বরিশাল জেনারেল হাসপাতাল

শতবর্ষী জরাজীর্ণ ভবনে ঝুঁকি নিয়ে চলছে চিকিৎসাসেবা

এম. মিরাজ হোসাইন, বরিশাল

বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের শতবর্ষী ভবনে প্রায়ই পলেস্তারা খসে আহত হচ্ছেন রোগী ও চিকিৎসক ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

শতবছরের জরাজীর্ণ ভবনেই ঝুঁকি নিয়ে চলছে বরিশাল জেনারেল (সদর) হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা। ভবনটি মেরামতের জন্য একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে দীর্ঘদিনেও কোনো সুফল মেলেনি। ফলে বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই চলছে এখানকার চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। মাঝেমধ্যে ভবনের পলেস্তারা খসে পড়ছে চিকিৎসক রোগীর ওপর।

হাসপাতালের শতবর্ষী নম্বর ভবনের একটি কক্ষে ছাদের পলেস্তারা গত বুধবার খসে পড়ে আহত হন তিনজন। তবে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান ওই কক্ষে সেবা প্রদানকারী মেডিকেল অফিসার ডা. মির্জা লুৎফর রহমান।  

প্রতিষ্ঠার প্রায় শতবছর পর তিনটি ভবন ভেঙে ফেলা হলেও এখনো দুটি ভবন দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। আর দুটি ভবনের একটিতে আউটডোর চিকিৎসা অন্যটিতে জরুরি বিভাগের কার্যক্রম রয়েছে। তবে হাসপাতালের কম্পাউন্ডেই প্রায় ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে একটি ১২ তলাবিশিষ্ট নতুন হাসপাতাল ভবন। আর এজন্য ভেঙে ফেলা হয় শতবছরের পুরনো পাঁচটি ভবনের মধ্যে তিনটি।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৮৪৭ সালে বরিশালে একটি চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি প্রতিষ্ঠিত হয়। একজন সাব অ্যাসিস্টান্ট সার্জনের পরিচালক ছিলেন। বরিশালের সদর হাসপাতালের পূর্বে এটিই ছিল বরিশালের একমাত্র চিকিৎসালয়। বরিশালের সদর হাসপাতাল ভবন ১৯১০ সালে নির্মিত হয়। পূর্ববঙ্গের লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ল্যান্সলট হেয়ার ১৯১০ সালের ডিসেম্বর ভবনের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ১৯১২ সালের ১৩ জুলাই হাসপাতাল ভবন উদ্বোধন করেন। তখন একসঙ্গে পাঁচটি ভবনে শুরু হয় এই হাসপাতালের কার্যক্রম।

ভবন নির্মাণে তখন বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান চাঁদা দেয়। এসব ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে নলিনী গুপ্ত এসআইই, বরিশাল জেলা বোর্ড, বঙ্গীয় সরকার, রাজা প্রফুল্লনাথ ঠাকুর, নবাব আহসান উল্লাহ, রায় চরণ সাহা, বরিশাল পৌরসভা, রাজেশ্বর রায় চৌধুরী, বরিশাল ঘোড় দৌড় কমিটি, ইন্ডিয়া রেডক্রস সোসাইটি, হাজী ইসমাইল চৌধুরী, আর জে. জে. ব্রাউন এবং বরিশাল বার। এছাড়া রাজাপুরের সাতুরিয়ার জমিদার মেহেরুন্নেছা তখন ভবনের জন্য জমি দান করেছিলেন।

১৯৪৩ সাল পর্যন্ত একটি কমিটি হাসপাতাল পরিচালনা করত। ১৯৪৪ সালে কমিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার হাসপাতালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে। ওই বছরই বঙ্গীয় জনস্বাস্থ্য সচিব হ্যালন সদর সাব-ডিভিশনাল হাসপাতালকে তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত করেন। সময় সরকার বরিশাল সদর হাসপাতালের দায়িত্ব গ্রহণ করে। হাসপাতাল পরিচালনার জন্য একটি উপদেষ্টা কমিটি ছিল। সিদ্ধান্ত হয় সরকার হাসপাতালের সম্পদ হস্তান্তর করতে পারবে না। ১৯৪৪ সালের ১৯ মার্চ ম্যানেজিং কমিটি প্রাদেশিক সরকারকে হাসপাতালের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করে। জেলা বোর্ড পৌরসভা হাসপাতালে অনুদান দেবে। এমপি বর্মণ সময় হাসপাতাল কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন।

বরিশাল জেনারেল হাসপাতাল উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সমাজসেবীরা এগিয়ে আসেন। ১৯২৫ সালে বাইসারীর ইন্দ্রনাথ দত্ত তার মা গোলকমনির নামে লেবার ওয়ার্ড নির্মাণ করেন। ১৯৩৩ সালে ঈশ্বরচন্দ্র সেন আলোকমনি মহিলা ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন। কালী চন্দ্র ১৯৩৮ সালে শশীমুখী অপারেশন থিয়েটার নির্মাণ করেন। ১৯৩৬ সালে জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ দস্তিদার কলেরা ওয়ার্ড নির্মাণ করেন। জমিদার বিনয় গুপ্ত ব্যারিস্টার নলিনী গুপ্ত ১৯৩৮ সালে তাদের পিতা জগচ্চন্দ্র মাতা মুক্তাকেশীর নামে দুটি পেয়িং ওয়ার্ড নির্মাণ করেন।

১৯১২ সালে ২০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের যাত্রা হয়। নব্বইয়ের দশকে ৮০ শয্যায় উন্নীত করা হয় জেনারেল হাসপাতাল। সব শেষ ২০ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ড নিয়ে ১০০ শয্যায় উন্নীত হয় বরিশাল জেনারেল হাসপাতাল। কিন্তু দিন দিন রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় জেনারেল হাসপাতালের পরিসর বাড়ানোর দাবি ওঠে সর্বমহলে। আর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে  জেনারেল হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এজন্য একটি ১২ তলা ভবন নির্মাণাধীন।

২৫০ শয্যা হাসপাতালের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি ধাপে ধাপে চিকিৎসক, নার্স, তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ করা হবে বলে জানান হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) মলয় কুমার বড়াল।

মেডিকেল অফিসার ডা. মির্জা লুৎফর রহমান বলেন, ‘মাঝেমধ্যেই হাসপাতাল ভবনের ছাদের পলেস্তারা ভেঙে পড়ছে। বুধবার রোগী দেখছিলাম হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো মনে হলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে রোগীদের গায়ে পড়ে। বিষয়টি আরএমওকে জানিয়েছি। ভবনের কাজ গর্ণপূর্ত বিভাগের। তাদের বারবার জানিয়েও কোনো ফল হয়নি।

সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) মলয় কুমার বড়াল জানান, বুধবার হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার ১৮ নম্বর রুমে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে চিকিৎসকের কিছু হয়নি। তবে একজন রোগী আহত হয়েছেন। তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। হাসপাতালের নম্বর ভবনটির শতবছরের বেশি পুরনো বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভবনটি মেরামতে একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে।

বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান বলেন, ‘খবর পেয়েই ভবনটি পরিদর্শন করে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয়া হয়েছে। এখন তারা বিষটি দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন