সিঙ্গাপুর, ঢাকা ও ভাগ্যান্বেষী তরুণ-তরুণীদের আবাসন সংকট

মো. আবিদ মঈন খান

রাজধানী ঢাকার আবাসন পরিস্থিতি আলোচনা করা হলে যেটি সবসময় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়ে থাকে তা হলো কীভাবে আরো নিরাপদ, সুলভ ও সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন পাওয়া যায়। এখানে মূলত ফ্ল্যাট ও জমি অথবা বাড়ি কেনার বিষয়টিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু সীমাবদ্ধ থাকলেও ঢাকা শহরে ভাড়া করে বসবাসরত সাধারণ মানুষকে নিয়ে কোনো আলোচনা তেমন একটা হয় না এবং এ বিষয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও নেই সম্ভবত। বর্তমানে নগরী ঢাকার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেই আর বাস্তবতা হচ্ছে, ঢাকা পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কোনো শহর নয়। তাই এ শহরে আবাসন সমস্যা দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে নগরী ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আর তাদের মধ্যে বিশাল একটি অংশ রয়েছেন যারা একাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চাকরি বা পড়াশোনাসহ নানা কাজে গ্রাম বা মফস্বল ছেড়ে ঢাকায় এসেছেন। তাদের বেশির ভাগই ঢাকার মতো ব্যয়বহুল শহরে নিরাপদে সাশ্রয়ী ভালো থাকার জায়গা খুঁজে থাকেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই অস্থায়ী আবাস হয় ঢাকার শহরের বিভিন্ন হোস্টেল, মেসে কিংবা ভাড়া বাসায়। এমনিতেই ঢাকা শহরের আবাসন ব্যবস্থা অপ্রতুল। সিঙ্গেল তরুণ-তরুণীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা আরো বেশি দুর্বিষহ ও বিড়ম্বনাপূর্ণ। এমনি বিড়ম্বনাকে সঙ্গী করে অনেকেই চালিয়ে যাচ্ছেন জীবনযাত্রা এ নগরীতে। 

ছোট এ ঢাকা শহরে প্রায় দুই কোটির ওপরে মানুষের বসবাস। এর মধ্যে কত সংখ্যক মানুষ ভাড়া বাসায় থাকে এবং কত সংখ্যক মানুষ নিজস্ব বাড়িতে থাকে, সে-সংক্রান্ত কোনো সঠিক জরিপ কারো কাছে নেই। তবে ধারণা করা হয়, ঢাকায় বসবাসকারীদের ৭০-৮০ শতাংশের ওপরে ভাড়াটিয়া। বছর কয়েক আগে করা বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী আমাদের দেশের শতকরা ২৮ ভাগ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকে। সে হিসাবে রাজধানীর মোট জনসংখ্যার ৭০-৭৫ ভাগ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকে। 

নগরীতে ভাড়াটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাদেরই সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। রাজধানী ঢাকায় ভাড়াটিয়াদের নিত্যনৈমিত্তিকভাবে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় সেগুলো হলো ঊর্ধ্বমুখী ভাড়া, যথেষ্ট পরিমাণে বাসযোগ্য বাসাবাড়ির অভাব এবং সময়ে-অসময়ে ভাড়া বাড়ানোর পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিলসহ নানা আনুষঙ্গিক খরচের বোঝা ভাড়াটিয়ার কাঁধে চাপানো ইত্যাদি। তবে এসবের মধ্যে বিশেষ করে ঢাকায় সিঙ্গেল তরুণ-তরুণীদের জন্য বাসা ভাড়া পাওয়া এখন আরো দুষ্কর এক কাজে পরিণত হয়েছে। বাড়ির মালিকরা কর্মজীবী বা শিক্ষার্থী সিঙ্গেলদের ভাড়া দিতে চান না। যদিও কোনো বাসা ভাড়া মেলে, তো সেগুলোর অবস্থা আলো-বাতাসহীন ও জরাজীর্ণ। বস্তুত পরিবার নিয়ে কেউ ওসব বাসায় উঠতে চায় না বলেই সেগুলো সিঙ্গেল তরুণ-তরুণীদের কাছে গছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এসবের সঙ্গে আছে নানা উদ্ভট সব বিধিনিষেধ। সিঙ্গেল তরুণ-তরুণীদের বাসা ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে সবসময় নিম্নমানের রুম, সবচেয়ে ওপরের তলা, নয়তো বাড়ির একেবারে নিচের তলা ভাড়া দিয়ে থাকেন বাড়িওয়ালারা। তবে সেসব বাসার ভাড়াও নেহাত কম নেয়া হয় না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর থাকার জন্য ভাড়া বাসা বা মেস পাওয়া গেলেও তার অধিকাংশই বসবাসের অযোগ্য হয়ে থাকে। 

রাজধানীতে ঢাকার আবাসন সংকট নতুন বিষয় নয়। তবে এ সমস্যা সমাধানে আমাদের সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো টেকসই পরিকল্পনা নেই বরং সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। উন্নয়নের কথা এলেই আমরা নিজেদের উন্নয়নকে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনা করে থাকি। কিন্তু আসলে কি আমরা সিঙ্গাপুরের মতো নিজের আবাসন সংকট মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি কোনো পদক্ষেপ নিতে পেরেছি? বর্তমানে সিঙ্গাপুরের ৮০ শতাংশ জনগণ তাদের ১০ লাখ পাবলিক হাউজিং অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করছে। সিঙ্গাপুরের প্রায় ৯০ শতাংশ হারে জনগণের নিজস্ব মালিকানাধীন আবাসস্থল রয়েছে। সিঙ্গাপুর ষাটের দশক থেকে পিপল অ্যাকশন পার্টির লিম কিম সান কেবিনেট মন্ত্রীর নেতৃত্বে হাউজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের নানা প্রকল্প ও কার্যক্রমের মাধ্যমে মূলত অধিগ্রহণকৃত ভূমি ও সমুদ্র অঞ্চল ব্যবহার করে পাবলিক হাউজিং প্রোগ্রামের আবাসন খাতে বৈপ্লবিক সফলতার আনতে সক্ষম হন। এর ফলে সিঙ্গাপুর এখন ২৪টি টাউনে প্রায় ৮০ শতাংশে পাবলিক আবাসনের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। মূলত সিঙ্গাপুরের আবাসন খাতে এ সফলতার কারণ তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রহণ করা আবাসন নীতি, যেখানে তারা পাবলিক ভূমি অধিগ্রহণ আইন, আবাসন খাতে ঋণ, সরকারি ভর্তুকি, জাতীয় ও সামাজিক সঞ্চয় তহবিল ইত্যাদির মাধ্যমে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ আবাসন ব্যবস্থা তৈরি করতে পেরেছে। অন্যদিকে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করা ক্ষেত্রেও সিঙ্গাপুরে নির্দিষ্ট আইন রয়েছে যা কিনা হাউজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বোর্ড মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। তাই সাশ্রয়ী মূল্যে থাকার ভাড়া পেতেও সেখানকার মানুষের সমস্যা হয় না। সিঙ্গাপুরে সিঙ্গেল তরুণ-তরুণীদের রেন্টিং অ্যাপার্টমেন্টগুলো আকারে ছোট, তবে বিলাসবহুল হয়ে থাকে। আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটে বিলাসবহুল যে সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার তার সবই পাওয়া যায় সেখানে। অর্থাৎ আধুনিক রান্নাঘর, ডিজাইনার আসবাবপত্র, উচ্চগতির ইন্টারনেট এবং অন্য সুযোগ-সুবিধা রয়েছে সেসব ভাড়া বাসায়।

বর্তমানে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক দিক থেকে বাংলাদেশ এক বিরল সম্ভাবনাময় সময় পার করছে। এ সম্ভাবনার নাম ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ হচ্ছে একটি দেশের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ যদি কর্মক্ষম হয় তাহলে দেশটি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পাচ্ছে বলে ধরে নেয়া হয়। এর মানে, এখন আমাদের দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি আর তারাই এ সময়ে আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকাকে উন্নয়ন দিকে নিয়ে যাবে। অধিকাংশ তরুণ-তরুণী শিক্ষা ও কাজের কারণে ঢাকায় আসেন আর আমরা যদি এ নতুন কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীদের শহরে এসে জীবিকা নির্বাহের জন্য সহায়ক আবাসন ব্যবস্থা তৈরি করতে দিতে না পারি। তাহলে এমন কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীদের উন্নয়নের যথাযথ শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব হবে না। নগরের আবাসন সমস্যা সমাধানে আমাদের নগরকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে, বর্তমানে বিদ্যমান সমস্যাগুলো কমিয়ে আনার জন্য যথাযথ আইন ও তার প্রয়োগ করতে হবে। সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষকে আবাসন খাতে নিয়ে বিস্তরভাবে পরিকল্পনা ও প্রকল্প হাতে নিতে হবে। আমাদের নগর কেন্দ্রীয়করণ ব্যবস্থা থেকে বিকেন্দ্রীকরণের দিকে আরো দ্রুততার সঙ্গে এগোতে হবে। উন্নত দেশের মতো ঢাকার ক্ষেত্রেও আবাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর এখন সময়ের দাবি। সেই সঙ্গে আবাসন ব্যবস্থা সাশ্রয়ী ও মানসম্পন্ন যেন হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। বাড়ি ভাড়া দেয়া এবং নেয়া সংক্রান্ত দেশে আইন আছে কিন্তু সে আইন সম্পর্কে অবহেলা ও সচেতনতার অভাব রয়েছে আমাদের মধ্যেই। ‘বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’কে সময়োপযোগী রূপে সংশোধন ও কঠোরভাবে প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে। বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়া দুজনকেই আইন মেনে চলতে হবে। তারা আইন মেনে চলছেন কিনা তা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তদারকি প্রয়োজন। তাহলেই আমরা হয়তো রাজধানীর আবাসন সমস্যা মেটাতে সক্ষম হব।

মো. আবিদ মঈন খান: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন