রেখাকে উমরাও জান করে তুলেছিল খৈয়ামের সংগীত

মোহাম্মদ জহুর খৈয়ামের সঙ্গে রেখা ছবি: দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

আশির দশকের গোড়ার দিকে মুক্তি পায় ‘উমরাও জান’। সিনেমাটি এক বাইজির গল্প নিয়ে। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ থেকে অপহৃত হয়ে লখনৌতে আসে আমিরান। লখনৌ তখন নবাবদের শহর। সেই সঙ্গে বাইজিদেরও। বাইজি খানম জানের প্রশিক্ষণে কালক্রমে আমিরান হয়ে উঠে উমরাও জান। বিখ্যাত বাইজি। তার রূপ ও গুণ পরিণত হয় কিংবদন্তিতে। 

উমরাও জানকে গল্পের মতো করে মানুষের সামনে উপস্থাপন করেন উর্দু কথাসাহিত্যিক মীর্জা হাদি রুসওয়া। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ‘উমরাও জান আদা’ নামে উর্দু উপন্যাসটির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় সিনেমা উমরাও জান। এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন বলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী রেখা। পরিচালনা করেন ভারতীয় কবি, শিল্পী ও সমাজকর্মী মুজাফফর আলী। সিনেমাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। রেখার অভিনয় এতটাই দর্শকপ্রিয়তা পায়, তাকে সবাই ‘উমরাও জান’ নামে ডাকা শুরু করে। এ চরিত্রে অভিনয় করে তিনি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।

 উমরাও জানের জনপ্রিয়তার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে সিনেমার গানগুলো। গান তো নয়, যেন একেকটি মুক্তা। ‘আঁখো কি মাস্তি’, ‘জিন্দেগি জব ভি’, ‘ইয়ে কিয়া জাগা হ্যায় দোস্তো’ গানগুলো ছিল মানুষের মুখে মুখে। এ গানগুলোর সংগীত পরিচালক ছিলেন মোহাম্মদ জহুর খৈয়াম। ১৯২৭ সালে পাঞ্জাবের এক মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া বলিউডের এ বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন গায়ক হিসেবে। ১৯৪৭ সালে রোমিও জুলিয়েট সিনেমার গানে তার কণ্ঠ শোনা যায়। পরবর্তী সময়ে ভূমিকা বদলান তিনি। নেপথ্যে থেকে চমৎকার সব গান তৈরি করেন। তার সংগীতায়োজনে সিনেমাগুলোর মধ্যে উমরাও জান, কভি কভি, রাজিয়া সুলতানা অন্যতম। সর্বশেষ তিনি ২০১৬ সালে ‘গুলাম বন্ধু’ সিনেমায় কাজ করেন। সিনেমাটি মুক্তি পায়নি। 

খৈয়ামকে শ্রদ্ধা করতেন রেখা। তাদের মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সবসময়ই বজায় ছিল। উমরাও জান হিসেবে নিজের খ্যাতির জন্য খৈয়ামের নিকট কৃতজ্ঞ রেখা। এ কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কখনো কুণ্ঠিত হননি তিনি। খৈয়ামও রেখার প্রশংসায় কার্পণ্য করেননি। ২০১২ সালে মিরচি মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসে খৈয়ামকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন রেখা। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে খৈয়াম বলেন, ‘আমি রেখাকে উমরাও জান বলে ডাকি। যারা উমরাও জানকে দেখেননি, তারা রেখার দিকে তাকাতে পারেন।’ প্রত্যুত্তরে রেখা জানান, চমৎকার সব গানের মাধ্যমে খৈয়াম তাকে এক নতুন পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সৌভাগ্যক্রমে খৈয়াম সাহেবকে পুরস্কারটি দিতে আমি এখানে আমন্ত্রিত হয়েছি। যদি তিনি না থাকতেন, আমার অস্তিত্ব থাকত না। উমরাও জান সিনেমার গানের মাধ্যমে খৈয়াম সাহেব আমাকে এক নতুন পরিচয় দিয়েছেন। যেখানেই আমি যাই, সবাই আমাকে প্রথমে উমরাও জান ডাকে, তারপর রেখা বলে।’ এসব কথায় খৈয়াম ও রেখার মধ্যে গভীর শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্কের ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়।

খৈয়ামের সঙ্গে বেশ কয়েকটি সিনেমায় একত্রে কাজ করেছেন উমরাও জানের পরিচালক মুজাফফর আলী। খৈয়ামের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে লিখেছিলেন, ‘ঊমরাও জানের গানগুলো তৈরি করতে প্রায় দুই বছর সময় লেগেছিল। প্রতিটি গানই এমনভাবে বানানো হয়েছিল, যেন মনে হয় তা কোনো নারীর হৃদয় থেকে উৎসারিত হচ্ছে। আশাজির (ভোঁশলে) সঙ্গে রিহার্সাল নতুন অনুরণন তৈরি করেছিল। খৈয়াম সাহেব তাকে তার স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে এক স্কেল নিচে গাইতে বাধ্য করেছিলেন। তিনি উপন্যাসটি পড়েছিলেন ও উমরাও জানকে তার প্রতিটি শিরায় অনুভব করেছিলেন। প্রতিটি গানের মাঝখানে আমরা বেশ বিরতি দিয়েছিলাম, যেন একটি অন্যটির চেয়ে কিছুটা ভিন্ন হয়। গানগুলো ছিল উমরাও জানের জীবনের রেখাচিত্র। তাই সচেতনভাবে তৈরি করতে হয়েছে। প্রতিবার খৈয়ামের সংগীতকক্ষে এক নতুন জগৎ সৃষ্টি হতো। অবাধে প্রবেশ করত জ্যোৎস্না। দেয়ালে ছিল গুরুনানক দেব, হরমন্দার সাহেব ও পবিত্র কাবার ছবি। যেন সেখানে সংঘটিত সবকিছুর ওপর তাদের আশীর্বাদ আছে। জগজিৎজির (খৈয়ামের স্ত্রী জগজিৎ কাউর) বানানো কফির সতেজ ঘ্রাণ আমাদের স্বাগত জানাত। যদি তবলাবাদক উপস্থিত না থাকতেন, তিনি একটি হার্ড কভার বই নিয়ে বসে হারমোনিয়ামে থাকা খৈয়াম সাহেবকে সঙ্গ দিতেন। হারমোনিয়ামে বাতাস ঢুকত, আর আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতাম।’

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯ সালে দুনিয়াকে বিদায় জানান কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক খৈয়াম। এর আগে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বহু পুরস্কার। তবে সবচেয়ে বড় পাওয়া এখনো তার বহু গান শ্রোতাদের হৃদয় উদ্বেল করে। 

দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অবলম্বনে নিজাম আশ শামস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন