মিয়ানমার থেকে সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে রোগাক্রান্ত গরু

আনিসুর সুমন ও ছৈয়দ আলম

ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

মিয়ানমারের গবাদিপশুর মধ্যে ক্ষুরারোগ (ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ) ছড়িয়ে পড়েছে, কারণে দেশটি থেকে পশুর আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে থাইল্যান্ড। রফতানি নিষেধাজ্ঞার ক্ষতি পোষাতে মিয়ানমারের ব্যবসায়ীরা চোরাচালানের মাধ্যমে কক্সবাজার বান্দরবানের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গবাদিপশুর পাচার অব্যাহত রেখেছেন। সম্প্রতি চোরাচালান আরো বেড়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সীমান্তসংশ্লিষ্ট অনেক সূত্র। প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত চোরাচালান বন্ধ করা না গেলে দেশের গবাদিপশুর মধ্যে ক্ষুরারোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে সীমান্ত দিয়ে অবৈধ চোরাইপথে আসা গরু-মহিষের কারণে বিপাকে পড়েছেন দেশীয় পশু খামারি ব্যবসায়ীরা। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রামু, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িসহ একাধিক উপজেলায় বিপুলসংখ্যক মিয়ানমারের গবাদিপশু ঢুকেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। এসব পশুর অধিকাংশ রাখা হচ্ছে রামুর গর্জনিয়া ইউনিয়ন, কচ্ছপিয়া চকরিয়ার বিভিন্ন স্থানে। এমনকি মিয়ানমার থেকে আসা ওই পশুর হাঁটও বসছে ওই এলাকায়।

স্থানীয় কোনো কোনো খামারি অভিযোগ তুলেছেন, সীমান্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে হাটে প্রচুর বর্মি গরু-মহিষ বিক্রি হচ্ছে। দেশী গরু বিক্রি করতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি বিক্রি করতে গেলে দেশী গরুকেও চোরাচালানের পশু আখ্যা দিয়ে জব্দ করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা বলছেন, চোরাচালানের গবাদিপশু বিক্রির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশ্যেই হয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এর মাত্রা অনেকটাই বেড়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে নিয়ে বিতর্ক একের পর এক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে হাটে চোরাচালানের গবাদিপশু বিক্রি বন্ধে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে প্রশাসন। যদিও তা খুব একটা কার্যকর নয় বলে দাবি করছেন স্থানীয় খামারিরা।

তারা জানিয়েছেন, হাটে দেশী গরু-মহিষ বিক্রি করতে এখন স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বারের প্রত্যয়নপত্র প্রয়োজন পড়ছে। প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে হয়রানিতে পড়ছেন দরিদ্র কৃষক-খামারিরা। সরেজমিনে রামুর বৃহৎ গর্জনিয়া পশুর হাটে গিয়ে দেখা গেছে, বাজারের চতুর্দিকে বিজিবির সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করছে। তারা গত কয়েকবারের বাজারে মিয়ানমারের পশু উঠতে দেয়নি। সেখানে দেশীয় গরু পর্যন্ত প্রত্যয়ন ছাড়া বাজারে নিতে দেয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর কোরবানির ঈদের আগে থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন অন্তত শতাধিক গরু-মহিষ দেশে প্রবেশ করে। পাচারের পথ হিসেবে আলীকদম নাইক্ষ্যংছড়িকে বেছে নিয়েছে চোরাকারবারিরা। এছাড়া সীমান্তের আরো বেশকিছু পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারের গবাদিপশু দেশের বাজারে ঢুকে পড়ছে। পাচারের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিকভাবে একে অন্যের প্রতিপক্ষ হলেও পাচার-সংশ্লিষ্টতা ব্যবসার ক্ষেত্রে তারা একাট্টা বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। হাটে পশু বিক্রি থেকে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি আবার নিয়ন্ত্রণ করছে বেশ কয়েকটি সক্রিয় চোরাচালান সিন্ডিকেট।

জানা গেছে, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী পার্বত্য জেলা বান্দরবানের আলীকদম-লামা এবং নাইক্ষ্যংছড়ি হয়ে প্রবেশ করা এসব পশুর হাট বসছে চকরিয়ার মানিকপুর বাজার, ফাঁসিয়াখালীর হাঁসের দিঘি ডুলাহাজারার রংমহল এলাকায়। এখান থেকে প্রতিদিন শতাধিক গবাদিপশু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি বিজিবি অভিযান চালিয়ে লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, রামুর গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া চকরিয়ার মানিকপুর থেকে প্রচুর গরু-মহিষ জব্দ করে। এছাড়া নাইক্ষ্যংছড়ির নিয়ন্ত্রণাধীন তীরডেপা বিজিবি ক্যাম্প থেকে মানিকপুর এলাকায় অভিযান চালিয়েও গরু জব্দ করা হয়েছে। পরে জব্দকৃত ওই পশু উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে ওই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়।

কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু ইসমাঈল মো. নোমান বণিক বার্তাকে বলেন, মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে আসা এসব গবাদিপশু নিয়ে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো ক্ষুরারোগ। রোগ একবার ছড়িয়ে পড়লে দেশীয় গবাদিপশুও আক্রান্ত হবে। অন্যদিকে বর্মি গরু ঢোকায় স্থানীয় খামারিরা লোকসানের মুখে পড়ছেন। আগামী কোরবানির ঈদের আগে যদি এসব গবাদিপশুর চোরাচালান বন্ধ করা না যায়, তাহলে খামারি কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

স্থানীয় খামারি আমানুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমান বাজারে পশুখাদ্যের দাম বেশ চড়া। তার পরও বেশি দামে খাদ্য কিনে গবাদিপশু লালন-পালন করছি। কিন্তু চোরাইপথে গরু ঢোকার কারণে বাজারে দাম পাচ্ছি না। লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাছাড়া বর্মি যেসব গবাদিপশু দেশে আসছে, এগুলো খুবই রোগাক্রান্ত। আমাদের খামারে বড় করা গবাদিপশুকে উল্টো পাচারের গরু অভিযোগ তুলে বিক্রিতে বাধা দেয়া হচ্ছে। আমরা পড়েছি অনিশ্চয়তায়।

আয়ুব আলী ছুরত আলম নামে আরো দুজন ব্যবসায়ীর অভিযোগ, চোরাই গরু জব্দ করতে গিয়ে স্থানীয় খামারি কৃষকের পালিত গরু জব্দ করে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি। এতে বেকায়দায় পড়েন খামারিরা।

ভুক্তভোগীরা জানান, রামু নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে অনেকদিন ধরে মিয়ানমারের চোরাই গরু প্রবেশ করছে। এসব গরু জব্দ করতে পাড়ায় পাড়ায় অভিযান জোরদার করা হয়। একদিকে মিয়ানমারের গবাদিপশু ঢোকায় লোকসান, পাশাপাশি নিজেদের পোষা গরু বিক্রি করতে না পারায় শঙ্কার কথা জানিয়েছেন এখানকার ক্ষুদ্র খামারিরা।

জানা গেছে, কক্সবাজারের রামু উপজেলার ঐতিহ্যবাহী গর্জনিয়া গরুর হাটকে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে বহু গবাদিপশুর খামার। কয়েক বছর ধরে খামারের সংখ্যা আরো বেড়েছে। পারিবারিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবেও গরু পালন করা হচ্ছে অঞ্চলে। সম্প্রতি ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর এখানকার খামারিরা তাদের বিক্রয়যোগ্য গরু হাটে তুলতে পারছেন না। একাধিক খামারি জানিয়েছেন, তারা হাট থেকে বাছুর কিনে খামারে লালন-পালন করে বড় করেছেন। কিন্তু অভিযানে তাদের এসব গরু জব্দ করে নিলামে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে যাদের খামারে বড় গরু রয়েছে তারা বিভিন্ন  বাধার কারণে হাটে পর্যন্ত গবাদিপশু তুলতে পারছেন না। সরেজমিনে ওই বাজারের আশপাশের বিভিন্ন মোড়ে কড়া পাহারা দেখা যায়। হাটে নেয়ার পথে স্থানীয় চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র দেখানোর পরই কেবল ছাড় পাচ্ছেন গরু মালিকরা।

চোরাইপথে আসা রোগাক্রান্ত গবাদিপশুর ব্যাপারে বণিক বার্তার কাছে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রাণিসম্পদ ভেটেরিনারি কর্মকর্তা ডা. মো. সাহাবউদ্দিন। তিনি বলেন, ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ খুবই বিপজ্জনক। সামান্য গাফিলতিতে ভাইরাসঘটিত ছোঁয়াচে রোগ সবখানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের গবাদিপশু ঢুকছে বলে শুনেছি। তবে বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে পশু প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দায়িত্ব। বর্তমানে বাংলাদেশে মাংসের দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ তাই বিদেশ থেকে পশু আমদানির কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই।

সবাইকে সজাগ থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরো বলেন, সীমান্তবর্তী জেলা উপজেলা দিয়ে যাতে এসব রোগাক্রান্ত অবৈধ পশু প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি দেশীয় গরুর সঙ্গে এসব রোগাক্রান্ত বিদেশী পশু যাতে কোনোক্রমে মিশে না যায়, সে বিষয়েও প্রত্যেক খামারিকে নজর দিতে হবে।

স্থানীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সীমান্তের কড়া পাহারায় বিজিবি সবসময় প্রস্তুত রয়েছে। চোরাচালান অবৈধ গরু প্রবেশ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে গরুর হাট বসা পাড়া-মহল্লায় পাচার বন্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী।

গত ফেব্রুয়ারি পোয়ামুহুরী সীমান্ত থেকে ১৪৪টি বার্মিজ গরু জব্দের তথ্য জানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। চট্টগ্রামের দুর্গম সীমান্তবর্তী পোয়ামুহুরী খঞ্জনপাড়া এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে এসব গরু জব্দ করে বিজিবি। বিজিবির রামু ব্যাটালিয়নের (৩০ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খান গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খবর পান পাহাড়ি এলাকা দিয়ে (সীমান্ত পিলার ৫৬০-এর নিকটবর্তী) বিপুলসংখ্যক গরু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। টহল দলের উপস্থিতি টের পেয়ে চোরাকারবারিরা গরু রেখে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। শুল্ক কর্মকর্তা স্থানীয়দের উপস্থিতিতে পোয়ামুহুরী বিওপিতে নিলামে তুলে জব্দকৃত গরু কোটি ৭৪ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।

ঘটনায় লে. কর্নেল মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খানের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সীমান্ত সুরক্ষার পাশাপাশি আভিযানিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে মাঠপর্যায়ে চোরাচালান প্রতিরোধসহ সব ধরনের সীমান্ত অপরাধ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন