ট্রেনের টিকিট ক্রয়ে নতুন ব্যবস্থা, বিড়ম্বনা ও কালোবাজারি প্রতিরোধ

মো. আবিদ মঈন খান

দেশের বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে আরাম ও স্বস্তিদায়ক যাত্রার অন্যতম একটি হলো ট্রেন। দেশের বড় অংশের মানুষ ট্রেনকে ভ্রমণ ও যাত্রার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। আবার অনেকেই বাসে চলাচল করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করার কারণে ট্রেন বেছে নেন। তবে আমাদের ট্রেনের স্বস্তির পরিবহনে অস্বস্তির বিষয় হলো ট্রেনে টিকিট নিয়ে চলমান কালোবাজারি। ট্রেনের টিকিট নিয়ে কালোবাজারির দৌরাত্ম্য দূর করতে ট্রেন ভ্রমণে নতুন নিয়মে টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ১ মার্চ থেকে আন্তঃনগর ট্রেনে চালু হয়েছে এ ব্যবস্থা। টিকিট যার, ভ্রমণ তার’-এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ট্রেনের অনলাইনে ও অফলাইনে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। টিকিট ব্যবস্থাকে আপগ্রেড, টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধ, বিনা টিকিটে ভ্রমণে জরিমানা করা এবং ভাড়া আদায় সহজ করার লক্ষ্যে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বাংলাদেশ রেল কর্তৃপক্ষ।

মূলত আগে অনলাইনে টিকিট ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কালোবাজারিরা বিভিন্ন নামে টিকিট কেটে রাখে। পরে ট্রেন ছাড়ার আগে তারা দ্বিগুণ দামে তা যাত্রীদের কাছে বিক্রি করে। অথচ যাত্রীরা অনলাইন বা স্টেশনের কাউন্টারে টিকিট পায় না। এটা বন্ধ করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে টিকিট কাটতে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র।

বাংলাদেশ রেলওয়ের এ কার্যক্রমে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে রেলওয়ের আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিটিং ব্যবস্থা, টিকিট চেকিং ব্যবস্থায় পয়েন্ট অব সেল (পিওএস) মেশিন বসানো এবং অনলাইনের মাধ্যমে কেনা টিকিটের মূল্য অনলাইনে রিফান্ডের ব্যবস্থা করা—এ তিন সেবা সংযোজন করছে। ট্রেনের টিকিট সংগ্রহের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, একটি জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে একসঙ্গে চারটি টিকিট সংগ্রহ করা যাবে। একটি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে সপ্তাহে দুবার টিকিট নেয়া যাবে। শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে টিকিট কেনা যাবে, আর যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই তারা জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্ট দিয়েই টিকিট কিনতে পারবেন। বিদেশী নাগরিকরাও একইভাবে পাসপোর্টের মাধ্যমে টিকিট কিনতে পারবেন। রেলওয়ের কর্তৃপক্ষ বলছে, ট্রেনের নতুন টিকিট কাটার নিবন্ধন ব্যবস্থায় জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে কেনা হলে সেখানে নাম উল্লেখ করা থাকবে এবং নির্দিষ্ট এনআইডির বিপরীতে একসঙ্গে চারটি টিকিট যেহেতু কেনা যাবে তাই এখানে আগের মতো নাম ছাড়া টিকিট যেভাবে কালোবাজারি করা হতো সেটার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে দালালের মাধ্যমে অধিক দামে ট্রেনের টিকিট ক্রয় ও কালোবাজারি বহুদিন ধরেই হয়ে আসছে। রেলের ভেতরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার মাধ্যমে ট্রেনের টিকিট বাইরে কালোবাজারে বিক্রি করা হয়। যার কারণে সাধারণ যাত্রী এসব কালোবাজারির কাছে জিম্মি হয়ে ছিলেন এত দিন।

চলমান রেলওয়ের এমন অবস্থায় রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে টিকিটিংয়ের নতুন পদ্ধতিকে যদিও স্বাগত জানিয়েছে সাধারণ যাত্রীগণ। এ নতুন টিকিটিং ব্যবস্থার শুরুর দিকে নিবন্ধন নিয়ে নানা বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে যাত্রীদের মধ্যে। বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমানে নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি শুরু করছে। কিন্তু নানা জটিলতায় টিকিট ঠিকমতো কাটতে পারছে না যাত্রীরা। এ কার্যক্রম চালু হওয়ার পর থেকেই ওটিপি, ওয়েবসাইট ওভার লোডিং ও সার্ভারজনিত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে রেলের টিকিটিং সিস্টেম। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ যাত্রীরা।

রেলওয়ের নতুন টিকিট ব্যবস্থায় শুরুতেই যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এখানেই আমাদের রেল কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাব স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে। অনলাইন নিবন্ধনের মাধ্যমে টিকিট কেনার নতুন পদ্ধতিতে একজনের এনআইডি নম্বর এবং একটি মোবাইল ফোন প্রয়োজন হওয়ায়, অনেকেই প্রথম দিকে তাদের আন্তঃনগর ট্রেন ভ্রমণের জন্য টিকিট ঠিকমতো কিনতে পারেননি। আমাদের গড় শিক্ষিত মানুষের বুদ্ধিমত্তার পরিপ্রেক্ষিতে, রেলের টিকিট বুক করার জন্য মোবাইল ফোন পরিচালনা করা নিয়মিত ব্যবহারকারীদের কঠিন কোনো কাজ হবে না। তারা বেশ সাবলীলতার সঙ্গে কাজটি সম্পাদন করতে পারবেন। কিন্তু নতুন টিকিটিং ব্যবস্থায় ফিচার বা বাটন ফোন ব্যবহারকারীরা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। তাদের মোবাইল অপারেশন যেহেতু শুধু কল করা এবং গ্রহণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তারা সবাই এসএমএস সেবা ব্যবহারের সঙ্গে এতটা পরিচিত নন, কিন্তু নতুন রেলের টিকিটিং প্রক্রিয়ায় নিবন্ধনের জন্য ইন্টারনেট ছাড়াও একটি নির্দিষ্ট এসএমএস ব্যবহার করার ক্ষমতা প্রয়োজন। এছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও সেখানে থাকা নাম, জন্মতারিখ ইত্যাদি নির্বাচন কমিশনে রাখা সার্ভারের সঙ্গে মেলাতে হবে। এ প্রয়োজনীয়তাগুলো পূরণ করার পর একটি ভ্রমণের জন্য টিকিট সংগ্রহ করা যেতে পারে।

তবে যারা তাদের মোবাইল সেট ব্যবহারে পুরোপুরি অভ্যস্ত নন, তাদের জন্য এটি একটি কষ্টকর কাজ হবে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ স্পষ্টতই, আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট যাতে কালোবাজারিরা কাটতে না পারে সেজন্য অনলাইন টিকিটের এ উদ্যোগ নিয়েছে। অন্যদিকে টিকিট ছাড়া রেলপথে যাতায়াত বন্ধ করাও এ ব্যবস্থার অন্যতম কারণ। এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের টিকিট পেতে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) মাধ্যমে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করেছে।

মূলত বাংলাদেশের মতো জায়গায় এমন একটি কার্যক্রম অনেকটাই র‍্যাডিক্যাল হওয়ায় চূড়ান্ত পর্যায়ের আগে ব্যাপক প্রস্তুতি, পরীক্ষামূলক পাইলট প্রোগ্রামিং করা উচিত ছিল। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কমলাপুর স্টেশনে একটি ইম্প্রোভাইজড হেল্প ডেস্ক খুলেছে তবে শতাধিক যাত্রীর জন্য একটিমাত্র ডেস্ক প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এছাড়া অনেকেরই শুরুর প্রথম দিনে নিবন্ধনের সময় (ওটিপি) ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড আসছিল না যার কারণে অনেকের নিবন্ধন ও যাত্রা বিলম্ব হয়েছে। আর অনেকের কাছে তথ্য না থাকায় পরিচয়পত্র না নিয়ে স্টেশনের টিকিট কাউন্টারে এসে ঘুরে ফিরে যাচ্ছে তারা। আবার মোবাইল ফোন না থাকায় অনেকেই পড়ছেন বিড়ম্বনায়। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয়েছে বয়স্ক টিকিটপ্রত্যাশীদের।

পর্যাপ্ত পরিমাণে সুদূরপ্রসারী চিন্তা না করে এমন ব্যবস্থাকে প্রয়োগ করার ফলেই শুরুর দিকে যাত্রীদের বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে যেসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এখনো জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্ট নেই তাদের জন্য বিকল্প পন্থা বের করা উচিত। এখনো নতুন পদ্ধতিতে সব যাত্রী অভ্যস্ত না হতে পারায় ট্রেনের টিকিট বিক্রি কিছুটা কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজস্ব আয়েও। রেলের টিকিটিংয়ের নতুন ব্যবস্থায় সময়ের সঙ্গে সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেলে আশা করা যায় সব আবারো স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আসছে ঈদে ঘরমুখো মানুষ যেন ঠিকমতো রেল সেবা গ্রহণ করতে পারে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।

ব্যাপক অব্যবস্থাপনা, লোকসান এবং অন্যান্য অনিয়মের পটভূমিতে, রেলওয়ের নতুন টিকিটিং ব্যবস্থার উদ্যোগটি একটি দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা ছিল। কয়েক দশক ধরে সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড, আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির পর রেলওয়ে সত্যিকার অর্থে রক্তশূন্য অবস্থায় নেমে এসেছে তা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটি সুস্থধারার সূচনা হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের গৃহীত নতুন টিকিট ব্যবস্থা তার সব অসুস্থতা সংশোধনের একটি পদক্ষেপ মাত্র। দেশে রেলের কালোবাজারি অনেক পুরনো সমস্যা এটি থেকে নানা সময়ে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে করে যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়লেও টিকিট কালোবাজারি ও দালাল দৌরাত্ম্য কম হয়নি। যাত্রীদের নিবন্ধনের মাধ্যমে টিকিট কালোবাজারি কতটা বন্ধ হবে মূলত তা নির্ভর করবে এর সঠিক যথাযথ প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনার ওপর।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন