বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৩ হাজার মেগাওয়াটেই সীমাবদ্ধ থাকছে

অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদা বাড়ছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে কম থাকে শীতকালে। সেখান থেকে বাড়তে শুরু করে মার্চে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের মার্চে দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা উঠেছিল ১৩ হাজার ৬৬২ মেগাওয়াটে। অন্যদিকে চলতি বছরের মার্চে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ চাহিদা উঠেছে ১২ হাজার ৯২৬ মেগাওয়াটে।

দিনভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের মার্চ দেশে উৎপাদন পর্যায়ে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১০ হাজার ৪৯০ মেগাওয়াট। একই বছরের মার্চ চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৪২৪ মেগাওয়াট। ২০২২ সালের ১৫ মার্চ দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১২ হাজার ১৭০ মেগাওয়াট। আর গত বছরের ২৭ মার্চ চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ১০৮ মেগাওয়াট। অন্যদিকে বছরের মার্চ উৎপাদন পর্যায়ে দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৮৯২ মেগাওয়াট। মার্চ চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৫৬৮ মেগাওয়াট। ১৬ মার্চ দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৯২৬ মেগাওয়াট। ২৩ মার্চ চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৭৪২ মেগাওয়াট।

দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা এখন ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট (সরকারি আরেক হিসাব অনুযায়ী ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট) অথচ দেশে মুহূর্তে বিদ্যুৎ খাতের দৈনিক চাহিদা সীমাবদ্ধ থাকছে ১২ থেকে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত তা ১৩ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হতে পারেনি। সে হিসেবে এবার অব্যবহূত থেকেছে অন্তত ১৩ হাজার মেগাওয়াটের মতো সক্ষমতা। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে ২০১০ সালে প্রথম মহাপরিকল্পনা তৈরি করে সরকার। এটি সংশোধন হয় ২০১৬ সালে। সংশোধিত মহাপরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন সক্ষমতা ৪০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মীয়মাণ পাইপলাইনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনক্ষম হয়ে উঠলে লক্ষ্য ২০২৭ সালের মধ্যেই পূরণ হয়ে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ক্রমপ্রসারমাণ অর্থনীতির চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্য থেকে মহাপরিকল্পনায় উৎপাদন সক্ষমতার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও এখন পর্যন্ত সক্ষমতা বেড়ে চললেও সে অনুযায়ী চাহিদা বাড়ানো যায়নি। বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা বেড়েছে প্রতি বছর গড়ে হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। যদিও সময় প্রতি বছর চাহিদা বেড়েছে গড়ে ৭৬৪ মেগাওয়াট।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, সামগ্রিকভাবে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। তবে সাধারণভাবে বিদ্যুতের চাহিদা যে পরিমাণ বাড়ার কথা সেভাবে বাড়ে না, কারণ শিল্পগুলো গ্রিডে না এসে তাদের ক্যাপটিভ দিয়ে চলে। এর পরও আমাদের প্রক্ষেপণ হলো গতবারের থেকে এবার বিদ্যুৎ চাহিদা হাজার মেগাওয়াট বাড়বে।

অর্থনৈতিক সংকটের ধাক্কা লেগেছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশের বৃহৎ মাঝারি শিল্পের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। এর মধ্যে খাদ্যপণ্য-সংশ্লিষ্ট শিল্পে শতাংশ, বস্ত্র খাতে , চামড়া চামড়াজাত পণ্যে ১২, রাসায়নিক রাসায়নিক পণ্যে ২৫, কম্পিউটার ইলেকট্রনিকস পণ্যে ৪১ এবং পরিবহন সরঞ্জাম খাতে ৫৬ শতাংশ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কমেছে।

পোশাক প্রস্তুত রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বণিক বার্তাকে বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় বছর ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হয়নি, ফলে আমাদের বিদু্যুতের ব্যবহারও বাড়েনি। বছর অর্ডার কম। আমাদের কারখানা এখন ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্যাপাসিটিতে চলছে। অর্থাৎ সক্ষমতার বড় একটা অংশ অব্যবহূত থাকছে। কারখানায় আগে ঘণ্টা ডিউটির পাশাপাশি ঘণ্টা ওভারটাইম নিয়মিতই হতো কিন্তু এখন এমন হয়েছে যে পারলে ঘণ্টা কাজ করিয়েই ছুটি দিয়ে দেয়। কারখানাগুলোয় ক্রয়াদেশ কম, ফলে কাজ নেই, যার কারণে বিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে না। এছাড়া কাজ কম থাকার কারণে ফ্যাক্টরি মালিকরা ওভারটাইম কাজ না করিয়ে পরের দিন কাজ করাচ্ছেন। ফলে অনেকেরই ওভারটাইমের মতো বাড়তি ঝামেলার মধ্যে যেতে হচ্ছে না।

বিদ্যুৎ বিভাগ নির্বাহী আদেশের ক্ষমতা পাওয়ার পর চলতি বছরের প্রথম দুই মাসেই তিন দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ সামলাতে নতুন বছরে প্রতি মাসেই দাম সমন্বয় করছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় গত দুই মাসে গ্রাহক পর্যায়ে তিনবার শতাংশ করে মোট ১৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। প্রতি মাসেই বিদ্যুতের দাম অল্প অল্প করে সমন্বয় করা হবে বলে সে সময় জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছিল সরকার।

দাম বাড়ার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাওয়ার সম্পর্ক থাকলেও এখনো মানুষ চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ পাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে জ্বালানি সংকটের কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ কমানোর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তারা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক . শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থনৈতিক সংকট মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যুতের চাহিদা কমাচ্ছে কিনা সেই জায়গায় যাওয়াই যাচ্ছে না, কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনই হচ্ছে না। যদিও এগুলোর প্রভাব আছে। কিন্তু সেদিকে যাওয়া যাচ্ছে না। বলতে চাচ্ছি বিদ্যুতের চাহিদা বাড়েনি। এর চেয়ে বড় বিষয় হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা আমরা ব্যবহার করতে পারিনি। দাম বাড়ার সময় বলা হয়েছিল শতাংশ বাড়িয়ে লোডশেডিংমুক্ত বিদ্যুৎ দেয়া হবে, কিন্তু তার পরপরই লোডশেডিং আরোপ করা হয়েছে। শীত আসা পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো হয়েছে। ফলে চাহিদা বাড়বে কী করে? চাহিদা দমন করা হয়েছে। এখন গরমকালে আবার সেই অবস্থা তৈরি হবে, কারণ সময়ের মধ্যে ফুয়েলের সংস্থান করার জন্য টেকসই কোনো ব্যবস্থা হয়েছে বলে আমরা দাবি করতে পারছি না। ফলে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির প্রশ্ন আসে না। কারণ বলপূর্বক বিদ্যুতের চাহিদা দমন করা হয়েছে। পরিকল্পিত লোডশেডিং করে চাহিদা কমানো হয়েছে।

সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে এপ্রিল, মে জুনে। বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল এপ্রিলে১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। পরের দুই মাসে তা ছিল যথাক্রমে ১৩ হাজার ৯৫৪ ১৩ হাজার ৯৮৫ মেগাওয়াট।

এছাড়া বৈশ্বিক অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিও বিদ্যুতের বর্তমান চাহিদা পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্যমতে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিশ্বের অনেক ক্রেতা দেশই ক্রয়াদেশ কমিয়েছে। মূল্যস্ফীতি গোটা পৃথিবীতেই ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর ধারাবাহিকতায় শিল্প খাতেও উৎপাদন তথা বিদ্যুতের ব্যবহারও এখন স্বাভাবিকের চেয়ে কম।

এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বণিক বার্তাকে বলেন, শিল্পে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া বিদ্যুতের চাহিদা প্রত্যাশামাফিক না হওয়ার পেছনে একটা অন্যতম কারণ। যেমন আমার জুট মিলে ৫০ শতাংশের বেশি সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সার্বিকভাবে বলতে গেলে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব এক্ষেত্রে আছে। আর অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে। দেশী যেসব শিল্প আছে যেমন বেকারি বা হালকা প্রকৌশল পণ্যের ক্ষেত্রে যারা সাইকেল তৈরি করত, তারা পণ্য উৎপাদন কমিয়েছে। কারণ ক্রয়ক্ষমতা কমায় এসব পণ্যের চাহিদা কমেছে। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে বিদ্যুতের চাহিদা না বাড়ার ক্ষেত্রে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা একটা বড় কারণ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন