পর্দায় ২৫ মার্চের ভয়াবহতা

সাবিহা জামান শশী

আজ ভয়াল ২৫ মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের এ দিনে মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তাদের পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালির কণ্ঠ রোধ করতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বর্বরোচিত গণহত্যা শুরু করে। বাংলাদেশের মানুষের ওপর অত্যাচার চালানো এ কালরাতের চিত্র বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তথ্যচিত্র, সাহিত্য, নাটক-সিনেমা ও ওয়েব কনটেন্টে উঠে এসেছে। ওই সময়ের গণহত্যার এ নজির ও যুদ্ধের ভয়াবহতার এ ছবি সেলুলয়েডেও ধরা দিয়েছে। নিজেকে ও পরিবারকে বাঁচাতে হাজারো মানুষের লড়াই, শহরে হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড ও গোলাবারুদের শব্দে অগণিত মানুষের ছুটতে থাকা। শহরজুড়ে লাশের মিছিল। নারকীয় সে নাশকতার চিত্র এমনিভাবেই উঠে এসেছে বাংলাদেশের একাধিক চলচ্চিত্রে। 

উল্লেখযোগ্য এ সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘গেরিলা’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ও ‘জয়যাত্রা’। এ তিন সিনেমায় ঢাকা, জেলা শহর ও গ্রামে ২৫ মার্চের ঘটনা দেখানো হয়েছে সাবলীলভাবে। দেশের নন্দিত চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ ‘গেরিলা’ সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন। ২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির এ সিনেমা সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ হয়েছে। গেরিলার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান, ফেরদৌস, এটিএম শামসুজ্জামান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শতাব্দী ওয়াদুদ, শম্পা রেজা, গাজী রাকায়েত প্রমুখ। এ সিনেমায় সাংবাদিক হাসান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফেরদৌস আহমেদ ও তার স্ত্রী বিলকিসের চরিত্রে জয়া আহসান। রাত ১১টার মধ্যে বাসায় ফেরার কথা বলে সাংবাদিক হাসান আর ফেরে না। অপেক্ষায় থাকে তার স্ত্রী। পর্দায় দেখা যায়, পরদিনও সে স্বামীকে খুঁজে পায়নি। এদিকে পাকিস্তানি সেনাদের ট্যাংক নিয়ে ঢাকার রাস্তায় টহল চলে। জীবন বাঁচাতে মানুষের পালানোর দৃশ্য এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে দেশীয় অস্ত্রে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টায় একদল বাঙালি পুলিশ দেখানো হয়েছে গেরিলায়। সে রাতে আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়ি ও ভোরের দিকে অগণিত মানুষের লাশের দুর্বিষহ অতীত বড় পর্দায় উঠিয়ে আনেন নির্মাতা।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল রচিত কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালনা করেন ‘আমার বন্ধু রাশেদ’। এ সিনেমায় দিনাজপুর শহরের গল্প দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন জেলা শহরে ৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে নারকীয় তাণ্ডব চালায় পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী। আমার বন্ধু রাশেদ সিনেমায় এ দিনের হামলার দৃশ্য না দেখালেও আতঙ্কিত মানুষের চিত্র দেখানো হয়েছে। দিনাজপুরের একটি মহল্লার উৎকণ্ঠিত মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে এবং সবাই দেশের পরিস্থিতি নিয়ে নানা কথা বলতে থাকেন। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগানে মিছিল শুরু হয়। এরই মধ্যে একটি দৃশ্যে দেখা যায়, অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ছেলেকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘ঢাকায় মিলিটারি আক্রমণ করেছে। হাজার হাজার মানুষ মেরে ফেলেছে। বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, ছাত্রজনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।’

অন্যদিকে তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ‘‌জয়যাত্রা’ সিনেমায় ২৫ মার্চের ভয়াবহতা না দেখিয়ে গ্রামের আতঙ্কিত মানুষের ভাবনা ফুটিয়ে তুলেছে। ভয়াল এ রাতের বর্ণনা শুনে গ্রামের সাধারণ মানুষের মনের অবস্থার চিত্র দেখানো হয়েছে জয়যাত্রা সিনেমার একটি অধ্যায়ে। 

বর্তমান সময়ে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ওটিটি প্লাটফর্ম। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ঘটনা নিয়ে ২০২০ সালে জনপ্রিয় ওটিটি প্লাটফর্ম হইচইয়ে মুক্তি পায় ওয়েব সিরিজ ‘একাত্তর’। শিবব্রত বর্মনের চিত্রনাট্যে থ্রিলার ঘরানার এ ওয়েব সিরিজ পরিচালনা করেছেন তানিম নূর। এতে অভিনয় করেছেন মোস্তফা মন্ওয়ার, ইরেশ যাকের, মিথিলা মুখার্জি, নুসরাত ইমরোজ তিশা, মোস্তাফিজুর নূর ইমরান, তারিক আনাম খান, শতাব্দী ওয়াদুদ, দীপান্বিতা মার্টিন প্রমুখ। আট পর্বের ওয়েব সিরিজটিতে দেখা যায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে ‘অপারেশন ব্লিৎজ’-এর পরিকল্পনা করেছিল পাকিস্তানি আর্মি। এদের বশ্যতা অস্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে কিছু মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ক্যাপ্টেন সিরাজ নামের এক বাঙালি অফিসার গোপনে নিরীহ বাঙালির ওপর হতে যাওয়া অপারেশনের ফাইল জোগাড় করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের হাতে তুলে দিতে চায়। তার পেছনে ধাওয়া করে পাকিস্তানি মেজর ওয়াসিম। ২৫ মার্চের রাতের প্রেক্ষাপটে এক প্রেম-ভালোবাসার কাহিনী একাত্তর।

বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম অধ্যায় ১৯৭১। তাই ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের নানা ঘটনা নির্মাতারা পর্দায় তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘ওরা ১১ জন’। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত যুদ্ধভিত্তিক এ সিনেমায় সত্যিকারের অনেক যোদ্ধাও অভিনয় করেছিলেন। এতে আরো ছিলেন রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, এটিএম শামসুজ্জামানের মতো শিল্পীরা। ওরা ১১জন সিনেমার মধ্য দিয়েই বাংলা সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপনের সূচনা। এ ধারা আজও বজায় রেখেছেন বর্তমান সময়ের নির্মাতারা। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন