সময়ের ভাবনা

সরকারি অফিসের কর্মসংস্কৃতি ও বাংলাদেশ

এম এম মুসা

সরকারি অফিসে কর্মসংস্কৃতি বলতে সাধারণ মানুষ যেটা  বোঝে তা অনেকটাই নির্ভর করে সরকারি অফিসে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা বেশ মন্দ। তার সঙ্গে অন্যদের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে মানুষ একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা করে যে বাংলাদেশে সরকারি অফিসের কর্মসংস্কৃতি ভীষণ খারাপ। এ ধারণা নিশ্চয়ই অহেতুক নয়। তবে এটি মানুষের ধারণাগত।  সরকারি কর্মচারীদের একটা বড় অংশ কাজে খুব অবহেলা করেন, সিটে থাকেন না, অফিসে ব্যাগ রেখে বেরিয়ে যান ব্যক্তিগত কাজে, দীর্ঘদিন ফাইল আটকে রাখেন,  কোনো প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দেন না, প্রচুর ভুল করেন—এ রকম অভিযোগের অন্ত নেই। 

কিন্তু এ বাংলাদেশেই আবার অনেক সরকারি অফিস আছে, যেখানে দক্ষ কর্মচারী আছেন এবং তারা পরিশ্রম করতে সবসময় উন্মুখ হয়ে থাকেন। অথচ তাদের কোনো কাজ নেই। সুতরাং সরকারি অফিসের কর্মসংস্কৃতির সামগ্রিক চিত্রটা বুঝতে গেলে শ্রমের উৎপাদনশীলতা পরিমাপের নানা পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। সরকারি দপ্তরে কর্মী মূল্যায়ন ব্যবস্থা রয়েছে বটে, কিন্তু তার ভিত্তিতে কর্মীদের শাস্তি বা পুরস্কারের যথাযথ ব্যবস্থা করা এ দেশের রাজনৈতিক কাঠামোয় প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দলীয় বিবেচনায় পুরস্কৃত করার রীতির কারণে ভালো কর্মকর্তারা অধিকাংশ সময় বঞ্চিত হন। 

কাজের পরিবেশ পরিবর্তন ছাড়া সরকারি অফিসের কার্যক্রম পরিবর্তন করা কঠিন। সরকারি অফিসের কর্মসংস্কৃতি উন্নয়নে গবেষক জোয়ানা চারটি বিষয় পরিবর্তনের কথা বলেছেন। এগুলো হলো কাজের সুবিধা ও সমন্বয়ের জন্য পুরো জনপ্রশাসনকে একটি ছাতার আওতায় আনা, পেশাদারি জনপ্রশাসন তৈরি, ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম জনপ্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং জনপ্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। 

প্রতিষ্ঠানের কর্মসংস্কৃতি কীভাবে কাজ করে সেটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে  বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে ক্যামেরন ও কুইনের চিহ্নিত করা কর্মসংস্কৃতির চারটি মাত্রা বিবেচনার দাবি রাখে। এক. গোষ্ঠীতান্ত্রিক কর্মসংস্কৃতি (অন্তঃমুখী নমনীয়), দুই. আধিপত্যবাদী কর্মসংস্কৃতি (বহির্মুখী ও নমনীয়), তিন. বাজারনির্ভর কর্মসংস্কৃতি (বহির্মুখী ও নিয়ন্ত্রিত) এবং চার. উচ্চ কর্মকর্তানির্ভর কর্মসংস্কৃতি (অভ্যন্তরীণ ও নিয়ন্ত্রিত)। গোষ্ঠীতান্ত্রিক কর্মসংস্কৃতিতে কর্মপরিবেশ হয় বন্ধুত্বপূর্ণ, যেখানে নেতৃত্বদানকারী হন পিতার মতো স্নেহবৎসল। আধিপত্যবাদী কর্মসংস্কৃতি এমন একটি কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করে যেখানে আবিষ্কারকে উৎসাহিত করা হয়। বাজারনির্ভর কর্মসংস্কৃতিতে প্রতিযোগিতামূলক কর্মপরিবেশ বিরাজ করে যেখানে নেতা হন কঠোর। উচ্চ কর্মকর্তানির্ভর সংস্কৃতিতে আনুষ্ঠানিক কর্মপরিবেশ বিরাজ করে এবং নেতা সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। 

হফস্টেড সরকারি কর্মসংস্কৃতি উন্নয়নে পাঁচটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিতে বলেছেন। ক্ষমতা ও শক্তির দূরত্ব, অনিশ্চয়তা পরিহার, একক  বনাম দলবদ্ধ কার্যক্রম, পুরুষতান্ত্রিক বনাম নারীতান্ত্রিক ও দীর্ঘমেয়াদি বনাম স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা। বিভিন্ন গবেষণায় প্রতিষ্ঠানের কর্মসংস্কৃতি উন্নয়নে আরো কিছু বিষয় উঠে এসেছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানের মিশন এবং কর্মীর প্রতিশ্রুতি, অভিযোজনযোগ্যতা ও কর্মীর প্রতিশ্রুতি, সাংগঠনিক সম্পৃক্ততা ও কর্মীর প্রতিশ্রুতি, প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিকতা ও কর্মীর দায়বদ্ধতা উল্লেখযোগ্য। 

সাংগঠনিক সংস্কৃতি একমাত্রিক ধারণা নয়। গবেষকরা সাংগঠনিক সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা খুঁজে পেয়েছেন। সংগঠনের ভিন্নতর অনুশীলনের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক সংস্কৃতির ছয়টি মাত্রা চিহ্নিত করা হয়েছে। এ মাত্রাগুলো হলো এক. প্রক্রিয়ামুখী বনাম ফলাফলমুখী, দুই. কর্মচারীমুখী বনাম কর্মমুখী, তিন. সংকীর্ণতা বনাম পেশাদারিত্ব, চার. ওপেন সিস্টেম বনাম বন্ধ সিস্টেম, পাঁচ. শিথিল নিয়ন্ত্রণ বনাম কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং ছয়. আদর্শ বনাম ব্যবহারিক। সাংগঠনিক সংস্কৃতির এ ছয় মাত্রার সঙ্গে আরো তিনটি মাত্রাও চিহ্নিত করেছেন অনেকে। যেগুলো হলো এক. নিরাপত্তার প্রয়োজন (অনিশ্চয়তা পরিহার), দুই. কাজের কেন্দ্রিয়তা (চাকরির সম্পৃক্ততা) এবং তিন. কর্তৃত্ব (শক্তির দূরত্ব)।

সরকারি পিরামিডের সবচেয়ে উপরের স্তরে অবস্থান করেন প্রথম সারির আমলারা। আমলাদের মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন সেবা ছড়িয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের গবেষক ড. আলম আমলাতন্ত্রের চারটি মাত্রা চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো হলো শক্তি, অনিশ্চয়তা পরিহারের প্রবণতা, অংশগ্রহণ এবং দলগত অভিযোজন। সুশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো জবাবদিহি, যা স্বচ্ছতার মাধ্যমে আসে। 

বেশির ভাগ আমলাতন্ত্র দুটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য বহন করে—তারা বিচক্ষণতা উপভোগ করেন কিন্তু সম্পদের ক্ষতি করেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্তর নির্বিশেষে বিচক্ষণতা গুরুত্বপূর্ণ। বিচক্ষণতা একটি কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য, তবে এটি সাংস্কৃতিক কারণ নয়। সাংস্কৃতিক বিশ্বাস ও অনুশীলনের মিথস্ক্রিয়ায় এ কারণগুলো—ক্ষমতার দূরত্ব, অনিশ্চয়তা এড়ানো, অংশগ্রহণ এবং দলগত অভিযোজন—প্রথম সারির আমলাদের সুশাসন অনুশীলনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

সরকারি অফিসে সাধারণত উপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়। তার সঙ্গে বিভিন্ন দুর্নীতি উপর মহল থেকে নিচের তলা পর্যন্ত বিস্তৃত। যারা দুর্নীতিগ্রস্ত নন, তারাও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ফাইল যেতেও অনেক সময় আর্থিক লেনদেন করতে হয়। এ সংস্কৃতিতে একজন সৎ কর্মচারী বিনা লেনদেনে ফাইল ছেড়ে দিলে তার কপালে দুর্ভোগ অবশ্যম্ভাবী। এ সমস্যাগুলো কর্মসংস্কৃতিতে ছাপ ফেলে বৈকি।  বাংলাদেশের জনপ্রশাসন টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, স্বচ্ছতার সঙ্গে অর্থ ব্যয়সহ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এখান থেকে পরিত্রাণে সরকার কর্মচারীদের মধ্যে নৈতিকতার চর্চা বাড়ানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।  

বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র দেশের সামগ্রিক জনসেবার প্রতিনিধিত্ব করে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন এবং পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক পরবর্তী প্রশাসন থেকে এ ধারা  প্রবহমান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়। আমলাদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং গতিশীলতা বিবেচনা করে বাংলাদেশের সরকারি পরিষেবাগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হলো যে তারা ক্যাডার এবং নন-ক্যাডারে বিভক্ত। ক্যাডার পরিষেবাগুলোর স্বতন্ত্র শ্রেণীবিন্যাস এবং নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে—বিশেষায়িত এবং সাধারণীকৃত। ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস)   অন্তর্গত উচ্চপ্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। তারা সহকারী সচিব বা সমতুল্য পদে নিয়োগ পান এবং পদোন্নতির মাধ্যমে সিনিয়র সচিব পদে যেতে পারেন। তারা এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে যেতে পারেন। অন্যদিকে নন-ক্যাডার পরিষেবার সদস্যদের নির্দিষ্ট বিভাগে নিয়োগ করা হয়। যে বিভাগে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে সে বিভাগের মধ্যেই তাদের কাজ করতে হয়। এ আমলাদের চাকরিজীবনে সীমিত প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকে। বাংলাদেশের প্রথম সারির আমলাতন্ত্রে ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার উভয় পরিষেবার কর্মকর্তা রয়েছেন। 

বর্ন মাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইফাত জাহান ও কভেনট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক থান হুয়েন ও গিডিয়ন ম্যাস বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের ওপর একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তাদের সুপারিশ ছিল সরকারি কর্মকর্তাদের নিজস্ব দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করা। এর জন্য তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান, ভালো কাজের জন্য পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য শাস্তির কথাও উল্লেখ করেছেন তারা। পাশাপাশি জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলেছেন। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি জনপ্রশাসন পুরস্কার প্রবর্তনের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করে তাদের উদ্ভাবনী অবদানের স্বীকৃতি দিচ্ছে। এ উদ্যোগ এরই মধ্যে জনসাধারণের বৃহত্তর কল্যাণে অক্লান্ত পরিশ্রমী কর্মকর্তাদের মনোবল বাড়িয়েছে। সম্প্রতি অনেক কর্মকর্তা প্রশংসনীয় কাজ করেছেন এবং জনসাধারণের সেবার উন্নতির জন্য অসংখ্য ‘‌উদ্ভাবনী ও সংস্কার প্রকল্প’ গ্রহণ করেছেন। গবেষণা অনুসারে, সরকারকে কর্মকর্তাদের প্রতিযোগিতা এবং পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ করা উচিত। সরকারের উচিত প্রশংসনীয় কাজ করা কর্মকর্তাদের জন্য একটি ‘‌আন্তর্জাতিক এক্সপোজার ট্যুর’-এর ব্যবস্থা করা। 

ভারতের দ্বিতীয় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন সরকারি অফিসের কর্মসংস্কৃতি পরিবর্তনে কিছু সুপারিশ করে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের পুনর্বিন্যাস, কাজ ও দায়িত্বের মধ্যে অভিন্নতা আনা, পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু, শক্তিশালী জবাবদিহি ব্যবস্থা প্রবর্তন, দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান, প্রযুক্তির ব্যবহার, অভ্যন্তরীণ সুশাসন জোরদার, নৈতিকতার চর্চা বাড়ানো ও আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো। এছাড়া আরো কিছু সুপারিশ কমিশন করেছিল যার মধ্যে অফিসের কর্মসংস্কৃতির উন্নয়নে ব্যবস্থা গ্রহণ, কর্তৃত্ব নয় অংশগ্রহণভিত্তিক কর্মপরিবেশ তৈরি উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাজ্যের নোলান কমিটি সরকারি কর্মচারীদের কর্মসংস্কৃতি উন্নয়নে চারটি বিষয়ে জোর দিতে সুপারিশ করেন—নিঃস্বার্থতা, সত্যতা, অখণ্ডতা ও বস্তুনিষ্ঠতা। বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে একই ধরনের সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। 

কাজে ফাঁকি এবং দুর্নীতি বন্ধ করা ব্যয়সাপেক্ষ এবং বহু সমস্যাসংকুল। সরকারি উৎপাদনশীলতা এবং সেবার মূল্য নির্ধারণ আরো শক্ত। কারণ এর অনেকগুলোরই যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ ও প্রশাসন, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি সেবামূলক কাজের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা যায় না। ফলে এ ধরনের পরিষেবার সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের কাজের মূল্য নির্ধারণ করাও বেশ কঠিন। তবে আরো পথ রয়েছে। যে পরিষেবাগুলোর আপেক্ষিক মূল্যায়ন করা যায়, সেগুলোর গুরুত্বও পরিমাপ করা সম্ভব। এর সাহায্যে পরিষেবাটির আর্থিক মূল্যের একটি ধারণা তৈরি করা সম্ভব। ধরা যাক, এক কিলোমিটারের মধ্যে অগ্নিনিরাপত্তা ও থানা অফিস আছে এমন জায়গায় বাড়ি-জমি-ফ্ল্যাটের দাম কত, তার হিসাব তো হাতের কাছেই রয়েছে। এর ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের উৎপাদনশীলতার মূল্যায়ন করা সম্ভব।

জাপান বরাবরই সময়ানুবর্তিতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। তাই তো জাপান পৃথিবীর অন্যতম ধনী রাষ্ট্র। তবে আজকের জাপান ঠিক এমনটা ছিল না কয়েক বছর আগেও। ২০১৩ সালে জাপানে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৬ শতাংশ। ২০২০ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশে। জাপানের প্রত্যেক নাগরিকের গড় সম্পদ ১ লাখ ১০ হাজার ৪০৮ মার্কিন ডলার, যা আমেরিকার নাগরিকের গড় সম্পদের  চেয়ে প্রায় ৪৪ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার বেশি। জাপানের জিডিপি ৪৮ হাজার ৩৩২ মার্কিন ডলার। জাপানিদের গড় বেতন বার্ষিক ২৮ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ মাসিক গড় বেতন ২ হাজার ৩৫২ মার্কিন ডলার। জাপানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য শিক্ষা, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য খাতে। দেশটির শতভাগ মানুষই শিক্ষিত। জাপানে স্বাস্থ্য খাতের পয়েন্ট ৯৩ দশমিক ৩। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান অর্থনীতির ভিত শক্ত করার কাজে হাত দেয় এবং প্রযুক্তিতে স্থায়ী অবস্থান নিশ্চিত করে। 

জাপানে এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, নির্ধারিত সময়ের কয়েক সেকেন্ড আগে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ায় সরকারি বিবৃতি প্রকাশ করে যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। ২০১৮ সালে কোবে শহরের ওয়াটার ওয়ার্কস ব্যুরোর এক ৬৪ বছর বয়সী কর্মীকে জরিমানা করা হয়েছিল। কারণ নির্দিষ্ট সময়ের ৩ মিনিট আগে তিনি লাঞ্চ করা শুরু করেছিলেন। নির্ধারিত সময়ের ২ মিনিট আগে বের হয়ে যাওয়ায় জাপানের ফুনাবাশি সিটির ‘বোর্ড অব এডুকেশন’ অফিসের বহু কর্মীর বেতন কাটা যাওয়ার উদাহরণ এখনো জ্বলন্ত। কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালের মে থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আগে বেরোনোর ৩১৬ ঘণ্টা শনাক্ত করেছে এবং যথাযথভাবে শাস্তির ব্যবস্থাও করেছিল। শাস্তিপ্রাপ্ত কর্মীদের মধ্যে ছিলেন ৫৯ বছরের এক নারী। অন্যরাও যাতে কাজ শেষ করে একটু আগে বেরোতে পারে, তাতে সাহায্য করেছিলেন তিনি। তিনি অফিসের হাজিরা খাতার দায়িত্বে ছিলেন। আগামী তিন মাস তার বেতনের ১০ শতাংশ কেটে নেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। ওই নারীর লগআউট করার সময় বিকাল ৫টা ১৫ মিনিট। জাপানিরা ২ মিনিট আগে সরকারি অফিস ছাড়লে বেতন কেটে নেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে দেশের সরকার। আর বাংলাদেশ? কখন অফিসে এলেন আর কখন অফিস ত্যাগ করলেন, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায় সরকারি অফিসগুলোয়? মিলের জায়গাটি তৈরি করতে হবে এক্ষেত্রেও। তবেই জাপানের সঙ্গে তুলনা করার জায়গাটি তৈরি হতে পারে। উন্নয়ন হচ্ছে বাংলাদেশে। সেই উন্নয়ন হয়তো আমাদের সহায়তাও করবে সামনের দিকে ধাবমান হতে। কিন্তু জাপানের মতো হতে হলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।

বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে সরকারি অফিসে কর্মচারীদের হাজিরা পর্যবেক্ষণের জন্য বায়োমেট্রিক ডিজিটাল হাজিরা যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে সব স্থানে। বায়োমেট্রিক কার্ডের পরিসংখ্যান বলছে, হাজিরা বেড়েছে। কিন্তু তার মানেই কি কর্মসংস্কৃতির অগ্রগতি? আমলাদের একাংশের দাবি, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর রয়েছে। অনেককেই সরকারি কাজে বাইরে যেতে হয়। বায়োমেট্রিক কার্ড বা পাঞ্চিং কার্ডে শুধু অফিসে ঢোকা বা বেরোনোটা নিশ্চিত করা যায়। তার বেশি কিছু নয়। ফলে এক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেই কর্মীদের গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজ রাখতে হবে। সরকারি অফিসের বেহাল কর্মসংস্কৃতি নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। তাদের বক্তব্য, মানসিকতা না বদলালে যে যন্ত্রই বসানো হোক না কেন, কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবে না। যে কাজ দুদিনে হয়, তা মেটাতে এখানে মাসের পর মাস পেরিয়ে যায়। তাহলে সরকারি কর্মীদের বায়োমেট্রিক কার্ড দিয়ে লাভ কী?

সরকারি কর্মসংস্কৃতির বিষয়টি জটিল। নানা ধরনের পরিসংখ্যানের সাহায্যে কর্মসংস্কৃতি মূল্যায়নের একটা মাপকাঠি নিশ্চয়ই তৈরি করা যায়। পরিষেবার খরচ কত, কতজনকে পরিষেবা দেয়া হলো, তাদের মূল্যায়ন কী রকম, কাজের পরিবেশ সন্তোষজনক কিনা, কর্মীরা চাকরি ছাড়তে চান কিনা ইত্যাদি সবকিছুই সেই মাপকাঠি নির্মাণের কাজে লাগতে পারে। একটা প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যায়, কর্মসংস্কৃতি উন্নত করার সদিচ্ছা সরকারের আছে তো?


এম এম মুসা: সহযোগী সম্পাদক, বণিক বার্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন