দক্ষিণ এশিয়ায় আইএমএফের কর্তৃত্ব চীনের স্বার্থে আঘাত হানছে কি

সাইফুল ইসলাম বাপ্পী

চলতি সপ্তাহেই শ্রীলংকাকে ২৯০ কোটি ডলারের ঋণের অর্থছাড়ের অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরিচালনা পর্ষদ। যদিও সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা কলম্বোকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, দেশটিকে কর সংস্কার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে হবে। অন্যথায় দেশটি সংকটের আবর্তেই ঘুরতে থাকবে।

ঠিক একই দিনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ঋণের শর্ত হিসেবে বলা নীতিগত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নেরউল্লেখযোগ্য মাত্রায়অগ্রগতি পেয়েছে পাকিস্তানও। সংস্থাটির পাকিস্তানে নিযুক্ত আবাসিক প্রতিনিধি এসতার পেরেজ রুইজের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, আর কিছু বিষয়ের নিষ্পত্তি হলেই দুই পক্ষের মধ্যে কর্মকর্তা পর্যায়ের একটি চুক্তি হবে। এর মধ্য দিয়ে নীতিগত সংস্কারগুলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষের যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থের সংস্থান হয়, তা নিশ্চিত করা হবে।

আইএমএফের শর্তমাফিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়ে চলছে বাংলাদেশও। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন শেষে প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড়ও করেছে সংস্থাটি।

দক্ষিণ এশিয়ায় ঋণদাতা দেশগুলোর মধ্যে চীনকেই দেখা হয় সবচেয়ে প্রভাবশালী হিসেবে। ভারত ভুটান বাদে অঞ্চলের অন্যান্য দেশে গত কয়েক বছরে চীনা অর্থায়নে নেয়া হয়েছে একের পর এক প্রকল্প। বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়নকে চীনের আঞ্চলিক সফটপাওয়ার (কোনো দেশ বা অঞ্চলে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা) বিস্তারের বড় একটি অনুষঙ্গ হিসেবে দেখেন ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকরা। বিশেষ করে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা পাকিস্তানআইএমএফের ঋণগ্রহীতা তিন দেশই চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের (বিআরআই) গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচিত। চীনের কাছ থেকে নেয়া বিপুল পরিমাণ ঋণকে অঞ্চলের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে বহুলাংশে দায়ী করে এসেছেন বেইজিংয়ের সমালোচকরা।

শ্রীলংকা এরই মধ্যে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানও দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশে তেমন সংকট দেখা না দিলেও বিভিন্ন সময়ে চীনা ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। ঠিক এমন মুহূর্তে বর্তমান পরিস্থিতিতে রিজার্ভ সংকট মোকাবেলায় তিন দেশকেই মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে আইএমএফের। আইএমএফের ঋণের শর্ত মেনে সামষ্টিক অর্থনীতিতে একের পর এক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে দেশগুলো। বিষয়টি অঞ্চলের অর্থনীতিতে বেইজিংয়ের প্রভাব নিয়ে আলোচনায় নতুন করে উত্সাহী করে তুলছে পর্যবেক্ষকদের।

তাদের ভাষ্যমতে, কিছুদিন আগেও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় অন্যতম প্রভাবশালী অনুষঙ্গ ছিল চীনা ঋণ। বর্তমানে দেশগুলো অর্থনীতিতে নানা সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে আইএমএফের শর্তের ভিত্তিতে। আঞ্চলিক অর্থনীতিতে এখন অনেকটাই কর্তৃত্বশালী হয়ে উঠেছে আইএমএফ। চীনের অর্থনৈতিক সফটপাওয়ারে এরই মধ্যে ভাগ বসিয়েছে সংস্থাটি। অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার নিয়ে চীনের সঙ্গে দেশটির বৈরী প্রতিবেশী পশ্চিমাদের এক ধরনের ভূরাজনৈতিক টানাপড়েন অনেক আগে থেকেই রয়েছে। সামনের দিনগুলোয় টানাপড়েনে নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পারে আইএমএফের ঋণ।

বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইএমএফকে বলা যায় পশ্চিমের হাতিয়ার। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তারা এটা ব্যবহার করবে। এক্ষেত্রে ভূরাজনীতি তো কিছুটা কাজ করবেই। তবে শ্রীলংকার বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে ভূরাজনীতির চেয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেই বেশি দায়ী করতে হয়। দেশটিতে অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে শুধু রাজনৈতিক সুবিধার জন্য। কিন্তু পরে এগুলো কোনো কাজে আসেনি। কিন্তু ঋণের বোঝা ঠিকই টানতে হয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে বিষয়টি বড় মাত্রায় ভূরাজনৈতিক। দেশগুলো যখন বিপদে পড়েছে, আইএমএফের কাছে যেতে হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘আইএমএফের ক্ষেত্রে একটি সুবিধা হলো প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ পাওয়া যায়, কিন্তু আগে কিছু প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়। আর এসব ক্ষেত্রে কী পরিমাণ ঋণ দেয়া হচ্ছে, কী শর্তে দেয়া হচ্ছে, তা গোটা পৃথিবীর সবাই জানতে পারবে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীন, ভারত বা সৌদি আরবের মতো নতুন অনেক দাতাদেশের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে, যাদের ঋণের শর্ত বা তথ্য অনেকটাই অস্বচ্ছ বা অস্পষ্ট। কারণে এসব ক্ষেত্রে আইএমএফের ঋণের মতো স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতার গ্যারান্টি তেমন একটা নেই।

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে মুহূর্তে বড় একটি সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারি ঋণ। আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি শতকের শুরুতে ২০০১ সালেও অঞ্চলে সরকারি ঋণ জিডিপির অনুপাত ছিল ৬০ শতাংশ। সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে ২০১১ সালে তা দাঁড়ায় ৭৬ শতাংশে। ২০২০ সাল শেষে তা আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮ শতাংশে।

শ্রীলংকায় ঋণের অর্থ অনুমোদন প্রসঙ্গে গতকালও এক বক্তব্য দিয়েছে আইএমএফ। এতে বলা হয়, প্রচ্ছন্ন দুর্নীতি যাতে দেউলিয়া অর্থনীতিতে আইএমএফের বেইলআউটের প্রভাবকে খর্ব করতে না পারে সে বিষয়ে শ্রীলংকাকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। সংস্থাটির শ্রীলংকা মিশনের প্রধান পিটার ব্রুয়ার জানান, দেশটির সরকার দুর্নীতি প্রতিরোধে শক্ত আইন বাস্তবায়নের শর্তকে মেনে নিয়েছে।

দেশটিতে রাজাপাকসে সরকারের আমলে চীনের অর্থায়নে নেয়া প্রকল্পগুলোয় ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ছিল, বিপুল পরিমাণ অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে রাজাপাকসে সরকার চীনকে একের পর এক প্রকল্পে অর্থায়নের সুযোগ করে দিয়েছিল। তবে শ্রীলংকার বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে বেইজিংয়ের বৈরী দেশগুলো চীনা ঋণকে দায়ী করলেও দেশটির মোট ঋণ পোর্টফোলিওতে এর অবদান ছিল ১০ শতাংশ। অধিকাংশই ছিল আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থেকে নেয়া উচ্চসুদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ।

শ্রীলংকা আইএমএফের বেইলআউটের অর্থ পাচ্ছিল না চীনের কাছ থেকে নেয়া ঋণ পুনঃতফসিল না হওয়ার কারণে। বেশ কিছুদিন অপেক্ষার পর চীন সম্প্রতি এতে সম্মতি দিলে আইএমএফের অর্থ পাওয়ার পথ খুলে যায় শ্রীলংকার সামনে।

বিআরআই প্রকল্পের আওতায় চীনের কাছ থেকে ঋণের ভিত্তিতে সড়ক যোগাযোগ এবং বন্দর অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে পাকিস্তান। দেশটির বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে বিদ্যুৎ খাতকেই দায়ী করা হয় সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তানকে আইএমএফের ঋণ দেয়ার সবচেয়ে বড় শর্ত ছিল বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার।

তবে চীনা ঋণের মতো আইএমএফের ঋণ নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণের জন্য আইএমএফের পক্ষ থেকে যেসব শর্ত চাপানো হয় তাতে জনকল্যাণের চেয়ে বাণিজ্যিক বিষয়গুলোই প্রাধান্য পায় বেশি।

বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক . রাশেদ আল মাহমুদ তীতুমির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শ্রীলংকা, পাকিস্তান বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপটগুলো পুরোপুরি ভিন্ন। তবে সার্বিকভাবে বলতে গেলে আইএমএফের ঋণের ক্ষেত্রে প্রথমত সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ তৈরি হয় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোসহ বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। সংস্কারগুলোর অভিঘাত পড়ে নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের ওপর। আবার গ্রহীতা দেশগুলোর ক্ষেত্রেও দেখা যায় শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে শর্ত পূরণ করার চেষ্টা করা হয়। এভাবে পাকিস্তান অন্তত ২২ বার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘এক্ষেত্রে আমরা তিনটি বিষয় লক্ষ্য করেছি। প্রথমত, রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কারণে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমরা দেখেছিলাম নতুন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের জন্ম। নতুন ঋণদাতারা আসছে আঞ্চলিক বৈশ্বিক প্রভাবকে সামনে রেখে। ঋণ এক সময় আবির্ভূত হলো সফটপাওয়ার হিসেবে। এর মধ্যে আবার প্রতিযোগিতাও থাকে। এর মধ্যে একজনের প্রকল্পকে আরেকজনের নাকচ করার প্রবণতাও থাকে, যা আমরা মালদ্বীপের ক্ষেত্রে দেখেছি। তৃতীয়ত, যারা নতুন আসছে তাদের অভিজ্ঞতা না থাকার কারণেও অসুবিধা হচ্ছে।

শ্রীলংকা পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও চীনের বিনিয়োগগুলো এখন অনেক কঠিন সময় পার করছে। দেশটি থেকে নেয়া ঋণের ভিত্তিতে নির্মিত প্রকল্পগুলোর অনেকগুলোই এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এনে দিতে পারেনি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন খাতে ঋণ অনুদান হিসেবে মোট হাজার ৭৭ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। এর মধ্যে প্রায় ৬৪৪ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে। অনুদান হিসেবে এসেছে খুব সামান্য। সিংহভাগই ঋণ, যার বেশির ভাগই এসেছে গত দুই দশকে।

চীনা ঋণ আইএমএফের ঋণের মধ্যে কোনো সাংঘর্ষিক বিষয় নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘চীন পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়েও বেশি ঋণ দেয়। বর্তমান সময় চীনের ঋণ দেয়ার হার অনেক বাড়বে। এটি এখন খুব বেশি হয়ে যায়নি। এখন আইএমএফ যে ঋণ বাংলাদেশ, শ্রীলংকা পাকিস্তানকে দিচ্ছে, সেটি চীন থেকে নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ চীনও আইএমএফের সদস্য। এখন আমরা যদি চীন থেকে ঋণ নিতে চাই তাহলে নিতে পারব। আইএমএফ শুধু দেখবে আমরা যেন নীতির কোনো বরখেলাপ না করি। আমরা যেন অনেক বেশি ঋণ না নিয়ে ফেলি।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন