নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে নতুন নীতিমালা

লক্ষ্য অর্জনে নীতিমালা বাস্তবায়নে জোর দেয়া হোক

নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২২-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে। উদ্দেশ্য, মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ৪০ শতাংশে উন্নীত করা। অতীতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের প্রকল্প নিয়ে ব্যর্থ হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশ বুঝি নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য উপযোগী নয়। কাকে প্রকল্প দেয়া হচ্ছে, তাদের এ ধরনের প্রকল্প করার সক্ষমতা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা বিনিয়োগকারীরা পান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে একই সুযোগ-সুবিধা তারা পান না। এ বৈষম্য দূর করা দরকার। পোর্টফোলিও স্ট্যান্ডার্ড, স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং, ফাইন্যান্সিং, ট্যাক্স ইনসেনটিভ ইস্যুগুলো নতুন নীতিমালায় সন্নিবেশ করা জরুরি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সরকার প্রণীত নীতিমালার মধ্যে একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক ও সাযুজ্যের ঘাটতি লক্ষণীয়, যা দূর করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ হিসেবে সৌরবিদ্যুতের পরিচিতিই বেশি। এ সৌরবিদ্যুৎ ছড়িয়েছে প্রধানত গ্রাম, মফস্বল ও চরাঞ্চলে। সোলার সিস্টেমের ওয়াটপ্রতি দাম যখন ৪৫০ কিংবা ৫০০ টাকা ছিল, তখন থেকেই এটি ব্যবহারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ সামাজিক গ্রহণযোগ্যতারই সাক্ষ্য দেয়। এর ফলে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গেই বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ সোলার হোম সিস্টেমের ব্যবহার শুরু হয়েছে। অথচ কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতের দাম বিশ্বব্যাপী ৭২ শতাংশ কমে গেলেও বাংলাদেশে এ বিদ্যুৎ নীতিনির্ধারণী মহলে মূল ধারার ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। আর ঠিক এ কারণেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পূর্বঘোষিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়নি। অন্যদিকে প্রযুক্তি আর চিন্তার অভিনবত্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎ দিনকে দিন পরিণত হচ্ছে, অতিক্রম করছে সব বাধা। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার জন্য এখন রয়েছে ভাসমান সৌরপ্রযুক্তি, কৃষিজমিতে ফলন আর সৌরবিদ্যুৎ একসঙ্গে করার জন্য ‘সোলার শেয়ারিং’ আর বিকেন্দ্রীভূত গ্রিড ব্যবস্থাপনার মতো সমাধান। অন্য সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো সৌর কিংবা বায়ুবিদ্যুৎ করতে বিশাল এলাকা অধিগ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই। পতিত অকৃষিজমি, দখল হয়ে যাওয়া নদীর পাড় এবং বাড়ির ছাদের মতো স্থানে সোলার প্যানেল আর বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী এবং অগভীর সমুদ্র এলাকা বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য খুবই উপযোগী। সেই সঙ্গে সৌর আর বায়ুবিদ্যুতের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য রয়েছে দাম কমতে থাকা ব্যাটারির সুবিধা। এভাবে শিল্প, কৃষি আর ব্যবসা-বাণিজ্যে এ বিদ্যুৎ ক্রমেই নিজের দখল বাড়াচ্ছে। বড় বিষয় হলো, পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেই হবে না, তার যথাযথ বাস্তবায়নে উপযুক্ত পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, অর্জন করা গেছে তার এক-তৃতীয়াংশ। ফলে আর্থিক ক্ষতি যেমন হচ্ছে, বাড়ছে তেমনি পরনির্ভরশীলতা। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াতে সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় বদল আনতে হবে। একই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো নবায়নযোগ্য শক্তিকে কাজে লাগিয়েই জ্বালানি খাতকে এগিয়ে নিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, রাশিয়া, ভারত বিশ্বের সব থেকে বেশি নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্টেটে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের জন্য রয়েছে আলাদা আইনি বাধ্যবাধকতা এবং ফিড-ইন-ট্যারিফের ব্যবস্থা। বিশ্বের সব থেকে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে চীনে। চীন সব থেকে বড় বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করেছে। চীনে ১০০টিরও বেশি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ভারতে পৃথিবীর সব থেকে বড় সোলার পাওয়ার প্লান্ট রয়েছে; যা ৬৪৮ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন। জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। নরডিক দেশগুলো নবায়নযোগ্য শক্তিবান্ধব আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এর প্রসার ঘটাতে সাহায্য করছে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ নবায়নযোগ্য শক্তি বৃদ্ধির জন্য নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে, এক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যও পেয়েছে দেশটি।  ভারতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বেশ এগিয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে মাত্র তিন বছরে ভারতে ১ লাখ ১০ হাজার সৌরবিদ্যুতে চালিত পানির পাম্প চালু হয়েছে। জার্মানিতে একক উৎস হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন শীর্ষে। সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ নির্ভরশীলতা দিয়েই ওই বছর জার্মানি ইউরোপে শীর্ষ বিদ্যুৎ রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়। অন্যদিকে ভারতের চতুর্থ ব্যস্ততম কোচিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পুরোটাই চলছে সৌরবিদ্যুতে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সুবিধা মূলধারার অর্থনীতিতে আত্তীকরণ করতে দেশে দেশে ঘোষিত হচ্ছে নিত্যনতুন লক্ষ্যমাত্রা। ভারত ২০৩০ সালের মধ্যেই ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ অজীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েছে। আর জার্মানির ক্ষেত্রে এ লক্ষ্যমাত্রা ২০৩৫ সালের মধ্যে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ। বিপরীতে ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও ভারত থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। 

এক দশকের বেশি সময় ধরে আমাদের দেশে বিবিধ উদ্যোগ নেয়া হলেও অংশীজনদের মতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে অর্থায়ন সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করা যায়নি। ঋণের সুদহার এখনো বেশি। আবার নবায়নযোগ্য জ্বালানি, যেমন সৌর বা বায়ুবিদ্যুতের বিনিয়োগ উঠে আসার সময়কাল অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে বেশি হলেও প্রায়ই আলাপ-আলোচনায় শোনা যায়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পাঁচ বছরের বেশি মেয়াদি ঋণ দিতে উৎসাহী নয়। ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার বাংলাদেশে খুব ধীরে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সবুজ প্রকল্পে সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ সালে সবুজ প্রকল্পে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম চালু করে। এর আওতায় প্রথম দিকে সুদের হার বেশি ছিল, কিন্তু ধাপে ধাপে তা কমানো হয়েছে। বিশেষ করে করোনা মহামারীর সময় সবুজ বিনিয়োগে প্রণোদনার অংশ হিসেবে, সুদের হার ৯ শতাংশের পরিবর্তে ৭-৮ শতাংশ এবং ঋণের মেয়াদ আট বছরের বেশি করার সুযোগ দেয়া হয়। জুলাই ২০২২-এ সুদের হার আরো একবার কমিয়ে ৫-৬ শতাংশ করা হয়। কাজেই বহুদিন যে সমস্যাগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের বিনিয়োগে অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা হতো, তা বহুলাংশে দূর হয়েছে বলা যায়। হয়তোবা সব অংশীজনের কাছে এ তথ্যগুলো এখনো পৌঁছেনি। এক্ষেত্রে তথ্য সরবরাহ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোগ নিতে পারে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন ছাড়াও দেশীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকল নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে থাকে। উদ্যোক্তারা এ সুযোগ গ্রহণে যেন উৎসাহিত হয়, তার পদক্ষেপ নিতে হবে। 

বড় প্রকল্প যেমন ৫০ মেগাওয়াট (পিক) বা তার বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হলে কয়েকটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান একত্রে গোষ্ঠীবদ্ধ/সংঘবদ্ধ ঋণ দিতে পারে। বিভিন্ন খাতের বড় প্রকল্পে গোষ্ঠীবদ্ধ/সংঘবদ্ধ ঋণের অনেক সফল উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দেশে বাস্তবায়িত বিভিন্ন নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে প্রযুক্তি সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর কাজের মানের ওপর ভিত্তি করে একটি তালিকা করতে পারে। সঙ্গে একটি রেটিংয়ের ব্যবস্থাও চালু করতে পারে। নির্দিষ্ট সময় পর প্রযুক্তি সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর রেটিং পর্যালোচনা করা যেতে পারে। প্রকল্পের জন্য জমি পাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই দুরূহ হয়ে পড়ে। যে কারণে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করার পরও অনেক প্রকল্প আলোর মুখ দেখে না। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, বেশ কয়েকটি প্রকল্প ২০২২ সালে কিংবা ২০২৩-এর মাঝামাঝি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা থাকলেও সেগুলো এখনো পরিকল্পনাধীন। উপযুক্ত জমি না পাওয়া কিংবা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে জমির যে মূল্য ধরা হয়েছিল পরবর্তী সময়ে তা অনেক বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করে। এক্ষেত্রে সরকার জমি সংকুলানের দায়িত্ব নিলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে গতি আসবে বলা যায়। তবে সমীক্ষা করে দেখা যেতে পারে, কৃষি খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে কোন জায়গাগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা যায়। সঙ্গে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও আন্তঃসংযোগের দায়িত্ব সরকারি সংস্থা নিলে অনেক প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যাবে।

বিশ্বের অধিকাংশ দেশই নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে আগ্রহী হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তিকে সমালোচনা সহ্য করতে হয়। যেমন নবায়নযোগ্য শক্তির খরচ অনেক বেশি এবং এটি অনেক বেশি প্রকৃতিনির্ভর তথা পরিবর্তনশীল। এছাড়া কিছু নবায়নযোগ্য শক্তি যেমন সৌরশক্তি, বায়োগ্যাসের জন্য তুলনামূলক  বেশি জায়গার প্রয়োজন হয় বলে মনে করেন অনেকে। যদিও বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, ক্রমাগত গবেষণা ও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার ফলে নবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুতের দাম কমে এসেছে। নবায়নযোগ্য শক্তির পরিবর্তনশীলতার জন্য মানানসই ব্যাটারি ব্যবস্থা দ্রুত উন্নত হচ্ছে এবং অনেক দেশই স্মার্ট-গ্রিড পদ্ধতি স্থাপন করছে। তাছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানি যেহেতু সীমিত তাই ভবিষ্যতের জ্বালানি ব্যবস্থা নির্ভর করবে নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর। এছাড়া জলবাযু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না এবং ক্রমে নবায়নযোগ্য শক্তি জনপ্রিয়তা লাভ করছে। এ প্রবণতা ধরে রাখতে ব্যয়সাশ্রয়ী নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের প্রযুক্তি সহজলভ্য এবং প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন