দুই শতাধিক কৃষি উদ্যোক্তা তৈরির কারিগর সোহেল রানা

আরমান হোসেন রুমন, নওগাঁ

কৃষিতে সাফল্যের পর নিজের খামারে প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন সোহেল রানা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

নওগাঁর ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা সাপাহারের গোডাউনপাড়া এলাকায় প্রায় ১৫০ বিঘা জমিতে বিস্তৃত ‘বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্ক’। পাঁচ বছর আগে এ জমি পতিত অবস্থায় থাকলেও বর্তমানে সেখানে আম, বরই, মাল্টা, ড্রাগন, গ্লাডিওলাসসহ দেশী-বিদেশী শতাধিক ফল ও ফুলের গাছে ছেয়ে গেছে। ইজারা নেয়া পতিত এ জমিতে কৃষিভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার মাধ্যমে বছরে প্রায় অর্ধকোটি টাকা আয় হচ্ছে। আয়ের পাশাপাশি বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছেন জেলার কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানা।

তরুণ কৃষি এ উদ্যোক্তার পেছনের গল্প খুঁজতে গেলে অনেকটাই অবাক হতে হবে। নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার দিবর ইউনিয়নের রূপগ্রামে কৃষক পরিবারের জন্ম তার। ২০০৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে পড়াশোনা শেষে একটি জাতীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। ছয় বছর সাংবাদিকতা পেশায় থাকার পর চাকরি ছেড়ে কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। শিখতে শুরু করেন আধুনিক কৃষির নানা কলাকৌশল। এরপর জেলা শহর থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে সাপাহার উপজেলার গোডাউন পাড়া এলাকায় ১০৫ বিঘা পতিত জমি ইজারা নিয়ে কৃষিকাজে যুক্ত হন তিনি। খামারের নাম দেন বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্ক। মাত্র ৩ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে সেখানে দুই বছরের মধ্যেই গড়ে তোলেন মিশ্র ফল বাগান। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাগানটি এখন প্রায় ১৫০ বিঘা ছাড়িয়েছে। ২০২১ সালে সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে জাতীয় যুব পুরস্কার অর্জন করেন সোহেল রানা। তিন বছরে দুই শতাধিক নতুন উদ্যোক্তা গড়ে তুলেছেন তিনি নিজেই।

সম্প্রতি বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচ বছর আগের সেই পতিত জমি এখন মিশ্র ফল ও বাহারি রঙের ফুলে ছেয়ে গেছে। ভেতরে গেলে প্রথমেই চোখে পড়বে পলিনেট হাউজ। যেখানে বিভিন্ন ধরনের বিষমুক্ত সবজি, জারবেরা ও গ্লাডিওলাস ফুল চাষ করা হয়েছে। চলতি বছর জানুয়ারিতে লাগানো গ্লাডিওলাসে প্রথমবারের মতো ফুল এসেছে। গ্লাডিওলাস ছাড়াও সোহেল রানার বাগানে ক্যাকটাস, অর্কিড, নীল অপরাজিতা, বনসাই, গোলাপ, রজনীগন্ধাসহ প্রায় ১০০ রকমের শোভাবর্ধনকারী গাছ রয়েছে। ফলদ গাছের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৩০ জাতের আম গাছ রয়েছে। প্রতি বছর সোহেল রানার বাগানের আম যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হয়। আম ছাড়াও সোহেল রানার বাগানে রয়েছে বরই, মাল্টা, ড্রাগন, প্যাসন, অ্যাভাকাডো, মালবেরি, ত্বিন ফলসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন জাতের ফল। বইচি, অরবরই, খুদিজাম, আঁশ ফলসহ ১১ প্রকার বিলুপ্ত ফল ও ১২ প্রকারের ভেষজ গাছও রয়েছে বাগানে। বাগানের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে দর্শনার্থীর জন্য রয়েছে বাঁশ ও খড়ের চালার নিচে বসার স্থান। আবার দর্শনার্থীর রাতযাপনে বাগানের মধ্যেই তৈরি করা হয়েছে সিনথেটিক কাপড়ের তৈরি ছয়টি তাঁবু। বর্তমানে এ পার্ক কৃষিতে নতুনত্ব, বিপ্লব ও বিকাশ ঘটাতে এবং উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পাশাপাশি ভ্রমণপিপাসুদেরও চাহিদা মেটাচ্ছে। প্রতিদিন জেলার ১১টি উপজেলাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে অর্ধশতাধিক কৃষি অনুরাগী সোহেল রানার এ পার্ক ভ্রমণ করতে আসছেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব দর্শনার্থীর আধুনিক কৃষির নানা কলাকৌশল শেখাচ্ছেন সোহেল রানা। ব্যক্তি উদ্যোগে চাষীদের প্রশিক্ষণে গড়ে তুলেছেন ‘বরেন্দ্র কৃষক প্রশিক্ষণ ও কৃষি উন্নয়ন কেন্দ্র’। 

নওগাঁর পোরশা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের মাদ্রাসা ইসলামপুর গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা জুনায়েদ শাহ্ বলেন, ‘চার বছর আগে ধানের ব্যবসা করতাম। ব্যবসায় মাঝেমধ্যে লোকসানের মুখে পড়তে হতো। হঠাৎ একদিন সোহেল ভাইয়ের সফলতার গল্প পত্রিকায় দেখতে পেলাম। এর পরই চলে গেলাম বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কে। আধুনিক পদ্ধতিতে মাল্টা ও আম চাষে নানা কলাকৌশল শেখালেন তিনি। সেখান থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে বাগান গড়ে তুলেছি। বর্তমানে আমার পাঁচ বিঘা জমিতে ৯০০টি মাল্টা গাছ এবং ১০ বিঘায় গৌরমতী ও আম্রপালি জাতের আম গাছ রয়েছে। যেখান থেকে বছরে কমপক্ষে ১২ লাখ টাকা আয় হচ্ছে।’

পত্নীতলা উপজেলার নির্মইল ইউনিয়নের বটতলী গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা মাসুদ রানা বলেন, ‘‌আম চাষে সহজেই লাভবান হওয়ার কিছু কলাকৌশল সোহেল রানা আমাকে শিখিয়েছেন। তিন বছর আগে ১০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ করে বারি-৪ এবং আম্রপালি জাতের আম চাষ শুরু করেছিলাম। বর্তমানে আমার বাগান ২৭ বিঘা ছাড়িয়েছে। যেখান থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা আয় হচ্ছে।’

বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের উদ্যোক্তা সোহেল রানা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কৃষিপ্রধান দেশ হলেও আমাদের দেশে কৃষিভিত্তিক পর্যটনকেন্দ্র খুব একটা গড়ে ওঠেনি। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কৃষিকেন্দ্রিক পর্যটন অনেক বিস্তৃত। দেশকে সেই আধুনিকতায় এগিয়ে নিতে বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের মাধ্যমে আমিও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি চাই আমার মতো দেশে আরো অনেক উদ্যোক্তা সৃষ্টি হোক। এজন্যই পর্যটক আকৃষ্ট করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।’

নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা একেএম মনজুরে মওলা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌ সোহেল রানার সফলতায় অনেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে এখন মিশ্র ফল বাগান গড়ে তুলছেন, যা সত্যিই প্রশংসনীয়।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন