বাস্তবতার নিরিখে সংবেদনশীল বাজেট চাই

ড. আতিউর রহমান

‘‌খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির ক্রমবর্ধমান দামের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। একদিকে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে তাদের প্রকৃত আয়ের যে ক্ষয় হয়েছে তা থেকে সুরক্ষা দেয়ার পাশাপাশি খাদ্য ও জ্বালানি যেন তাদের নাগালের মধ্যে থাকে তা নিশ্চিত করা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। অন্যদিকে ফিসক্যাল পলিসি (তথা বাজেট) এবং মনিটারি পলিসির (তথা মুদ্রানীতি) মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে যেন নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতি না ঘটে এবং ঋণ পরিশোধ নিয়ে সরকারকে যেন কোনো বিপাকে পড়তে না হয়—এগুলো নিশ্চিত করতে সরকারি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরার কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে।’— অক্টোবর ২০২২-এ প্রকাশিত আইএমএফের ‘ফিসক্যাল মনিটর’ প্রতিবেদনে এভাবেই চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কালে নীতিনির্ধারকদের চ্যালেঞ্জকে তুলে ধরা হয়েছে। করোনাকালে সংগত কারণেই সরকারগুলো প্রণোদনা কর্মসূচির মাধ্যমে বাজারে তারল্যের প্রবাহ বাড়িয়েছিল। কিন্তু করোনাজনিত অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার আগেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নতুন করে চাপের মুখে পড়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এটা ঠিক যে করোনা আসার আগে এক দশকে যে শক্ত সামষ্টিক-অর্থনৈতিক পাটাতন তৈরি করা গিয়েছিল তার জোরে করোনাকালীন সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ অন্য অধিকাংশ দেশের চেয়েই ভালো করেছে। ইউরোপে যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে সৃষ্ট সংকট সামাল দেয়ার ক্ষেত্রেও এ কথা খাটে। তবুও আমরা যে সাম্প্রতিক দশকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে আছি সেটা ভুলে গেলে চলবে না।

একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভাবনীয় মনিটারি টাইটেনিং প্রেক্ষাপটে হালে সে দেশের এবং ইউরোপের ব্যাংক খাতে যে ঝড় বইছে তার ঝাপটা বিকাশমান অর্থনীতিতে কতটা পড়বে সে বিষয়েও নানা আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিতে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি আদৌ এড়ানো যাবে কিনা তা এখনই বলার সময় আসেনি। তবে এ ডামাডোলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও সেবার দাম বেশ কমছে। এর খানিকটা ইতিবাচক প্রভাব আমাদের আমদানি খরচের ওপর নিশ্চয়ই পড়বে। আর আমাদের ব্যাংক খাত দেশী কিংবা বিদেশী বন্ড মার্কেটের সঙ্গে ততটা গভীরভাবে যুক্ত নয় বলে পশ্চিমের মতো তা হঠাৎ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। তাছাড়া আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাস্তবতায় আমানত ও ঋণের বিস্তার যথেষ্ট। ক্ষুদ্র ও ছোট ছোট আমানত ও ঋণের প্রসারও ঘটেই চলছে। এসব প্রডাক্টসও বহুমুখী। সুশাসন নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকলেও এ কথা বলা চলে আমাদের আর্থিক খাতের পাটাতন বেশ বিস্তৃত ও শক্তিশালী। এর পরও সদা প্রস্তুত থাকতে হবে আর্থিক খাতের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য।

এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মতো প্রায় সব দেশের জন্যই মুদ্রানীতি ও জাতীয় বাজেটের মধ্যে সুসমন্বয়ের মাধ্যমে একটি ছকবদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে এগানোর বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে আইএমএফের ফিসক্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক ভিটোর গ্যাসপার যথার্থ সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘‌উচ্চমূল্যস্ফীতি, ব্যাপক ঋণের বোঝা, বর্ধিষ্ণু সুদের হার এবং ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে মুদ্রানীতি ও জাতীয় বাজেটের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিতকরণ সর্বোচ্চ গুরুত্বের দাবিদার। এজন্য অধিকাংশ দেশেই জাতীয় বাজেটকে সংকোচনমুখী রাখা বাঞ্ছনীয়।’ পাশাপাশি আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার বিষয়টিও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্দে সম্প্রতি দুটো দিকের ওপরই গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশে আমরা এরই মধ্যে আপৎকালীন মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন হতে দেখছি। বার্ষিক মুদ্রানীতির অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা থেকে ষাণ্মাসিক ব্যবস্থায় ফিরে আসায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতিসহ সংশ্লিষ্ট সূচকগুলোর গতিপ্রকৃতি বোঝা আগের চেয়ে অর্থবহ হবে। বৈশ্বিক বিনিময় হারের পরিবর্তনের ধারার সঙ্গে সংগতি রেখে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকারও ব্যাপক অবমূল্যায়ন হয়েছে। পাশাপাশি রিজার্ভ থেকে ডলার বাজারে বিক্রি করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টাও হয়েছে। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। কিছুটা ধীরে হলেও মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে বাজারভিত্তিক একক বিনিময় হারের দিকে এগোচ্ছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানির কারণেই যেহেতু মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে তাই বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এখনো কিন্তু সবচেয়ে বড় যে ভাবনার বিষয়, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা তার কাঙ্ক্ষিত সুফল ওই অর্থে দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মূল্যস্ফীতির হার (পয়েন্ট টু পয়েন্ট হিসেবে) ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ফলে বলা যায়, মুদ্রানীতিতে যতই গণমুখী চিন্তার প্রতিফলন ঘটানো হোক না কেন সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে এ হার বিশেষ করে নিম্ন আয়ের নাগরিকদের জন্য চাপ হয়েই থাকবে। আর এ চাপ থেকে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে জাতীয় বাজেটে। রমজান উপলক্ষে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনা এবং তার সঙ্গে সমন্বয় করে শুল্ক ও সড়ক ব্যবস্থাপনায় বেশকিছু ভালো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব ব্যবস্থা রোজার পরও যেন অব্যাহত থাকে সে তাগিদ বাজেটপ্রণেতাদেরও দেয়া উচিত। কেননা বাজেট শুধু অংকের মারপ্যাঁচ নয়। তার একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও জনমনে পড়ে।

আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী এবং বিশেষজ্ঞরা বারবার এ সংকটকালে জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাড়তি বরাদ্দের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন। তা না হলে সমাজে বাড়তি অস্থিরতার আশঙ্কা রয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কিংবা ভর্তুকি দেয়ার মতো পথে না হাঁটার পরামর্শই আসছে। কারণ এক্ষেত্রে ঢালাওভাবে সুবিধা দেয়ার কারণে যাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা দরকার তাদের কাছে পৌঁছানোর ব্যয় বেড়ে যায়। তার চেয়ে যথাযথ টার্গেটিংয়ের মাধ্যমে আসলেই যাদের সহায়তা দরকার তাদের কাছে নগদ টাকা পৌঁছানোটিই বেশি কার্যকর। করোনাকালীন অভিজ্ঞতাও তাই বলে। আর ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের কল্যাণে ‘টার্গেটেড ক্যাশ ট্রান্সফার’ তো এখন অনেকখানিই সহজ হয়ে গেছে। তবে কয়েক বছর ধরে আমরা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগী ও সম্ভাব্য উপকারভোগীদের যে ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরির কথা বলে আসছি সেটি এজন্য খুবই দরকারি। এছাড়া প্রচলিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর পাশাপাশি নতুন বাস্তবতার নিরিখে কিছু উদ্ভাবনী কর্মসূচি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগও বাজেটে রাখা যায়।

কৃষি যে আমাদের অর্থনীতির রক্ষাকবচ করোনাকালেও তার প্রমাণ আমরা দেখেছি। এ খাত একদিকে কাজ হারিয়ে গ্রামে ফেরা মানুষসহ অন্যদের কর্মসংস্থান দিয়েছে। অন্যদিকে দেশজ বাজারের চাহিদাকেও বলশালী রেখেছে। চলতি অর্থবছরে আগের (২০২১-২২) বছরের চেয়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়তি বরাদ্দ রেখে মোট ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে কৃষি ভর্তুকি বাবদ। কৃষির প্রতি এ সময়োচিত নীতি-মনোযোগের প্রশংসা করতেই হয়। আসছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরও এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখা চাই। তবে গতানুগতিক উদ্যোগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি কিছু নতুন উদ্ভাবনী উদ্যোগেও বাজেট দেয়া দরকার। যেমন সোলার ইরিগেশন পাম্প ব্যবহার করে সেচ দেয়ার প্রবণতা বাড়ানোর জন্য কিছু বাজেটারি প্রণোদনার কথা ভাবা যায়। এমনটি করা গেলে সেচের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে কম রাখা সম্ভব হবে। ফলে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির চাপ থেকে কৃষি তথা গোটা অর্থনীতিকেই আরেকটু সুরক্ষিত করা যাবে।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে আমরা জানি বাজেটের সামাজিক খাত হিসেবে। সংকোচনমুখী বাজেট তো প্রণয়ন করতেই হবে। তবে এ সংকোচনের চাপ থেকে খাত দুটিকে যত সুরক্ষা দেয়া যায় ততই মঙ্গল। এজন্য স্বাস্থ্য খাতের উদাহরণ টানা যায়। বাজেটে এ খাতের জন্য সাধারণত ৫-৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকে। এটি বাড়িয়ে যদি ৭-৮ শতাংশ করা যায় এবং ওই বাড়তি বরাদ্দ যদি বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ এবং গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শূন্যপদে জনবল নিয়োগ দিয়ে তাদের পারিশ্রমিক বাবদ ব্যয় করা যায়, তাতে গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রার্থীদের অর্থনৈতিক চাপ অনেকটাই কমবে। বর্তমানে তারা মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৮ শতাংশ বহন করছে। যেভাবে বললাম সেভাবে বরাদ্দ দেয়া গেলে এ অনুপাত কমে ৫০ শতাংশে নেমে আসতে পারে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় রেখে বরাদ্দের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা গেলে মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় দুইই বাড়বে।

করোনা-পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতির গতি ঠিক রাখার জন্য অন্যতম প্রধান সহায়কের ভূমিকায় আছে। তাই এসএমই ফাউন্ডেশনে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে সামনের দু-তিন অর্থবছরের জন্য করছাড়ের কথা চিন্তা করা যেতে পারে। তাদের জন্য পুনঃঅর্থায়নের যে সুযোগ বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে দিয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন এবং তার কলেবর বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। ডিজিটাল মনিটরিং চালু করে তার ‘এন্ডইউজ’ নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশের প্রকৃত অর্থনীতির পাটাতন আরো জোরদার করা সম্ভব। বাজেটের ব্যয়ের দিক নিয়ে ভাবার পাশাপাশি আয়ের দিক নিয়েও ভাবা চাই। আইএমএফ যে ঋণ দিচ্ছে সেখানেও শর্ত হিসেবে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিষয়ে পরামর্শ রয়েছে (আসছে বছর ৬৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয়ের কথা বলা হয়েছে)। দেশের প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা আরো আগে থেকেই এ পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের আশপাশেই আটকে আছে। এখন তো তা ৮ শতাংশের কাছে। অথচ নেপালে তা ২০ শতাংশের মতো। আমরা বাংলাদেশে এ অনুপাত অন্তত ১৫ শতাংশ করার তাগিদ দিচ্ছি অনেকদিন ধরে। পুরো কর কাঠামোটিই ঢেলে সাজানোর কথা ভাবা দরকার। যেমন বর্তমানে ব্যক্তি শ্রেণীর ন্যূনতম করের যে ব্যবস্থা আছে তা বদলানোর কথা ভাবা যায়। বর্তমানে করযোগ্য আয় থাকলেই ঢাকা সিটির মধ্যে ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাকে ন্যূনতম ৫ হাজার টাকা এবং অন্য এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা কর দেয়ার বিধান রয়েছে। তার চেয়ে যার ওপর যতটুকু কর প্রযোজ্য ঠিক ততটুকু দেয়ার বিধান, যেমন হিসাব অনুসারে কারো প্রদেয় কর দেড় হাজার টাকা হলে তিনি তা-ই দেবেন—এমন নিয়ম চালু করা গেলে করদাতার সংখ্যা ও করের পরিমাণ উভয়ই উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব। নিশ্চয় নিয়মনীতি সহজ করাই সবচেয়ে ভালো প্রণোদনা। এরই অংশ হিসেবে ডিজিটালি আয়কর ফাইল দাখিলের যে সুযোগ আছে তাকে আরো কার্যকর করা প্রয়োজন। করদাতাদের এ-বিষয়ক অভিযোগ/জিজ্ঞাসাগুলো শোনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের আদলে একটি স্মার্ট হটলাইন চালু করা জরুরি। রাজস্ব বোর্ড করবিষয়ক মামলা জটের কারণে প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এডিআরসহ মামলা নিষ্পত্তি দ্রুততর করার জন্য যা যা দরকার তাই করা উচিত। বিশেষ করে বিকল্প কর নিষ্পত্তির সংস্কৃতি আরো শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।

আসন্ন বাজেটে সরকারি ব্যয়ের লাগাম তো টেনে ধরতেই হবে। তবে তা হতে হবে বাস্তবতার নিরিখে এবং সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে থাকা মানুষদের সুরক্ষাকে যথাযথ অগ্রাধিকার দিয়েই। চলমান বিশ্ব আর্থিক সংকটের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকরা এখন পর্যন্ত যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন তার ভিত্তিতে এ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নিশ্চয় রয়েছে। আইএমএফের ঋণের একটি কিস্তি এসে গেছে, আরো আসবে। তাদের দেখাদেখি বাকি আন্তর্জাতিক সহযোগীরাও এগিয়ে আসছে। জুনের আগেই এডিবির অর্থছাড়ের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকও এগিয়ে আসবে বলে আশা করা যায়। রিজার্ভ কিছুটা ক্ষয় হলেও জুন ২০২৩ পর্যন্ত তা ৩২ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে থাকবে। আমদানি কমানো সম্ভব হচ্ছে, রফতানি বাড়ছে। রমজান মাস আর দুটো ঈদের বদৌলতে আগামী কয়েক মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহও আরো চাঙ্গা হবে বলে ধরে নেয়া যায়। এ মাসের প্রথম ২০ দিনে তা ১৫ শতাংশের মতো হারে বেড়েছে। বৃদ্ধির এ হার আরো গতি পাবে আশা করা যায়। ফলে বহির্বাণিজ্যের ঘাটতি নিয়েও বড় দুর্ভাবনার কারণ দেখা যাচ্ছে না। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি এবং পশ্চিমের ব্যাংকিং সংকটের তীব্রতা ও তার ‘স্পিলওভার’ প্রভাবের ওপর। এমন বিশ্ব বাস্তবতায় এবং স্থানীয় পর্যায়ে ভরসার ক্ষেত্র খানিকটা প্রসারিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে আসন্ন অর্থবছরের জন্য বিদ্যমান সংকটের প্রতি সংবেদনশীল থেকে বাংলাদেশে একটি গণমুখী বাজেট প্রণীত হবে—সে প্রত্যাশা করাই যায়।

ড. আতিউর রহমান: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন