সাতসতেরো

সহজলভ্য তথ্যের ফাঁদ!

ড. মো. আব্দুল হামিদ

আপনি কি জানেন আরাভ খান কে, তার জন্মস্থান কোথায়, তিনি কোন দেশের পাসপোর্ট নিয়ে দুবাই গিয়েছিলেন? প্রশ্নগুলো শুনে আমাকে বোকা মনে হচ্ছে, তাই না? বাংলাদেশের একজন ‘সচেতন’ নাগরিককে যে এমন অতি সহজ প্রশ্ন করতে পারে তার সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করা ঠিকই আছে, তাই তো? 

দুঃখিত, আমার বোঝা উচিত ছিল যে আপনার মতো একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি এ মামুলি তথ্যগুলো তো বটেই এমনকি যা কেউ স্পষ্ট করে বলছে না তেমন অসংখ্য বিষয়েও আপনার ভাণ্ডাড় সমৃদ্ধ। সেটা হতে পারে তিনি বর্তমানে কত নম্বর বিবির সঙ্গে ঘর করছেন কিংবা তার এ বিপুল অর্থবিত্তের প্রকৃত মালিক কে ইত্যাদি। ঠিক আছে, মেনে নিলাম আপনি সে ভদ্রলোক সম্পর্কে আরো বহু কিছু জানেন। 

কিন্তু আমার পয়েন্ট সেটা নয়। বরং সহজ জিজ্ঞাসা হলো—এ পর্যন্ত আপনি সেই খান সাহেব বা মোল্লা সম্পর্কে যতগুলো তথ্য জেনেছেন সেগুলো জানা কি খুব দরকার ছিল? সেগুলো জানা থাকায় ব্যক্তি বা কর্মজীবনে বিশেষ কোনো সুবিধা পাবেন? অথবা সেগুলো জানা না থাকলে কি বড় কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হতেন? এই যেমন বিসিএসের ভাইভায় ফেল করা কিংবা প্রমোশনের পরবর্তী পরীক্ষায় আটকে যাওয়া! 

না, তেমন কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তাহলে এবার ভাবুন গত দুই সপ্তাহে আপনি কি বিপুল পরিমাণ সময় এর পেছনে ব্যয় করেছেন! শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, নিউজ পোর্টাল, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ বা আইডি নানা আঙ্গিক থেকে তথ্য ও যুক্তি দিয়ে আপনাকে ‘সমৃদ্ধ’ করতে সচেষ্ট ছিল। আপনিও সেগুলো গোগ্রাসে গিলেছেন। এমনকি তার অর্বাচীনের মতো গালিগালাজ, সাক্ষাৎকারের ভিডিও দেখেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

এখন কথা হলো—সেই গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এগুলো কেন করছে? আপনাকে জ্ঞানী বানানোর জন্য নাকি বিনোদন দিতে? না, এর কোনোটাই নয়। বরং তারা এগুলো করছে, কারণ সেটাই তাদের কাজ (পেশা)। এর মাধ্যমে তারা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন, কনটেন্টের ভিউ বাড়ে, আয়-ইনকাম ভালো হয়। কিন্তু এ প্রক্রিয়া থেকে আমজনতা হিসেবে আপনার-আমার অর্জন কী? 

বলতে পারেন, অনেক কিছু জানতে পেরেছি। যেমন এ ঘটনায় দেশে চলমান দুর্নীতির নতুন এক আঙ্গিকের সঙ্গে পরিচিত হলাম। এর আড়ালের কুশীলবদের নাড়ি-নক্ষত্র জানতে পারলাম। ভালো কথা। এবার বলুন, আপনার এ জানার কারণে দেশে কি দুর্নীতির মাত্রা সামান্যতম কমবে? নানা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কি শাস্তি পাবে? নাকি এটাই ছিল পুকুর চুরির (না, সাগর চুরি বলাই ভালো) একমাত্র ঘটনা? আগে কখনো এমনটা ঘটেনি, ভবিষ্যতেও হবে না, ব্যাপারটা কি তেমন কিছু? 

সেটাও না। তাহলে এ ঘটনা নিয়ে আমরা কেন এত বেশি তৎপর হলাম? সবাই ফেলুদার মতো গোয়েন্দা হয়ে উঠলাম। হাতের কাজ ফেলে, রাত জেগে, নাওয়া-খাওয়া ভুলে নানা আঙ্গিক থেকে বিষয়টিকে বিশ্লেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। হাট-ঘাট-মাঠ সর্বত্র তাকে নিয়ে আলোচনা। এমনকি প্রথম রোজার ইফতারের পর্ব মুহূর্তেও এক ভদ্রলোক তার ব্যাপারে সোৎসাহে আলাপ জুড়লেন। দোয়া কবুলের ক্ষণটিতেও আরাভ কাহিনী মুখ্য হয়ে উঠল! কেন এমনটা হলো?

সত্যি কথা বলতে, আমরা কেউ জানি না। অথচ ভাবুন জীবনের কত গুরুত্বপূর্ণ সময় এর পেছনে ব্যয় হয়েছে। আমাদের চিন্তার জগৎকে কীভাবে দখল করে রেখেছে। ক’দিন আগে ওই ব্যক্তিকে আমরা চিনতাম না। মাসখানেক পর তার জন্য ১ মিনিট সময়ও বরাদ্দ রাখব না। তাহলে হঠাৎ করেই কেন আরাভ ইস্যুতে এতোটা উদগ্রীব বা মরিয়া হয়ে ওঠা? 

কারণ এ মুহূর্তে এর চেয়ে বেটার টপিক আমাদের হাতে নেই। মাঝে যদি আরো বড় কোনো ঘটনা (যেমন ক্রিকেট বিশ্বকাপ) সামনে আসত তবে নিশ্চিতভাবে আমরা সবাই সেদিকে ঝুঁকে পড়তাম। যে হট টপিক সামনে আসে সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়াই আমাদের বৈশিষ্ট্য। আরাভের খবর সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট বা ভিডিওর কমেন্টগুলো দেখলে বোঝা যায় কী বিপুল পরিমাণ মানুষ প্রতিদিন এর পেছনে পড়ে রয়েছেন! 

এ প্রসঙ্গে এক ঘটনা মনে পড়ল। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে কিছুদিন আগে খ্যাতিমান এক প্রতিষ্ঠানের কাচ্চিতে কীসের মাংস দেয়া হচ্ছে তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়। তখন সংশ্লিষ্ট এক পেজে মজা করে একজন প্রশ্ন করেন, আপনি যদি সেই প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং চিফ হতেন তবে এ সংকট কীভাবে মোকাবেলা করতেন? এক্ষেত্রে ভাইরাল মন্তব্যটি ছিল এ রকম... যেভাবেই হোক শীর্ষস্থানীয় এক নায়িকাকে দিয়ে একটা সংবাদ সম্মেলন করাতাম। সেখানে তিনি কেঁদেকেটে বলবেন, স্বামীর সঙ্গে ইদানীং তার কী কী সমস্যা চলছে। ব্যস, জাতি অন্তত ১০ দিন তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে! এরই মধ্যে সবাই কাচ্চিকাহিনী বেমালুম ভুলে যাবে! 

এখন ভাবছি, সেটার আর দরকার হলো না। কারণ আরাভ কাণ্ড–তার চেয়েও বেশি ভাইরাল হয়েছে। আমরা সবাই সেই রেস্টুরেন্টের কথা দিব্যি ভুলে গেছি, তাই না? এমন প্রবণতা দেখে কয়েক বছর আগে ‘এত তথ্যের কী দরকার’ শিরোনামে এক নিবন্ধ লিখেছিলাম। এখন সেই মাত্রা আরো প্রবল হয়েছে। একেকটা ভাইরাল ইস্যু সামনে এলেই সদলবলে সেটার প্রতি ঝাঁপিয়ে পড়ি। 

আমাদের বিপুল পরিমাণ সময় ও মনোযোগের বিনিময়ে কী অর্জন করতে চাই তা স্পষ্ট নয়। বরং অবস্থা হয়েছে এমন যে সবাই মেতে আছে, আলাপ করছে তাহলে আমি কেন পিছিয়ে থাকব? অথচ সেটা করতে গিয়ে যে আমাদের নির্ধারিত কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা মানসিক শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে তা ভাবার সময়টুকু পাচ্ছি না। 

সেলিব্রেটিদের জীবন ও কর্ম নিয়ে মানুষের বিশেষ আগ্রহ থাকে। কারণ তারা থাকেন কল্পনার জগতে, সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে বিখ্যাত কোনো খেলোয়াড়, শিল্পী কিংবা রাজনীতিবিদের স্ক্যান্ডালের খবরে সবাই নড়েচড়ে বসত। তবে খবরের উৎস সীমিত থাকায় তখন খুব বেশি জানা যেত না। ফলে সংশ্লিষ্ট খবর দেখা বা বিনোদন পাতা পড়ার সময় আগ্রহ জাগত। আশপাশের মানুষের সঙ্গে সেটা নিয়ে কথাবার্তা হতো। অথচ এখন আমরা অজ্ঞাত-অখ্যাত সবাইকে নিয়ে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকছি! 

যে হিরো আলমকে নিয়ে সবাই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তার কয়েক মিনিটের লাইভ ভিডিও দিনে লক্ষাধিক ভিউ হয়! যেসব ইউটিউবার স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেনি, শুদ্ধ ভাষায় দুইটা বাক্য বলতে পারে না, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি যাদের কনটেন্টের মূল উপজীব্য তাদের একেকজনের কয়েক মিলিয়ন ফলোয়ার। আজকাল মূলধারার গণমাধ্যমে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ হিসেবে! 

পাশাপাশি যারা অধিকাংশের অপছন্দের ব্যক্তিদের কশে গালি দিতে পারে, নিয়মিত বিষোদগার করে, ক্ষেত্রবিশেষে ঘৃণা ছড়ায়... তারাই সোস্যাল মিডিয়া স্টার। সেই ফর্মুলা অনুযায়ী আরাভ খান হিট হওয়া ঠিকই আছে। বরং বলা যায়, হিরো আলম এক যুগে যা করতে পারেনি তথাকথিত এই আরাভ খান এক সপ্তাহে তার চেয়ে বেশি মিডিয়ার মনোযোগ পেয়েছে। ভাইরালের ভাইরাস বিস্তারের এ গতি সত্যিই বিস্ময়কর!

আমাদের দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব, প্রকৃত ও ছদ্মবেকারের সংখ্যা, আমজনতার হাতে আধুনিক প্রযুক্তিপণ্য থাকা, হুজুগে মেতে ওঠা... এমন নানা বৈশিষ্ট্যের কারণে অনলাইন কনটেন্ট প্রোভাইডারদের জন্য এটা নিঃসন্দেহে বিশাল মার্কেট। ফলে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিকে দফায় দফায় মেরে ফেলা, নায়িকা সন্তান প্রসবের আগেই বাচ্চাসহ কনটেন্ট তৈরি, অবাস্তব-অসম্ভব নানা বিষয়ে ভিডিও প্রতিনিয়ত আপলোড হচ্ছে। সেগুলোর ভিউ সংখ্যাও বিস্ময়কর। অর্থাৎ দর্শক জানে খবরটা ভুয়া। তার পরও একটু উঁকি দেয় আর কি! 

যারা এগুলো করছে তাতে তাদের প্রত্যক্ষ লাভ রয়েছে। হয় অর্থ নয়তো যশ-খ্যাতি কামাই হচ্ছে। তাই বিদ্যমানদের পাশাপাশি নতুন কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে এমন অসংখ্য উপাদান প্রতিনিয়ত সামনে আসবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো—সরবরাহ থাকলেই কি তা প্রতিনিয়ত গ্রহণ করতে থাকব? একবার ভাবুন, আত্মীয়ের বাসায় বিশেষ অনুষ্ঠানে দাওয়াতে গেছেন। সেখানে ৬০ পদের খাবার রান্না করা হয়েছে। আপনি কি সব আইটেম খাবেন? অতি সামান্য করে হলেও? না, সেটা করবেন না, কারণ তাতে বদহজম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

ঠিক তেমনিভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজার বা লক্ষ পদের কনটেন্ট প্রতিনিয়ত আপনার সামনে আসছে। তার মাত্রা ক্রমে বাড়তেই থাকবে। এবার সব মাথায় নেবেন কিনা সেই সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। আগে আমরা বিনোদনের জন্য টেলিভিশনের সামনে বসতাম বা কিছুক্ষণ সংবাদপত্র পড়তাম। বাস্তব কারণেই তা খুব বেশি সময়ের জন্য হতো না। কিন্তু এখন হাতের মুঠোয় বিনোদন আসায় তা অধিকাংশের ক্ষেত্রেই মাত্রা অতিক্রম করছে। 

এতে নির্ধারিত কাজকর্ম, প্রার্থনা, বিশ্রাম সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

যদি নিজেকে প্রশ্ন করি, ঠিক কী অর্জনের জন্য এ সময়, শ্রম ও মনোযোগ দিচ্ছি? তার উত্তর স্পষ্ট নয়। তবুও এর পেছনে জীবনের এ গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো প্রতিনিয়ত ঢালছি। পাশাপাশি কে, কখন, কোন উদ্দেশ্যে একটি বিষয় সামনে আনে তা আমরা জানি না। অথবা সেই টপিক নিয়ে অতি উত্তেজিত হওয়ায় কার লাভ বা ক্ষতি হচ্ছে তাও বিবেচনা করার ‘বোধ’ থাকছে না। অথচ যারা সচেতনভাবে বিষয়টা পাবলিক করে এতে তাদের উদ্দেশ্য অর্জন হয়। আমাদের ‘যেই লাউ সেই কদু’ অবস্থা রয়ে যায়। তাই তাদের গতিতে আপনিও সক্রিয় হয়ে উঠবেন কিনা তা ভাবা জরুরি। 


ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘ভাইরালের ভাইরাস’ বইয়ের লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন