ব্যক্তিগত টানাপড়েন ও সম্পর্কের গল্প

আসরার আবেদিন

‘‌দ্য হোয়েল’ সিনেমার দৃশ্য ছবি: আইএমডিবি

কখনো কখনো সিনেমার গল্প মিলে যায় আর্টিস্টের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে। এ বছর অস্কারে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পাওয়া ব্রেন্ডন ফ্রেজারের ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমন। এ অভিনেতা তার ব্যক্তিগত জীবনে নানা সংকট পার করে এসেছেন। দ্য হোয়েল সিনেমায় তার অভিনীত চার্লি চরিত্রটিও তেমন। ৬০০ পাউন্ড ওজনের চার্লি একাধিক সমস্যার মধ্য দিয়ে জীবন পার করে। তার সেই জীবনের গল্প নিয়ে ড্যারেন অ্যারনোফস্কি নির্মাণ করেছেন দ্য হোয়েল। সিনেমাটিতে তিনি আমাদের পরিচিত সিনেমার ধারার বাইরে মূল চরিত্রকে সাজিয়েছেন। এছাড়া এর মধ্য দিয়ে তিনি তুলে এনেছেন এমন অনেকের গল্প, যা সবাই বলতে পারে না।

চার্লি এ সিনেমার নায়ক, কিন্তু নায়কোচিত কোনো কিছুই তার মধ্যে নেই। চার্লি সুদর্শন নয়। সে ঘরের মধ্যে বন্দি থাকে। কাজ ছেলেমেয়েদের পড়ানো। সে অনলাইন শিক্ষক, কিন্তু কখনো ক্যামেরা অন করে পড়ায় না। কারণ তার শারীরিক গঠন। চার্লির ওজন ৬০০ পাউন্ড। সে সাহায্য ছাড়া ঘরের একপাশ থেকে অন্য পাশে যেতে পারে না। সিনেমায় আমরা দেখি চার্লি সোফায় বসে থাকে। তার জন্য ঘরে বেশকিছু হ্যাঙার রাখা আছে, যা ধরে সে হাঁটে। সাহায্যের জন্য আছে বন্ধু লিজ। সে এ সময় চার্লির একমাত্র সহমর্মী। নানা সময়ে চার্লিকে দেখাশোনার পাশাপাশি তার ভালোমন্দের খবর রাখে লিজ। কিন্তু প্রশ্ন হলো চার্লির এ অবস্থা কেন? তার আপনজন বলে কি কেউ নেই?
পশ্চিমা সমাজে চার্লি একজন নয়। বহু মানুষ আছে তার মতো। বিষাদ, অনিয়ন্ত্রিত জীবনে তাদের শারীরিক স্বাভাবিকতা হারিয়ে যায়। সঙ্গী নির্বাচনে ভুল বা পছন্দের পার্থক্যের কারণে বৈবাহিক সম্পর্ক টিকে থাকে না। চার্লির ক্ষেত্রে তার স্ত্রী মেরি তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেনি। কেননা চার্লি অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। চার্লির একটি মেয়ে আছে, এলি। সিনেমার একপর্যায়ে আমরা তার দেখা পাই। সেখানে চার্লির সঙ্গে কথোপকথনে বোঝা যায়, এলি কেবল চার্লির কাছে অর্থপ্রত্যাশী। এর বাইরে সে চার্লির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক নয়। চার্লির মধ্যে একটা আকুতি আছে মেয়েকে কাছে রাখার, কিন্তু সে চার্লির কাছে থাকতে চায় না। 
এলি একটি নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি। অ্যারনোফস্কি দেখিয়েছেন যে এ প্রজন্ম সম্পর্কে বিশ্বাসী নয়। পড়াশোনায় তাদের কোনো মন নেই। চার্লির অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর অঙ্গভঙ্গি ও এলির ‘‌ কেবল পাস করা’ দর্শনের মধ্য দিয়ে সেটা বোঝা গেছে। কিন্তু সিনেমা আগাতে আগাতে বোঝা যায়, এলির মধ্যে বহুদিনের জমে থাকা ক্রোধ তাকে এ পর্যায়ে এনেছে। সেও চাইত একটি স্বাভাবিক পরিবার। কিন্তু এ দানবসদৃশ বাবা ও ভাঙা সংসার, তাকে অন্য রকম করে তৈরি করেছে। সত্যি বলতে, এলি এ দুনিয়ার কোনো কিছুকে মূল্যবান মনে করে না।
ব্ল্যাক সোয়ানের পরিচালক অ্যারনোফস্কি আমাদের দেখিয়েছেন বর্তমান আমেরিকার অবস্থা। সেখানে ভঙ্গুর পরিবারের পাশাপাশি ব্যক্তির শারীরিক দশা একটি বড় চিন্তার বিষয়। কিন্তু এ গল্পে সবকিছু থেকে বড় হয়ে উঠেছে, নিজের ভুল বুঝতে পেরে তা স্বীকার করা। এ সিনেমায় একটি দৃশ্যে চার্লি বলে, ‘‌আমি জীবনে একটা ঠিক কাজ করেছি, এ শান্তিটুকু পেতে চাই।’ ফ্রেজারের অভিব্যক্তিতে এ সময় যে আকুতি ফুটে ওঠে, তা সিনেমার দর্শককে ওই মুহূর্তের জন্য আবেগী করে তুলবে। এর বাইরে ফ্রেজার পুরোটা সময়ই অভিনয় দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন।
সিনেমাটি সত্যিকার অর্থে ‘‌ডিস্টার্বিং’। চার্লির জীবন, তার বাস্তবতা অসহনীয়। কিন্তু সেটাই বাস্তব। ১০ মার্চ গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ‌রিভিউয়ে লিন্ডি ওয়েস্ট এ সিনেমাকে ‘‌ বোকাটে’ বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, এ সিনেমায় দর্শকের একচোখা মনোভাব কাজ করেছে, যেটা অ্যারনোফস্কি আরোপ করেছেন দর্শকের ওপর। লিন্ডির চোখে সিনেমাটি একজন বিষাদগ্রস্ত মোটা মানুষের গল্প। কিন্তু আদতে এটা সম্পর্কের জটিলতায় ভোগা যেকোনো মানুষেরই গল্প হতে পারে।
সিনেমাটি চার্লির অ্যাপার্টমেন্টেই আবদ্ধ। এটুকুর মধ্যেই পাঁচটি চরিত্র দিয়ে প্রায় ২ ঘণ্টার সিনেমা। জানালার বাইরে ক্রমাগত বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য সিনেমাটিকে আরো বিষণ্ন করে তোলে। কিংবা বলা যায়, চার্লির মনের অবস্থা বোঝাতে এর চেয়ে ভালো কিছু হতো না। তবে শেষে এলি দরজা খুললে দেখা যায়, বৃষ্টি শেষে সূর্য উঠেছে। এলির ছেলেবেলায় লেখা ‘‌মবি ডিক’ বিশ্লেষণ তখন তাকে পড়তে বলে চার্লি। এলিকে জানায়, সে যেমন আছে তেমনই সুন্দর, সৎ। সিনেমার মূল কথা এখানেই। আর তখনই তিমির মতো দেখতে ৬০০ পাউন্ডের চার্লিকে শিশুর মতো মনে হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন