সময়ের ভাবনা

রক্তিম স্বাধীনতার যোগ্য প্রতিদান যেরূপ

মো. আবিদ মঈন খান

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে সর্বদা একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট হয়ে থাকবে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের চরম বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক শাসনের শিকার হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এ ঐতিহাসিক ঘটনা থেকেই বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার জন্য অতুলনীয়, বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। টানা নয় মাসের যুদ্ধের পর বিজয় অর্জন হয়। আমাদের এ ছোট দেশটি আজ ৫২ বছরে উল্লেখযোগ্য নানা অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং একই সঙ্গে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক আন্দোলনের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন নিয়ে শপথ করা হয়েছিল স্বাধীনতার সময় সে রকম আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকে বাংলাদেশ টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন, একটি প্রাণবন্ত বেসরকারি খাত গড়ে তোলা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক বাজারে অবস্থান তৈরি করে নিজেদের যোগদান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। এত কিছুর পরও স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন চাকা নির্বিঘ্নভাবে চলার জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্র। বাংলাদেশ গত অর্ধশত বছরে নিজেদের গণতন্ত্রের কোন পরিমাপকে নিজেদের দাঁড় করতে পেরেছে যার ফলে আমরা উন্নয়ন ও অগ্রসরমাণ হয়েছি।

এটা বলা ভুল হবে না যে স্বাধীনতার সংগ্রাম সর্বদাই অন্যায় শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার সুরক্ষিত করার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে পরিচালিত হয়েছে। কর্তৃত্ববাদ প্রতিরোধ, অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তি প্রচার এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষাপূরণে গণতন্ত্র সবচেয়ে সফল হাতিয়ার হিসেবে বিশ্বে প্রমাণিত হয়েছে। স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের অনুসন্ধান একে অন্যের সঙ্গে জড়িত এবং একে অন্যকে এরা শক্তিশালী ও সমর্থন করে। বহু দেশেই স্বাধীনতাকে গণতান্ত্রিক শাসনের একটি নতুন যুগের সূচনা হিসেবে গণনা করা হয়, যেখানে নাগরিকরা তাদের নিজস্ব ভাগ্য গঠন এবং আরো সমৃদ্ধ এবং ন্যায়সংগত সমাজ গড়ে তোলার ক্ষমতা পায়।

১৯০০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল মাত্র ৭৮টি, কিছু ক্ষেত্রে মতান্তরে ৭৭টি। বর্তমানে মোট স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৫টি। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে ১১৭টি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো নতুন নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হবে। এখন প্রশ্ন মাথায় আসতেই পারে—আধুনিককালে এসে রাষ্ট্রগুলো কীভাবে সৃষ্টি হলো? বর্তমান জাতিরাষ্ট্রগুলো কীভাবে গঠিত হলো সেটি নিয়ে চার্লস টিলির একটি অসাধারণ তত্ত্ব রয়েছে, যেটা ‘Bellicose Theory’ নামে পরিচিত। টিলির মতে, বর্তমানের আধুনিক জাতিরাষ্ট্রগুলো বলপ্রয়োগ, যুদ্ধ, সংগ্রাম ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে, স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধ করে লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলো সৃষ্টি হয়েছে, আর ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ করে আফ্রিকার অধিকাংশ রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে, চার্লস টিলির মতে, বর্তমান রাষ্ট্রগুলো যেন যুদ্ধ, সংঘাত ও বলপ্রয়োগেরই এক ধরনের ফলস্বরূপ। 

আধুনিক স্বাধীন রাষ্ট্রে যেহেতু গণতান্ত্রিক পন্থায় ধনী-গরিব নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিক অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সেহেতু বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশ তাদের রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রকে বেছে নিয়েছে। প্রতিটি রাজনৈতিক সিস্টেমে কিছু ত্রুটি থাকবেই। কিছু ত্রুটির জন্য পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলে না দিয়ে বরং ত্রুটিগুলো সংশোধন করাই শ্রেয়। আমাদের দেশকেও সে পথে আরো বেশি কার্যকরী দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ রাখতে হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য। প্রাচীন ও মধ্যযুগে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে অসচেতন থাকলেও আজকের একুশ শতাব্দীতে এসে রাষ্ট্রের নাগরিকরা আগের মতো অশিক্ষিত নয়। শিক্ষার হার প্রতিনিয়ত বাড়ায় মানুষ এখন অনেক সচেতন। তাই অ্যারিস্টটল গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হিসেবে যে ‘‌উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসন’ চিহ্নিত করে বলেছিলেন সেটা আর এখন নেই। শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি সেই শৃঙ্খলা মজবুত করে গড়ে তুলেছে। কারণ বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ইন্টারনেট, ক্যাম্পেইন, ডিবেট, জনসভা, মিটিং, আলোচনা সভা প্রচারণা ইত্যাদির কল্যাণে রাষ্ট্রের সব ইস্যু নিয়ে জনগণের জানাশোনার পরিধি বেড়েছে। তাই একুশ শতকের গণতন্ত্র এবং অ্যারিস্টটলের আমলের গণতন্ত্রের মধ্যে অনেক ফারাক আছে। একুশ শতকের গণতন্ত্র হচ্ছে ‘‌সচেতন জনতার শাসন’। ‘‌গণতন্ত্র’ শব্দটি আমাদের কাছে শুধু একটি ধারণা বা কনসেপ্ট মনে হচ্ছে। তবে কোনো দেশে গণতন্ত্রকে আমরা মোটাদাগে মোট পাঁচটি মানদণ্ডের মাধ্যমে দেখতে পারি। নিম্নে উল্লিখিত এ পাঁচ মানদণ্ডের সবগুলো একটি রাষ্ট্রে বিদ্যমান থাকলে তখন আমরা বলব, সে রাষ্ট্রে পরিপূর্ণ গণতন্ত্রের চর্চা ঠিক পথে রয়েছে। 

গণতন্ত্র পরিমাপক হিসেবে সর্বপ্রথম দেখা হয়, একটি রাষ্ট্রে নির্দিষ্ট কয়েক বছর পরপর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় কিনা। অর্থাৎ Periodic Election নিয়মিত নির্বাচন অন্যতম একটি গণতন্ত্রের পরিমাপক। দ্বিতীয়ত দেখা হয়, প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ নামে তিনটি পৃথক বিভাগ রয়েছে। আইন বিভাগের কাজ রাষ্ট্রের জন্য আইন তৈরি করা, শাসন বিভাগের কাজ সেই আইনগুলো বাস্তবায়ন করা এবং বিচার বিভাগের কাজ সেই আইনগুলো কেউ না মানলে কিংবা ভঙ্গ করলে তাকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। অর্থাৎ এ তিন বিভাগ স্বাধীনভাবে তাদের কার্যক্রম চালাবে। তাই গণতন্ত্রের দ্বিতীয় পরিমাপক হলো প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা। এখানে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি রাষ্ট্রের বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কিনা দেখতে হবে। তৃতীয় মানদণ্ড হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতা। একটি রাষ্ট্রের সব জনগণ হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান মোটামুটি সব ধর্মের মানুষই একটি রাষ্ট্রে বসবাস করে। তাই ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকদের ওপর কোনো বৈষম্য করা যাবে না। ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে রাষ্ট্রের সব নাগরিককে সমান হিসেবে গণ্য করতে হবে। সহজ কথা, ধর্মের ভিত্তিতে কারো সঙ্গে বৈষম্য করা যাবে না, সবাইকে সমানভাবে দেখতে হবে। এরপর যেটা দেখা হয় সেটা হলো বহুত্ববাদ। গণতন্ত্রের মানদণ্ডে এ বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একুশ শতকের বিশ্বে বহুত্ববাদ ধারণাটি খুবই প্রভাবশালী। বহুত্ববাদের মানে হলো ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই সমান। অর্থাৎ বহুত্ববাদ সব বিষয়কেও অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিটি দেশই গঠিত হয়েছে ভিন্ন কয়েকটি জাতিসত্তা নিয়ে। আজকের আধুনিক সিঙ্গাপুর গঠিত হয়েছে চাইনিজ, মালয়, ইন্ডিয়ান ও ইউরেশিয়ান এ চার প্রধান জাতি নিয়ে। বহুত্ববাদ ধারণায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে এবং শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে। গণতন্ত্রের জন্য বহুত্ববাদ আবশ্যক।

গণতন্ত্র পরিমাপক হিসেবে পঞ্চম ও সর্বশেষ মানদণ্ডটি হলো, সংবিধান মেনে চলা যাকে সাংবিধানিকতা বা Constitutionalism বলা হয়ে থাকে। দেখতে হবে রাষ্ট্র সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র চলছে কিনা। এ সাংবিধানিকতার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জনসভা করার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতা, সংবাদ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি। উল্লিখিত পাঁচ মানদণ্ড দিয়েই আমরা বিশ্বের যেকোনো দেশসহ আমাদের নিজেদের গণতন্ত্র পরিমাপ করতে পারি। 

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যাত্রা অপরিসীম ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছিল। বাংলাদেশের গণমানুষ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছে ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণের জন্য গণতন্ত্র অনুসরণ অপরিহার্য। গণতন্ত্র একটি ন্যায়সংগত ও ন্যায়সংগত সমাজের ভিত্তি যা ব্যক্তিগত অধিকার ও স্বাধীনতাকে মূল্য দেয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে উৎসাহিত করে এবং জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। গণতান্ত্রিক নীতিগুলো সমুন্নত রাখা জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে সক্ষম করে এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অগ্রগতিকে উৎসাহিত করে। অসংখ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সত্ত্বেও বাংলাদেশ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মতো ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে এ ধারা অব্যাহত রাখতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সুশাসন বাড়াতে হবে এবং গণতন্ত্র সুসংহতকরণে বাধা সৃষ্টিকারী অবশিষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে। একটি সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে বাংলাদেশের সাফল্য নির্ভর করছে গণতান্ত্রিক নীতি সমুন্নত রাখার ওপর। 

মো. আবিদ মঈন খান: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন