আলোকপাত

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতন থেকে শিক্ষণীয়

লুক্রেজিয়া রিচলিন

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে ছাপিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক খাতে সৃষ্ট অস্থিরতা বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) পতনের মধ্য দিয়ে যার যাত্রা। এরপর একে একে তিনটি ব্যাংকের অবস্থার অবনতি ঘটে এবং তাদের উদ্ধারে বরাবরের মতো ফেডারেল রিজার্ভকেই এগিয়ে আসতে হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, এসভিবি পতন বর্তমান বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতার কাঠামোর একটি মৌলিক দুর্বলতাকে প্রকাশ করে, নাকি এটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির ব্যর্থতা?

প্রযুক্তি খাতের অনেক সফল ও উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জনকারী কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। এসভিবি তেমনই একটি ব্যাংক যারা প্রযুক্তি খাতের কোম্পানির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। প্রযুক্তি খাতের আমানতের অর্থের ওপর নির্ভর করেই তারা ব্যবসা পরিচালনা করেছে। কিছু ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিও গ্রহণ করেছে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এসভিবির পতন মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ফেডের দ্রুত হস্তক্ষেপ বিশেষত আমানতকারীদের আমানতের গ্যারান্টি এবং বর্ধিত ঋণ দিয়ে অন্য ব্যাংকগুলোকে রক্ষার মাধ্যমে এ বার্তা দিয়েছে যে এসভিবির পতন নিয়ে মার্কিন সরকার সত্যিকারভাবে উদ্বিগ্ন ছিল। ক্রেডিট সুইসের সংকটও ইউরোপীয় ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রকদের একই প্রশ্নের সামনে হাজির করেছে যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান রক্ষায় তারাও কি বেইলআউট করবে?

এসভিবি পতনে স্পষ্টতই নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির ব্যর্থতা ছিল। ফেড কর্তৃক ক্রমবর্ধমান সুদহার বাড়ার কারণে এসভিবি দেউলিয়া হয়েছে। ব্যাংকটি ১৭৫ বিলিয়ন ডলার দায়ের বিপরীতে প্রায় সমপরিমাণ মার্কিন সরকারি সিকিউরিটিজ বা বন্ড কিনেছিল, যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ ছিল। তবে সেগুলোর অধিকাংশই কেনা হয়েছিল কভিডের সময়, যখন বন্ডের ওপর সুদ ছিল প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। উচ্চমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফেড এক বছর আগে থেকেই সুদের হার ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকায় জটিলতা তৈরি হয়। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে যে পরিবর্তন আনতে হবে সে কথা খুব একটা ভাবেনি এসভিবি। ভাবলেও বন্ডগুলোর বাজারদর ভালো ছিল না বিধায় ওগুলোর ম্যাচিউরিটি ডেট পর্যন্ত অপেক্ষা করছিল। এটি তাদের অতিমাত্রায় ঝুঁকিগ্রহণ বা পরিস্থিতি বুঝতে না পারার ফলও হতে পারে। 

সমস্যাটি ঋণঝুঁকি বা তারল্যঝুঁকি ছিল না; বরং এটি ছিল বাজারঝুঁকির একটি সুস্পষ্ট রূপ। ফেডের স্ট্রেস টেস্ট এসভিবির নির্বাহীদের এমন বিব্রতকর অবস্থা থেকে রেহাই দিতে পারত। কিন্তু ২০১৮ সালে আইনি পরিবর্তনের মাধ্যমে এসভিবিকে স্ট্রেস টেস্ট থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। আইন সংশোধনের মাধ্যমে স্ট্রেস টেস্টের জন্য সম্পদের থ্রেসহোল্ড সীমা ৫০ বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ২৫০ বিলিয়ন ডলার করা হয়েছিল। এসভিবি যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ২০৯ বিলিয়ন ডলার। ফলে এসভিবি নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্ট্রেস স্টেট থেকে সহজেই নিজেদের এড়িয়ে যেতে পেরেছিল। সঠিকভাবে স্ট্রেস টেস্ট হলে তাদের ভুল সিদ্ধান্তগুলো সহজেই চিহ্নিত করা যেত এবং হয়তো দ্রুতই তার সমাধান করা যেত।

এসভিবির পতন পুরো আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য গভীর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ২০০৮ সালে সৃষ্ট বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর থেকে আটলান্টিকের উভয় প্রান্তের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো একটি বিস্তৃত সামঞ্জস্যপূর্ণ কাঠামোর মধ্যে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ এবং তদারকি শক্তিশালীর চেষ্টা করেছে। তাদের সংস্কারের দুটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো তদারকি ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সক্ষমতা উন্নত করার পাশাপাশি অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বিশেষ দৃষ্টি দেয়া। আমানতকারীদের আমানত আংশিক রক্ষার জন্য বীমা স্কিম চালু করা হয়েছিল, যা আমানতকারীদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রক্ষার গ্যারান্টি দেয়। 

এসভিবির পতন শুধু আর্থিক ব্যবস্থার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয় নীতিনির্ধারকদের জন্যও শিক্ষণীয়। ব্যাংকটি রক্ষায় ফেডের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ পুরো আর্থিক খাতকে আপাতত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে। এবারের সংকট থেকে এটি স্পষ্ট যে এফডিআইসির আংশিক বীমা আমানতকারীদের রক্ষায় যথেষ্ট নয়। বীমার অর্থ গ্রাহকদের আস্থা ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি। কারণ এটি ছিল প্রয়োজনের নিরিখে খুবই সামান্য। বর্তমান সংকটকে পাশে রেখেও আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে ফেড সুদের হার না বাড়ালেও এসভিবি সংকটে পড়ত। কারণ তাদের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা ছিল দুর্বল। 

২০০৮ সাল-পরবর্তী সময়ে লেম্যান ব্রাদার্সের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোয় সংকট সৃষ্টির প্রবণতার চেয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেশি উদ্বেগ ছিল তাদের অগ্রগতি নিয়ে। আর্থিক সংকট ক্ষুদ্র-মাঝারিসহ সব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু হতে পারে। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর থেকে ব্যাংক খাতের নিয়ম-কানুনে সবচেয়ে বেশি সংস্কার হয়েছে। এর মাধ্যমে আর্থিক খাতের নিয়ম-কানুন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিধিবিধানগুলো কতটা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেমন ব্যবস্থা নিচ্ছে? 

এসভিবির পতন আমাদের এ বার্তা দেয় যে ২০০৮ সাল-পরবর্তী সংস্কারগুলো যেমন শক্তিশালী মূলধন পর্যাপ্ততা, ব্যাংকের আইন-বিধিবিধান যথাযথ ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকগুলোর জন্য ‘‌লিভিং উইল’ তৈরি করা ইত্যাদি যথেষ্ট ছিল না। তবে আমানতের বিপরীতে বীমার পরিমাণ বৃদ্ধি আর্থিক খাত সংস্কারের একটি ভালো দিক ছিল। যদিও বর্তমান সময়ে সেটি যে যথেষ্ট নয়, তা প্রমাণ হয়েছে। ব্যাংকের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আরো ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি ছিল, যা নেয়া হয়নি। 

এটি নিশ্চিত যে সংকট মোকাবেলায় ফেডের হস্তক্ষেপের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমানতকারী ও প্রতিষ্ঠানকে রক্ষার চেয়ে আর্থিক সংকট থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষা করা। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে কার্যক্রম পরিচালনাকারী এসভিবির অন্তর্ভুক্ত সহপ্রতিষ্ঠান বেশ সফলভাবে উতরে গেছে। প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচাতে যুক্তরাজ্য সরকারকে করদাতাদের অর্থ দিয়ে সহায়তা করতে হয়নি। এসভিবি ইউকে ১ পাউন্ডে এইচএসবিসি ব্যাংক কিনে নিয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে সেখানকার নির্বাহীদের কর্মতৎপরতায়। তবে প্রশ্ন ওঠে যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান রক্ষায় এমন ব্যবস্থা সবচেয়ে ভালো বিকল্প কিনা। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমরা আরো একটি বিষয়ের সাক্ষী হয়েছি যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের আর্থিক খাত রক্ষায় তার ব্যালান্স শিট ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে। গত দশকে সৃষ্ট সংকটের ভিন্ন ভিন্ন উৎস থাকতে পারে, কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমাধান ছিল একই। সব ক্ষেত্রেই সরকার কার্যকরভাবে সংকট সমাধানে শেষ অবলম্বন হিসেবে কাজ করেছে। এবারো তার ব্যতিক্রম লক্ষ করা গেল না। এটি কি সবচেয়ে ভালো সমাধান?

আরো বিস্তৃতভাবে বললে, যদি অবস্থা এমন হয় যে পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন অর্থনীতির কিছু খাতকে সুরক্ষিত রাখতেই হবে, তবে সেটি অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্য থেকে করতে হবে। শুধু বেইলআউটের মাধ্যমে আমানতকারীদের রক্ষা ও প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার মধ্যে কোনো সফলতা নেই। সর্বশেষ সংকট থেকে নীতিনির্ধারকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এটিই যে আর্থিক কাঠামোকে শক্তিশালী ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আইনের দুর্বলতা, তদারকির ঘাটতি, আমানতকারীদের রক্ষা, ঝুঁকি গ্রহণসহ আর্থিক খাতের প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আরো ভাবতে হবে। 

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

লুক্রেজিয়া রিচলিন: ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গবেষণা পরিচালক, লন্ডন বিজনেস স্কুলের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডস ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন