শুল্ক কমলেও বাড়ছে চিনির দাম

সুজিত সাহা,চট্টগ্রাম ব্যুরো

অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে চিনির দাম বেঁধে দিয়েছিল সরকার। শুরুতে দাম নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তত্পরতাও দেখা যায়। কিন্তু কোনো কিছুই চিনির বাজারের অস্থিতিশীলতাকে রুখতে পারেনি। দেশে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে পণ্যটির দাম। কোনো উপায় না পেয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখা রোজার আগে ঊর্ধ্বমুখিতা রোধ করতে আমদানির নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক শতাংশ কমিয়ে দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর প্রভাবও পড়েনি দেশের বাজারে। বরং পাইকারি বাজারে কয়েক দফায় দাম বাড়িয়ে চিনি লেনদেন হচ্ছে।

দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বর্তমানে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) চিনি বিক্রি হচ্ছে হাজার ১০০ থেকে হাজার ১২০ টাকায়। শুল্ক কমানোর পর সপ্তাহ খানেক দাম নিম্নমুখী থাকলেও ফের লাগামহীন। রোজার আগেই মণপ্রতি প্রায় ১০০ টাকা বেড়েছে। পাইকারিতে দাম বাড়ায় ভোক্তাপর্যায়ে চিনির দাম কেজিপ্রতি - টাকা পর্যন্ত বাড়তি বিক্রি হচ্ছে।

জানা গেছে, স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার চিনি আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) শতাংশ কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে কাস্টমসে শুল্কায়ন করা অপরিশোধিত চিনিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে আমদানিকারকদের, আগে যা ছিল ৩০ শতাংশ। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জারি করা গেজেটে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি হাজার টাকা, পরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি হাজার টাকা স্পেসিফিক ডিউটি (ফিক্সড ডিউটি) প্রত্যাহার করা হয়। হ্রাসকৃত শুল্ক সুবিধা আগামী ৩০ মে পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে জানানো হয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফেব্রুয়ারির শুরুতে দেশে চিনির দাম উপর্যুপরি বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর চিনি আমদানির শুল্ক কমালে দাম কিছুটা কমে যায়। কিন্তু সপ্তাহ খানেক নিম্নমুখী ধারায় থাকলেও ফের বাড়ছে পণ্যটির দাম। বিশ্ববাজারেও অপরিশোধিত চিনির বুকিং দর নিম্নমুখী রয়েছে। এমতাবস্থায় দেশে চিনির মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণ থাকতে পারে না। রোজায় প্রায় দ্বিগুণ চাহিদা সামনে রেখে আমদানিকারক পর্যায় থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার কারণে চিনির বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

দেশে বার্ষিক চিনির চাহিদা ২০ লাখ টনের কিছু বেশি। প্রতি মাসে চিনির চাহিদা রয়েছে প্রায় দেড় লাখ টন। তবে রোজা গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে চিনির চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে শরবতসহ মিষ্টিজাতীয় খাবারের চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং রোজায় শরবত ছাড়াও মিষ্টিজাতীয় সুস্বাদু খাবারের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় দ্বিগুণ হয়। কারণে বাড়তি চাহিদা সামনে রেখে মিলগেট থেকে শুরু করে ভোক্তাবাজার পর্যন্ত চিনির দাম নিয়ে অস্থিরতা দেখা দেয়। চিনির বাড়তি চাহিদা মৌসুমের আগে পাইকারি বাজার থেকে শুরু করে খুচরা দোকান পর্যন্ত মজুদ গড়ে তুললেও মিলগুলোয় পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারায় দাম বেড়ে যায় বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। 

একসময় দেশে চিনির বার্ষিক নিজস্ব উৎপাদন ছিল দেড়-দুই লাখ টন। সরকারি ১৫টি সুগার মিল থেকে এসব চিনি উৎপাদন হতো। তবে দুই বছর ধরে দেশের ছয়টি চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ রেখেছে সরকার। কারণে চিনি উৎপাদন কমে ২৫-৩০ হাজার টনে নেমে আসে। বছর চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫৩ হাজার টন। গত ২৫ নভেম্বর পর্যায়ক্রমে নয়টি চিনিকলে মাড়াই মৌসুম শুরু হয়। গত দুই মৌসুমের মতো পঞ্চগড়, সেতাবগঞ্জ, শ্যামপুর, রংপুর, পাবনা কুষ্টিয়া সুগার মিলসের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

বাংলাদেশ চিনি খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সরকারি মিলগুলোর প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন খরচ হয় ২০০ টাকারও বেশি। কারণে রাষ্ট্রয়াত্ত সিংহভাগ চিনিকল দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে রয়েছে। সরকার ভর্তুকি দিয়ে এসব মিলের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে আসছে। বর্তমান বিশ্বে তিন-চার টন আখ দিয়ে এক টন চিনি উৎপাদন করলেও দেশীয় মিলগুলোয় টনপ্রতি চিনি উৎপাদনে সাড়ে ছয় টন আখের প্রয়োজন হয়। দীর্ঘদিনের পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদন চালানোয় খরচও বেশি হয়। কারণে সরকারি চিনিকলের লোকসানের পরিমাণও বেশি। দীর্ঘদিনের লোকসানের কারণে অর্থ বরাদ্দের অপ্রতুলতায় সরকার এরই মধ্যে ছয়টি মিলের চিনি উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ চিনি খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বিপণনের প্রধান কর্মকর্তা মো. মাযহার উল হক খান বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ববাজারের কারণে দেশের বাজারেও চিনির দাম বেড়েছে। কারণে সরকারি পর্যায়ে চিনির দাম বাড়িয়ে দেয়ায় করপোরেশনের চিনির দামও বাড়ানো হয়েছে। গত বছরের চেয়ে বছর দেশীয় চিনি উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হবে। দেশে উৎপাদিত চিনির সরবরাহ বাড়লে বাজার স্থিতিশীল হতে পারে বলে আশা করছেন তিনি।

তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারি মিলগুলোয় লাখ ১৫ হাজার টন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও উৎপাদন হয়েছিল ৮২ হাজার টন। ২০২০-২১ মৌসুমে উৎপাদন হয়েছিল ৪৮ হাজার ৮১ দশমিক ৬০ টন এবং সর্বশেষ ২০২১-২২ মৌসুমে ২৫ হাজার টন চিনি উৎপাদন করেছে সরকারি নয়টি চিনিকল। আগামী উৎপাদন মৌসুমে ৫৩ হাজার টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও সেটি বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়ে রয়েছে বিএসএফআইসির উৎপাদন বিভাগ।

দেশে কয়েক মাস ধরে চিনির বাজারে অস্থিরতা চলছে। ব্যাংকের ডলার সংকট, টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ রিজার্ভ সংকটে ঋণপত্র খোলার হার কমেছে। জ্বালানি সংকটের কারণে বেসরকারি বিভিন্ন মিলের উৎপাদন কমেছে অর্ধেক। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকা, আমদানি কমে যাওয়ার কারণে দেশে চিনির দাম অতীতের রেকর্ড ভেঙে খুচরা পর্যায়ে ১১৫-১২০ টাকায় উঠে যায়। কয়েক দফায় দাম বাড়ানোর পর সরকারি পর্যায়ে চিনির দাম নির্ধারণ করা হয় ১০২ টাকা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন