জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনার অভাবে পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে

আইন অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়নে কমিটি করা হোক

জীববৈচিত্র্য প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে পরিবেশ ও খাদ্যচক্রের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্যই জীববৈচিত্র্যের প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে জীবকুলে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার মানুষের সচেতনতার পাশাপাশি দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন। সেটি না করে যদি অবাধে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী নিধন এবং জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করে রাখা হয়, তাহলে জীববৈচিত্র্য বলে কিছু থাকবে না। এতে সবচেয়ে ক্ষতি হবে পরিবেশের, যা অন্য কিছুর মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব নয়।

বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সংসদে পাস হয় ‘বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন’। সে আইন অনুযায়ী কোনো গ্রামের জীববৈচিত্র্যের বর্ণনা রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ থাকবে। ইউনিয়ন জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা কমিটি পুরো বিষয়টি তদারক করবে। চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে দেশের প্রত্যেক ইউনিয়নেই এ কমিটি হওয়ার কথা। এমনকি আইনে পৌরসভা, উপজেলা এবং প্রতিটি জেলায় জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা ও তদারক কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এমন কমিটির হদিস পাওয়া যায় না। এভাবে জীববৈচিত্র্যের বিষয়টি অবহেলা করার প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে। শহরের বা মফস্বল এলাকার মানুষকে সচেতন করা গেলেও একেবারে প্রান্তিক লোকজনকে এ বিষয়ে সচেতন করা যাচ্ছে না। ফলে জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটছে। এসব কাণ্ড দীর্ঘদিন ধরে চলে এলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগকেই শুধু হঠাৎ করে আইনি ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়। আর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় এটিই এখন আশার আলো হিসেবে গণ্য হচ্ছে। অথচ ২০১৭ সালের আইন অনুযায়ী জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিসাধনকারী কোনো কাজ যেন কেউ করতে না পারে সে বিষয়টি দেখার কথা ইউনিয়ন ব্যবস্থাপনা কমিটির। কেউ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন করলে কিংবা করার উদ্যোগ নিলে তা বন্ধসহ যথাযথ আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব এ কমিটির ওপর পড়ে। এ আইনে ইউনিয়নের পাশাপাশি প্রত্যেক পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশনেও জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা ও তদারক কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ছয় বছর অতিবাহিত হলেও এভাবে কমিটির সুবিন্যস্তকরণ আজও হয়ে ওঠেনি। অভিযোগ উঠেছে, আইনটি বাস্তবায়নে খোদ পরিবেশ অধিদপ্তরেরই গরজ নেই। অথচ আইন অনুযায়ী, জীববৈচিত্র্যবিষয়ক জাতীয় কমিটির সভাপতি হবেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী এবং এ কমিটির সদস্য সচিব হবেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

ইউনিয়ন ও উপজেলা কমিটির পাশাপাশি জেলা কমিটি মূলত উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন কমিটিসহ জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক দল বা সমিতির কার্যক্রম দেখভালসহ দিকনির্দেশনা দেবে। আবার উপজেলা কমিটি পৌর ও ইউনিয়ন কমিটিসহ জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক দল বা সমিতির কার্যক্রম দেখভাল করবে। এছাড়া বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন যথাযথ বাস্তবায়নের বিষয়টিও তদারকির ভার এ কমিটির কাঁধে। প্রতি বছর কমিটির অন্তত দুটি সভা করার কথা। এছাড়া সিটি করপোরেশনের কমিটি দুটি এবং জেলা, উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন কমিটি তিনটি করে সভা করবে বলে আইনে বলা হয়েছে। তবে আইন পাসের এত বছরেও কমিটিগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সে হিসেবে কমিটি যে গঠন করা হয়নি সে তথ্যটিই ফুটে ওঠে।

প্রকৃতি আইনের ভাষা বোঝে না, তাই সে তার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে সব জীবকে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু প্রকৃতির কোলে বিচরণ করা বন্যপ্রাণী নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকার আশ্বাসটুকু মানুষের কাছ থেকে পায় না। তাই তো গত বছর বিলুপ্ত নীলগাই ধরে জবাই করার ঘটনা ঘটে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার মণ্ডলপাড়া এলাকায়। খবর পেয়ে একদিন পর ঘটনাস্থলে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের লোকজন পৌঁছে। ততক্ষণে জড়িতরা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউনিয়ন জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকলে হয়তো রক্তের টানে ফিরে আসা নীলগাইটি রক্ষা পেত। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রায় ১০০ বছর আগে এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ এ অ্যান্টিলোপের আবাস ছিল উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় এলাকায়। সময়ের পরিক্রমায় নীলগাই এ অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। উত্তরাঞ্চলের বড় জীববৈচিত্র্যের আধার চলনবিলেও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কোনো কমিটি নেই। এখানেও গত বছর চারটি শিয়াল ও একটি দাঁড়াশ সাপ লাঠিপেটা করে হত্যার ঘটনা ঘটে। এতে বন্যপ্রাণী হত্যায় পরিবেশের আনুমানিক দেড় লাখ টাকার ক্ষতির অভিযোগে মামলাও করা হয়। যার নেতৃত্বে বন্যপ্রাণী হত্যা করা হয়, তাকে এর আগে ২০০ শামুকখোল হত্যার অভিযোগে শুধু মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ এখানে বন্যপ্রাণী রক্ষায় প্রয়োজনীয় সচেতনতা না থাকা ও আইন প্রয়োগের দুর্বলতার বিষয়টিই ফুটে ওঠে। 

শুধু উত্তরবঙ্গেই নয়, সারা দেশেই জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা ও তদারক কমিটি গড়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ উক্তিরই যেন প্রতিফলন হচ্ছে। বস্তুত জীববৈচিত্র্য আমাদের জীবনধারণের জন্যই প্রয়োজনীয়। খাদ্য, প্রকৃতির ভারসাম্য, জীবনধারণের উপযোগী পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি চিত্তবিনোদনের জন্যও জীববৈচিত্র্য দরকার। জীববৈচিত্র্যের এ চার ধরনের উপস্থিতি আমাদের জীবনযাপনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তাই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। এসব দেখভাল করা বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের দায়িত্ব হলেও দেখা যায় মূলত স্বেচ্ছাসেবীরা বন্যপ্রাণীবিষয়ক অপরাধের খবর দেন। এর স্থায়ী সমাধান হিসেবেই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার জন্য জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা ও তদারকি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতন হওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। এক্ষেত্রে আর কালক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। এরই মধ্যে অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। আমাদের জীবন, বাস্তুসংস্থান ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে মাঠপর্যায়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কাজ করতে হবে। এজন্য যেহেতু কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাই এর কোনো বিকল্প নেই বলেই আমরা মনে করি। কারণ আইনের শাসন প্রয়োগ করতে হলে একটি কাঠামোর মধ্যে থেকেই সেটি করতে হবে। এজন্য সামাজিক অনুশাসন ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে এ ধরনের কমিটির যথার্থ গুরুত্ব রয়েছে। জীববৈচিত্র্য প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ, এটি হারিয়ে যেতে থাকলে পরবর্তী সময়ে প্রকৃতিই সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য তাই সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। এর সঙ্গে আইনের প্রতি সবাইকে শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দ্রুত জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি গঠনে কাজ করা হোক, সেটিই আমাদের কাম্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন