স্বাধীনতা দিবস

অর্থনৈতিক সুশাসন নিশ্চিতে করা হোক অঙ্গীকার

আজ ২৬ মার্চ, বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্যতম গৌরবের দিন। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের এ দিনে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বমানচিত্রে অভ্যুদয় হয় নতুন এক স্বাধীন রাষ্ট্রের। মর্যাদাপূর্ণ এ দিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাঙালি জাতির অবিস্মরণীয় নেতা, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যার দূরদর্শী আহ্বানে সর্বস্তরের বাঙালি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী ৩০ লাখ শহীদকে এবং সম্ভ্রম হারানো দেশমাতৃকার বীর নারীদের। আরো স্মরণ করছি স্বাধীনতা যুদ্ধে নিবেদিত ভূমিকা রাখা জাতীয় চার নেতাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোগিতা করা বিভিন্ন রাষ্ট্র ও ব্যক্তির প্রতিও আমাদের অপরিসীম কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

মূলত অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা আর সীমাহীন বৈষম্যের প্রতিকারেই বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়। ১৯৭১ সালের এ দিনে স্বাধীনতা ঘোষণার পর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিপক্ষে বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পর বাংলাদেশকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সীমিত সম্পদের ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খেতে হলেও বাংলাদেশ পথ হারায়নি। ক্রমাগত অর্থনৈতিক উন্নয়নের বদৌলতে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ ইমার্জিং টাইগার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। 

২০১৫ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে মর্যাদা পেতে সক্ষম হয়। বর্তমানে বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। 

উন্নতি আর সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময় স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য পাঁচ বছরের প্রস্তুতিমূলক সময় পার করছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যাত্রার মাধ্যমে ২০৩৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২০তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে—এ আশাবাদ করা হচ্ছে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত করতে ‘রূপকল্প ২০৪১’ ঘোষণা করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। নিজেদের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে আমরা খাদ্য রফতানি করতে পারছি। আমাদের এখন খাবারের জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হয় না। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটের পূর্বাভাস থাকলেও বিকল্প উপায়ে সমাধানের সব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। 

পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ। তবে বাংলাদেশ যেমন অর্জন করেছে, ঠিক তেমনি আমাদের অনেক ঘাটতিও রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। নিকট অতীতে আমাদের দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে গেছে, যা ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো এখনো বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ আস্থাভাজন নয়। পোশাক শিল্প রফতানি ও বৈদেশিক শ্রমবাজারে নতুন বাজার সন্ধান করার ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের ধাক্কায় পোশাকের ক্রয়াদেশ কমে যাচ্ছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকলেও বিদেশে দক্ষ জনশক্তি রফতানির চেয়ে শুধু কর্মী প্রেরণেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। যে কারণে দেশে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে রেমিট্যান্স আসছে না। আবার আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর উদ্যোগ এখনো ফলপ্রসূ হয়নি। 

অবকাঠামো খাতে গত কয়েক দশকে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে গত বছর উদ্বোধন হয়েছে বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা বহুমুখী সেতুর। এর ফলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল। দেশের প্রথম মেট্রোরেল চালু হয়েছে, যা রাজধানী ঢাকার অধিবাসীদের স্বস্তি দিচ্ছে। এটি পুরো আঙ্গিকে চালু হলে যানজট লাঘবে বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নদীর তলদেশের টানেল এবং গণপরিবহন ব্যবস্থার সম্প্রসারণসহ দেশের সড়ক খাতে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ফলে সারা দেশের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও সড়কপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিমাণ বেড়েই চলেছে। দেশ-বিদেশে পদ্মা সেতু প্রশংসিত হলেও দুর্ঘটনার কারণে সেখানে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করতে হয়েছে।

ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির ফলে দেশের বাজেটের আকার বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি জিডিপি বেড়েছে। অর্থনীতির ধাপগুলোয় বাংলাদেশের উন্নতি ইতিবাচক হলেও বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি বলে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন। করোনা মহামারী-পরবর্তী সময়ের ধাক্কা এবং চলতি বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী মন্দার ঢেউ এখন বাংলাদেশেও এসে পড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে, ব্যাংকগুলোয় ডলার সংকটের ফলে আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলায় স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষকে সঞ্চয় ভেঙে খেতে হচ্ছে। নতুন করে সঞ্চয়পত্র খোলার চেয়ে নগদায়নই বেশি হচ্ছে।

ব্যাংকে আমানত কমে যাচ্ছে, জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সবার নগদ অর্থের দরকার হচ্ছে। চলমান রমজান মাসে বর্ধিত মূল্যে খাদ্যসামগ্রী কিনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না পাওয়ার ঘোষণা এলেও তার প্রতিফলন পাওয়া যায়নি।

বলা যায়, বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক সংকটের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে আর্থিক খাতে সুশাসনের দেখা মিলছে না। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক খাতে স্থবিরতা, সিন্ডিকেটের ফলে আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য, ডলার সংকটে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা এমন নানা সংকটে দেশ হাবুডুবু খাচ্ছে। এ সময়ে গৃহীত সুচিন্তিত পদক্ষেপের ফলে আমরা সব সংকটের ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে পারব সে আশা করা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে খুবই সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও শ্রীলংকার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তারা সংকটকালীন সময়ে সঠিক পথে না থাকায় তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। 

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তির পথে অনেকাংশে অগ্রসর হয়েছে। ই-টেন্ডার থেকে শুরু করে নাগরিকদের সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বর্তমানে ইন্টারনেটের ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পেলেও তথ্যের নিরাপত্তায় ঘাটতি ঠিকই রয়ে গেছে। দেশের নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি অনুষঙ্গ জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তি ও তথ্য সংশোধনে নাগরিকরা এখনো ভুক্তভোগী হচ্ছে। বর্তমান সময়ে ই-কমার্সের প্রসার হলেও এক্ষেত্রে অনেক নেতিবাচক উদাহরণ তৈরি হয়ে গেছে। গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করতে হলে এখনো এ খাতের উদ্যোক্তাদের অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। 

দেশে কর্মসংস্থান তৈরিতে উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া লক্ষ করা যায় না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে শুধু সনদধারীদের সংখ্যাই বাড়ছে, উচ্চশিক্ষিত তরুণদের শিক্ষাজীবনে অধ্যয়ন করা বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও নারীর প্রতি সমান অধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পরিবর্তন হয়নি।

রাজধানী ঢাকা শহর এখন বসবাসের অযোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার এত বছর পরও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হয়নি। শহরের নদী-নালা, খাল-বিলগুলো দূষিত হয়ে যাচ্ছে। বায়ুদূষণে বিশ্বের সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর নগরীর তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে ঢাকা। 

ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দেশের নিম্নবিত্ত মানুষ খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছে। মধ্যবিত্তদের আর্থিক অবস্থাও করুণ হচ্ছে। স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের মুহূর্তে আলোকবাতি সাজানো ভবনের পাশেই রাস্তায় ঘুমানো মানুষ পাওয়া যাবে। তাদের ক্ষুধা ও আশ্রয়ের কথা রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। যে অর্থনৈতিক বঞ্চনা প্রতিকারে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো বাংলাদেশ দেখেনি। যে কৃষকের উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমে আমাদের পেটে অন্ন আসে, দেশের শিল্প-কারখানা সচল থাকে, সে কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না। সব মিলিয়ে আমাদের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা এখনো প্রত্যাশিত পর্যায়ে উপনীত হয়নি। এক্ষেত্রে সুশাসনের অভাব প্রচণ্ডভাবে লক্ষণীয়, আমরা অবশ্যই স্বাধীনতা প্রাপ্তির আনন্দ উল্লাস করব, কিন্তু বৈশ্বিক সংকটের এ সময়টিতে দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি ও আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। আমরা আশা করব, সংকটের এ সময়ে বাংলাদেশ অবশ্যই সঠিক পথেই থাকবে, তাহলেই পূরণ হবে আমাদের স্বাধীনতার দৃপ্ত প্রত্যাশা। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন