জ্বীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়িয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। এশিয়ার অনেক দেশ এখন সক্ষমতার অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। সে লক্ষ্যে এগিয়েছে চীন, ভারত, পাকিস্তান ও মালয়েশিয়া। এক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। এক দশকে দেশের মোট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩ শতাংশ পার হতে পারেনি। নবায়নযোগ্য জ্বালানিবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি এজেন্সি (আইআরইএনএ) তার সদস্যরাষ্ট্রগুলোর নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। ‘রিনিউয়েবল ক্যাপাসিটি স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে ২২২টি দেশ ও অঞ্চলের নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সক্ষমতা তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের বছরভিত্তিক উৎপাদন সক্ষমতার চিত্রও এতে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে, সেখানে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের সক্ষমতা মাত্র ২ দশমিক ৯০ শতাংশ। আইআরইএনএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৩ সালে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের সক্ষমতা ছিল ৩২৯ মেগাওয়াট। ১০ বছরে অর্থাৎ ২০২২ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৭৭৫ মেগাওয়াটে। অর্থাৎ এ দীর্ঘ সময়ে দেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৪৪৬ মেগাওয়াট।
সংস্থাটির দেয়া তথ্যানুযায়ী, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার দিক থেকে এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় পেছনে পড়ে আছে বাংলাদেশ। উৎপাদনে এগিয়ে থাকা দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, চীন ও মালয়েশিয়া।
এশিয়ার মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে চীন। গত ১০ বছরে দেশটি মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি সক্ষমতা বাড়িয়েছে। বর্তমানে চীনের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১১ লাখ ৬০ হাজার ৭৯৯ মেগাওয়াট। ২০১৩ সালে চীনের মোট সক্ষমতার ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ। দক্ষিণ এশিয়ায় গত এক দশকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে ভারত। দেশটির মোট উৎপাদন সক্ষমতার ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ। বিশেষত সৌর, বায়ু ও হাইড্রো বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে দেশটিতে।
এছাড়া মালয়েশিয়া মোট সক্ষমতার ২৩ দশমিক ৩, আফগানিস্তান ৬৪ ও ফিলিপাইন ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের সবচেয়ে বেশি সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। গত বছর এ খাত থেকে ২৯৫ গিগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। একই সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির খরচও কমেছে।
দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের সক্ষমতা সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৯৬৬ মেগাওয়াট। সে হিসাবে বিদ্যুতের মোট উৎপাদন সক্ষমতায় এর অংশগ্রহণ মাত্র ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ।
২০০৮ সালে সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা ঘোষণা করে। সেই লক্ষ্য অনুযায়ী, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ২০১৫ সালে ৫ শতাংশ ও ২০২০ সালে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু তা অর্জন হয়নি।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) তথ্যানুযায়ী, দেশে উৎপাদিত ৯৬৬ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের মধ্যে ৭৩২ মেগাওয়াট আসছে সৌরবিদ্যুৎ থেকে। বাকি ২৩৪ মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে বায়ু, পানি ও অন্যান্য উৎসের মাধ্যমে। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের মধ্যে গ্রিডে সরবরাহ হচ্ছে ৬০৬ মেগাওয়াট এবং বাকি ৩৫৯ মেগাওয়াট গ্রিড এলাকার বাইরে।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের সক্ষমতা বাড়াতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। চলতি বছরের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগও রয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের। এরই অংশ হিসেবে দেশে বেশকিছু পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে জোর তদারকি চালানো হচ্ছে। এর আগেও গত এক দশকে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা করে সরকার। তবে সেসব উদ্যোগ খুব বেশি বাস্তবায়ন হয়নি।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যে কারণে এ খাত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে জানান, ২০০৮ সালে নবায়নযোগ্য জ্বালানির নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু এ পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাজ করা যায়নি। সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎ ছাড়া বলার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি। অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিবেচনায় গত এক দশকে এ খাতে যেমন বিনিয়োগ পাওয়া যায়নি, তেমনি উদ্যোক্তাও ছিল কম। এখন এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে। তার কারণ জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং বিপরীতে নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির খরচ কমে আসে।
এদিকে, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবহারে বছরে বাংলাদেশ ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি সাশ্রয় করতে পারে বলে জানিয়েছে ন্যাশনাল ব্যুরো অব এশিয়ান রিসার্চ (এনবিআর) নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সংস্থা। গবেষণায় বলা হয়, দ্রুত দুই হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন করতে হবে। ডিজেলচালিত পুরো সেচ ব্যবস্থাকে সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। এতে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ডিজেল ও এলএনজি আমদানি করতে হবে না। এ দুটো পদক্ষেপ নিলে বছরে ৫ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমানো সম্ভব বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকারের নেট মিটারিং গাইডলাইন নির্দেশিকা দিয়েছে। এ পদ্ধতিতে শিল্পে ও বাণিজ্যিক ভবনের ছাদে রুফটফ সোলার প্যানেলের মাধ্যমে একজন উদ্যোক্তা বিদ্যুৎ ব্যবহারের পাশাপাশি বিক্রিও করতে পারবেন। এরই মধ্যে শিল্পে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছেন ব্যবহারকারীরা। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির খরচ কমে আসায় এ খাতের সম্ভাবনাও দেখছেন বিশ্লেষকরা।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রধানত, পর্যাপ্ত জমির সংকুলান করতে না পারা এবং প্রযুক্তির উচ্চমূল্য। এ কারণে এ খাতে পর্যাপ্ত প্রকল্প গ্রহণ করা যায়নি। তাই বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়নি, একই সঙ্গে বিনিয়োগও আসেনি। তবে এখন এসব প্রতিবন্ধকতা অনেকটাই কেটে গেছে। এখন জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি লাভজনক। নেট মিটারিং গাইডলাইনের কারণে কারখানা ও বাণিজ্যিক ভবনের ছাদে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ হয়ে উঠেছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নও সম্ভব। তাছাড়া সঠিকভাবে ভূমি জরিপ করা হলে কৃষিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য পর্যাপ্ত জায়গার সংকুলান করা যেতে পারে। বর্তমান বাস্তবতায় সামনের দিনগুলোয় নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ার ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে।’