ইসলামী ব্যাংক শুধু মালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান নয়

চলতি মাসেই প্রতিষ্ঠার চার দশক পূর্ণ করতে যাচ্ছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ বাংলাদেশে পথযাত্রা শুরু হয় ইসলামী ধারার ব্যাংকটির। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স আমানতে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংকের জন্ম, বিকাশ, সংকট সম্ভাবনা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান

চার দশকে ইসলামী ব্যাংকের অর্জন সম্পর্কে জানতে চাই।

ইসলামী ব্যাংক এখন দেশের অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। গত চার দশকে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতিটি ধাপে ব্যাংকটি ভূমিকা রেখেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসলামী ব্যাংক উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি শিল্পায়নে জোর দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ব্যাংকের হাত ধরে গড়ে উঠেছেন বিপুলসংখ্যক প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পোদ্যোক্তা, যারা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনবদ্য অবদান রেখে চলছেন। বিশেষ করে দেশের তৈরি পোশাক খাতের ভিত্তি তৈরি হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগের মাধ্যমে।

দেশের অনেক বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তা ব্যাংকে এসেছিলেন একেবারেই শূন্য হাতে, হেঁটে কিংবা রিকশায় চড়ে। ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগে তারা বড় শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। আমাদের গড়ে তোলা উদ্যোক্তারা দেশের রফতানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলামী ব্যাংক প্রায় লাখ কোটি টাকার আমদানি এবং সাড়ে লাখ কোটি টাকার রফতানি বাণিজ্য করে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য অর্থায়নে নেতৃত্ব দিয়েছে। দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে ব্যাংক পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রেখেছে।

প্রতিষ্ঠার চার দশকে ইসলামী ব্যাংক কখনই শুধু মালিক বা শেয়ারহোল্ডারদের ব্যাংক ছিল না। পরিচালকদের স্বার্থ দেখার লক্ষ্যে এটি কখনো পরিচালিতও হয়নি। সর্ববৃহৎ ব্যাংক হিসেবে দেশের বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অবস্থায় ইসলামী ব্যাংকের যেকোনো ক্ষতি দেশের অর্থনীতির জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে।

প্রতিষ্ঠার চার দশক পূর্তির বছরেই ইসলামী ব্যাংক ঘিরে কিছু সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচনাকে কীভাবে দেখছেন?

প্রতিষ্ঠার ৩৯ বছরে ইসলামী ব্যাংকের কোনো কর্মীর আমানতদারিতা পেশাদারত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। আমাদের কর্মীরা নিজেদের কাজকে ইবাদত মনে করে পালন করেছেন। তবে ৪০তম বর্ষে এসে আমাদের কিছু বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেগুলো নিয়ে গণমাধ্যম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এসব সমালোচনা হয়তো আমাদের প্রাপ্যও ছিল। কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণেই সমালোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছি। এসব আলোচনা-সমালোচনাকে আমরা ভবিষ্যৎ পথচলার পাথেয় হিসেবে নিয়েছি। আশা করছি, ইসলামী ব্যাংক সগৌরবে পথ চলবে।

বেনামি ঋণ বলে যেসব বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলোর বর্তমান অবস্থা কী?

ইসলামী ব্যাংকে কোনো বেনামি ঋণ নেই। দেশের বড় প্রতিষ্ঠান উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা সক্ষমতা বিবেচনা করে আমরা বিনিয়োগ করি। বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়া এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিপ্র্রেক্ষিতে যথাযথ মূল্যায়ন করেই আলোচিত গ্রাহকদের বিনিয়োগ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জামানত গ্রহণ ব্যাংকের নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিতের বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়েছি। যেসব বিনিয়োগের বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ বা খেলাপি হয়নি।

গণমাধ্যমে তিনটি বিনিয়োগকে বেনামি উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল। এর মধ্যে রাজধানীর ফার্মগেট শাখার মার্টস বিজনেস লিমিটেড এরই মধ্যে তাদের পণ্য বিক্রির টাকা দিয়ে সমুদয় দায় পরিশোধ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকনির্দেশনা পরামর্শ মেনে অন্যান্য বিনিয়োগগ্রহীতার মজুদকৃত মালপত্রের বিক্রয়লব্ধ অর্থ সরাসরি ব্যাংক হিসাবে জমা নিশ্চিতের মাধ্যমে বিনিয়োগ সমন্বয় হচ্ছে। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, বিনিয়োগগুলোর পুরো অর্থ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই পরিশোধ হবে।

সমালোচনায় আতঙ্কিত গ্রাহকরা ইসলামী ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিচ্ছিলেন। এখন পরিস্থিতি কী?

ইসলামী ব্যাংক প্রায় দুই কোটি গ্রাহকের প্রতিষ্ঠান। দেশের ব্যাংক খাতের মোট গ্রাহক সংখ্যার ১৭ শতাংশই এককভাবে আমাদের। আমাদের আমানতের প্রায় শতভাগই বেসরকারি খাতের। আবার আমানতকারীদের ৯০ শতাংশ ব্যক্তিশ্রেণীর। এত বিপুলসংখ্যক মানুষ একসঙ্গে বিভ্রান্ত হওয়া সম্ভব নয়। ইসলামী ব্যাংকের প্রতি সাধারণ মানুষের অসীম আস্থা ভালোবাসা গত চার দশকে গড়ে উঠেছে। স্বল্প সময়ের কোনো প্রচারে এটি ধসে যাবে এমন মনে করার কারণ নেই। তবে এটিও সত্য, কিছু গ্রাহক আতঙ্কিত হয়েছিলেন, তারা ইসলামী ব্যাংক থেকে আমানত তুলেও নিয়েছিলেন। আবার সপ্তাহ খানেক পর তাদেরই অনেকে টাকা নিয়ে ব্যাংকে ফিরেও এসেছিলেন। দেশের অন্য ব্যাংকগুলো থেকেও নগদ টাকা তুলে নেয়ার প্রবণতা আমরা দেখেছি। এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। প্রতিদিন ইসলামী ব্যাংকে হাজার কোটি টাকা জমা হয়। দিনে তোলা হচ্ছে হাজার ৮০০ থেকে হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

আমানত বাড়ানোর জন্য বিশেষ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেছেন বলে শুনেছি। সে ক্যাম্পেইনের ফলাফল কী?

গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত আমরা এক মাসের বিশেষ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেছিলাম। ক্যাম্পেইনে আমরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পেয়েছি। মাত্র এক মাসে ইসলামী ব্যাংকের লাখ ৪০ হাজার নতুন হিসাব খোলা হয়েছে। এসব হিসাবে জমা হয়েছে হাজার ৭৮৬ কোটি টাকার আমানত। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের সেবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে। আমাদের এজেন্টরাও ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখছেন। আশা করছি, ২০২৩ সাল শেষে ইসলামী ব্যাংকের আমানত তারল্য পরিস্থিতি আগের চেয়েও অনেক বেশি সুদৃঢ় অবস্থানে থাকবে।

দেশের তৈরি পোশাকসহ অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে হয়। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বোনাসসহ শ্রমিকদের বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। তারল্য সংকটের কারণে এক্ষেত্রে কোনো সংকট সৃষ্টি হবে কি?

ইসলামী ব্যাংক দেশের প্রায় সব বড় শিল্প গ্রুপের ভরসাস্থল। এসব প্রতিষ্ঠানের চলতি মূলধন আমাদের ব্যাংক থেকেই দেয়া হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে নগদ অর্থের কোনো সংকট হবে বলে আমি মনে করি না। ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের এক-তৃতীয়াংশ রেমিট্যান্স আসে। পবিত্র রমজান ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রবাসীরা আগের চেয়ে বেশি অর্থ দেশে পাঠাবেন। দেশের রফতানি খাতও প্রবৃদ্ধির ধারায় আছে। রেমিট্যান্স রফতানি আয় নগদায়ন হলে অর্থের কোনো সংকট হবে না।

সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, ইসলামী ব্যাংক যথাসময়ে আমদানি ঋণপত্রের (এলসি) দায় পরিশোধ করতে পারছে না। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আপনাদের সর্বশেষ অবস্থা কী?

বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান সবার শীর্ষে। সরকারি এলসি বাদ দিলে আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমেই দেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়। রফতানি রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেও ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান সুদৃঢ়। শুধু ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ৭৫ হাজার ৪০৪ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। ২০২১ সালে আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানির পরিমাণ ছিল ৬৪ হাজার কোটি টাকার। দেশে এক বছরের বেশি সময় ধরে ডলার সংকট চলছে। সংকট শুধু ইসলামী ব্যাংকের একার নয়। তার পরও আমরা আমদানি দায় যথাসময়ে পরিশোধের চেষ্টা করছি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের কোনো আমদানি এলসি ওভারডিউ নেই। এখন মার্চের দায়গুলো পরিশোধ করা হচ্ছে।

গত বছর দেশের মোট সার চাহিদার ৭০ শতাংশই ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি হয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনেই আমরা সারের ৭০০ মিলিয়ন ডলার এলসি খুলেছি। এসব এলসির দায় এখন সমন্বয় করা হচ্ছে। খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও ইসলামী ব্যাংক সবসময় অগ্রণী ভূমিকা রাখে। ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ৩৬ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়েছে। দেশের মোট আমদানি রফতানি বাণিজ্যে এককভাবে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার যথাক্রমে ১২ শতাংশ। আর রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই আসছে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। ২০২২ সালে আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে ৪৪ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে।

বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের রেমিট্যান্সপ্রবাহ নিম্নমুখী। এটি বাড়ানোর জন্য কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন?

বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আহরণের জন্য আমরা সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, জর্ডান সিঙ্গাপুরের ৩১ জন প্রতিনিধির সঙ্গে কাজ করছি। বিশ্বের ৫৯৪টি করেসপনডেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া ১৫৫টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের রেমিট্যান্স অ্যারেঞ্জমেন্ট রয়েছে। সামগ্রিকভাবে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ নিম্নমুখী। প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য আমরা বিভিন্নভাবে উত্সাহিত করছি। সম্প্রতি আরব আমিরাতে ইসলামী ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি স্পেশাল টিম পাঠানো হয়েছে। তারা আমিরাতজুড়ে প্রবাসীদের মধ্যে ক্যাম্পেইন করেছেন।

ইসলামী ব্যাংকের বড় গ্রাহকদের ঋণ নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। এসব ঋণের পরিস্থিতি কী?

দেশের সব বড় শিল্প গ্রুপ উদ্যোক্তার বেড়ে ওঠায় ইসলামী ব্যাংকের সংস্পর্শ রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বড় শিল্প গ্রুপগুলো আমাদের গ্রাহক। মূলধন সক্ষমতা শক্তিশালী হওয়ায় আমরা গ্রাহকদের বেশি বিনিয়োগ (ঋণ) দিতে পারি। আবার বড় মাপের এলসি খোলার ক্ষেত্রেও ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান সুদৃঢ়। ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান বিনিয়োগ স্থিতি লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগের ২০-২৫ শতাংশ বড় শিল্প গ্রুপগুলোকে দেয়া হয়েছে। ১৭ শতাংশ অর্থ আমরা বিনিয়োগ করেছি এসএমই খাতে। ক্ষুদ্র অতিক্ষুদ্র শিল্পে বিনিয়োগ আছে শতাংশ। অন্যান্য অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে ট্রেডিং, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে। বড় যেসব শিল্প গ্রুপকে আমরা বিনিয়োগ দিয়েছি, সেগুলো দেশের স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। এসব গ্রুপের কাছে আমাদের বিনিয়োগ নিরাপদ রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি বিনিয়োগের হার শতাংশেরও কম।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন