁচাতে সবুজায়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করে উপায় নেই। দেশের বর্তমান নীতিকাঠামোয় স্পষ্টভাবে ‘সবুজ পরিসর’-কে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। ঢাকার সর্বশেষ বিশদ নগর পরিকল্পনায়ও (ড্যাপ ২০২২-৩৫) কতটুকু সবুজ আচ্ছাদিত অঞ্চল থাকবে তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। রাজধানীতে পার্কসহ বিভিন্ন সবুজ পরিসর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে ছয় সংস্থা। কিন্তু এ সংস্থাগুলোর মধ্যে পার্ক ও সবুজ পরিসর নিয়ে ধারণা না থাকাসহ নানা সংকটে এসব পার্ক ও সবুজ পরিসর থেকে নগরবাসীর যেসব সুবিধা পাওয়ার কথা তার কোনোটিই মিলছে না।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ‘‌প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস’-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা, ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনা ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকদের যৌথ গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বিশ্বে তাপমাত্রার শীর্ষে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ঢাকার তাপমাত্রা এতটা বাড়ত না যদি প্রয়োজনীয় গাছগাছালি থাকত, উচ্চতাপমাত্রা ঢাকাকে বিপজ্জনক করে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশনের গত বছরের শেষদিকে প্রকাশিত ‘‌হট সিটিজ, চিলড ইকোনমিকস অব এক্সট্রিম হিট অন গ্লোবাল সিটিজ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চতাপের কারণে অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় ঢাকার মানুষের শ্রম উৎপাদনশীলতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। টাকার অংকে এ ক্ষতির পরিমাণ ৬০০ কোটি ডলার। গাছগাছালি তাপমাত্রা কমাতে সহায়ক, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত। যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষক দেখিয়েছেন, গাছের আচ্ছাদন গ্রীষ্মকালে দিনের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো প্রশমন করতে পারে।

আইন অনুসারে ঢাকায় পার্কসহ অন্যান্য সবুজ পরিসর তদারকির মূল দায়িত্ব থাকার কথা ছিল দুই সিটি করপোরেশনের হাতে। তবে এ দুটি ছাড়াও আরো যে সংস্থাগুলো তদারকির দায়িত্বে রয়েছে সেগুলো হলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), গণপূর্ত অধিদপ্তর, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ও বন অধিদপ্তর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজউকের আয়ত্তে থাকা বিভিন্ন পার্ক ও সবুজ পরিসর দেখভালের জন্য দুই সিটি করপোরেশনে হস্তান্তর করার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি হয়নি। আবার সিটি করপোরেশনের কাছে যেগুলোর দায়িত্ব রয়েছে, সেগুলোয় সবুজায়নের বদলে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে নিজেদের আয় বাড়ানোর দিকে তারা বেশি মনোযোগী, যা কাম্য নয়। ১৯৫৩ সালের নগর উন্নয়নবিধি অনুযায়ী, শহরের খোলা জায়গা দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। কিন্তু অনেক সরকারি সংস্থাই সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। অবশ্য সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে থাকা পার্ক ও সবুজ পরিসর ব্যবস্থাপনা নিয়েও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

সর্বজনবিদিত যে বৃক্ষ অক্সিজেন সরবরাহ, জীববৈচিত্র্য, দূষণ রোধসহ নানাভাবে ভূমিকা রাখে। গাছ পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। বিনিময়ে বিশুদ্ধ অক্সিজেন সরবরাহ করে পরিবেশের তাপমাত্রা শীতল রাখে, মানুষসহ অক্সিজেন গ্রহণ করে বাঁচা প্রাণীদের সুস্থতা নিশ্চিত করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি জনপদে লোকসংখ্যার তিন গুণ গাছ থাকা দরকার। প্রতি বছর একজন সুস্থ ব্যক্তির নিশ্বাস নিতে ৭৮৬ গ্রাম অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে। এর জন্য প্রতি কাঠায় সাত-আটটি গাছের দরকার হয়। ঢাকা নগরীর আয়তন অনুযায়ী গাছের সংখ্যা গুনলে দেখা যাবে কাঠাপ্রতি একটি গাছও নেই। প্রয়োজনীয়সংখ্যক গাছ না থাকায় সামনের দিনগুলোয় রাজধানীর মানুষ নিশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে বলেছেন, রাজধানী ঢাকা যেভাবে গাছগাছালিশূন্য হচ্ছে তাতে রাজধানীতে ২০ বছর পর অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। 

সবুজ পরিসর ধ্বংসের চড়া মূল্য এরই মধ্যে দেয়া শুরু হয়েছে। ঢাকা নগরী ক্রমেই উষ্ণ হয়ে ওঠা, উষ্ণায়নের কারণে ঢাকা নগরবাসীর কর্মক্ষমতা হ্রাস, হিট স্ট্রোকসহ নানা রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব, অগ্নিকাণ্ডের একের পর এক ঘটনার ব্যাপকতা এখনই লক্ষ করা যাচ্ছে। এখনো যদি সবুজায়নের প্রয়োজনীয়তা-গুরুত্ব উপেক্ষা বা অগ্রাহ্য করা হয় তাহলে আখেরে পরিণতি কী হতে পারে তা এ মুহূর্তে অনুমান করে বলা কঠিন। ঢাকা এবং ঢাকার বাসিন্দাদের বাঁচাতে ঢাকা নগরীকে সবুজায়নে এখন থেকেই জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকা নগরীকে সবুজায়নে শুধু গাছ লাগালেই হবে না, গাছটি পরিবেশবান্ধব কিনা সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। নগরায়ণ বা ভবন নির্মাণে সবুজায়ন নির্মূলের প্রবণতা কিংবা মচ্ছব রোধে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনীয় সবুজায়নের জন্য জায়গা উন্মুক্ত না রেখে নগরায়ণের সুযোগ দিয়ে ঢাকা নগরীকে আজকের পর্যায়ে আনা হয়েছে। এমন উদাসীনতার সুযোগ আর নেই। 

তাপমাত্রা বৃদ্ধিও ঢাকা নগরীর বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠার একটি কারণ বৈকি। এ নগরীর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে প্রভাবটা পড়ছে তা ‘হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট’ নামে পরিচিত। এর মাশুল দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে। যে বিষয়গুলোকে বাসযোগ্য শহরের মাপকাঠি নির্ধারণ করেছে, সেগুলোয় দৃষ্টি দিতে হবে। যেমন স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো। এসব ক্ষেত্রে অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর কাজ হতে হবে পরিবেশবান্ধব। রাজধানীর হাতিরঝিল প্রকল্পটি উন্নয়নের একটি আদর্শ মডেল। জলাধার ও পরিবেশ অক্ষুণ্ন রেখেও যে উন্নয়ন করা যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এ প্রকল্প। অন্যান্য প্রকল্প গ্রহণের সময় এ চিন্তা মাথায় রাখতে হবে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে নগরবাসীর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করাটাও বাসযোগ্যতার একটি নির্ধারক বটে। এসব ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি আন্তরিক হন এবং জনসচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নেন, তাহলে রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলা কঠিন কিছু নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন