এএলআরডির সেমিনারে বক্তারা

পরিবার থেকেই নারীদের অবমূল্যায়ন শুরু হয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে বক্তব্য রাখেন আলোচকরা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

পরিবারের মধ্যেই নারীকে অধস্তন করে রাখা হয়। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নারীকে সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে এমন ঘটনা খুবই কম। বেশির ভাগ নারী তার প্রাপ্য ভূমি থেকে বঞ্চিত হন। পরিবার থেকেই নারীদের অবমূল্যায়ন শুরু হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশে নারীর ভূমি সম্পত্তিতে অধিকারের বাস্তবতা: রাষ্ট্রের দায়িত্ব করণীয় শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রতি সিডও কমিটির সমাপনী পর্যবেক্ষণ বাস্তবায়নে অগ্রগতি বাংলাদেশে নারীর ভূমি, সম্পত্তি উত্তরাধিকারের বাস্তব অবস্থা নিয়ে সেমিনারে আলোচনা হয়। অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) চেয়ারপারসন মানবাধিকার নেত্রী খুশী কবিরের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মানবাধিকার আইনজীবী এবং জেন্ডার টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ . ফস্টিনা পেরেরা এএলআরডির উপনির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি।

. ফস্টিনা পেরেরা তার প্রবন্ধে বলেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা উল্লেখ থাকলেও আমরা যে সামাজিক পারিবারিক ভিত্তির মধ্যে বসবাস করি সেখানে পারিবারিক সামাজিক চর্চার কারণে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে উল্লেখিত অধিকারের সুফল ভোগ করতে পারি না। ভূমি বা সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা। অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের চুক্তি রয়েছে। সংবিধানের বিভিন্ন ধারা পড়লে সংবিধানকে বিষয়ে দোষারোপ করা যাবে না। বিধিবিধানগুলো ভালো। কিন্তু ভালো উদ্দেশ্য থাকলেই হবে না, বাস্তবায়ন করতে হবে। যত জায়গায় আইন-কানুন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতামত নিয়ে সেগুলোকে একত্র করতে হবে। দেশে পুরুষের চেয়ে নারী বেশি। যদিও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীদের নম্বরে রাখা হয়।

সিডও বাংলাদেশ প্রতিবেদন, নারীর ভূমি কৃষির অধিকার: নাগরিক উদ্বেগবিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে রওশন জাহান মনি বলেন, সিডও ২০১৬ সালে ২৭টি ইস্যুতে ৫৮টি সুপারিশ করে, যার মধ্যে ১৬টি নারীর ভূমি, উত্তরাধিকার, সম্পত্তির অধিকার বা নারীর সমান অধিকারের সঙ্গে যুক্ত। অনুচ্ছেদ ১০-১১-তে অভিন্ন পারিবারিক আইনের কথা বলা হয়েছে। যদিও আমাদের আইন ভিন্ন। নারীদের উন্নয়নের জন্য জাতীয় কৌশল থাকলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দেশে নারী নির্যাতন  নির্যাতন প্রতিরোধে আইন থাকলেও প্রতিনিয়ত নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েই চলছে। বিশেষ করে সিডও থেকে আদিবাসী নারীদের ভূমির অধিকারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সিডও থেকে অনেকগুলো সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো আমরা আমাদের দেশে বাস্তবিকভাবে দেখছি না। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব ধরনের ভূমি আইন, নীতিমালা, প্রবিধান বাতিল করতে হবে। এছাড়া সিডও সনদের ধারা ১৬.()-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।

সময় প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন কবি প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস ডাইভারসিটির পরিচালক নবনীতা চৌধুরী, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক . মেঘনা গুহঠাকুরতা, বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য লাকি আক্তার এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।

সোহরাব হাসান বলেন, বাংলাদেশে সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র সবই পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষতান্ত্রিক মানেই স্বৈরতান্ত্রিক। ধনী-গরিব বৈষম্য, নারীর প্রতি পুরুষের বৈষম্যমূলক আচরণ, বাঙালি-পাহাড়ি বৈষম্য এগুলো দূর করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ তৈরি করতে হবে। দাবিগুলো না শোনার বা অস্বীকৃতির চর্চা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে সেটা আইন বা সংবিধানে থাকলেই হবে না। তার জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। নারীদের এত দুঃখ-কষ্ট কিছুই রাষ্ট্রকে নাড়া দিতে পারেনি। রাষ্ট্র বধির। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের যে ত্যাগ তা আমাদের ইতিহাসে লেখা নেই। রাষ্ট্র যতই বধির হোক, যতই না শুনতে চাক, রাষ্ট্রকে তা শুনতে বাধ্য করতে হবে।

নবনীতা চৌধুরী বলেন, ভূমি হলো শক্তি। নারীর শক্তিহীনতার অন্যতম কারণ হলো ভূমিহীনতা। ভূমি কৃষিজমির অধিকার পূরণ না হওয়া পর্যন্ত নারীর কোনো অধিকার পূরণ হবে না। অধিকারগুলো নিয়ে নারীরা নারীদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে পারে সে বিষয়টা বিবেচনায় আনতে হবে। দেশে মাত্র শতাংশ ভূমির মালিকানা নারীর কাছে আছে। জমি ভাগাভাগির সময়ে খারাপ জমিটাই নারীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এসব কথা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। নারীদের জমির অধিকার নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশে কৃষির বর্তমান অবস্থা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে লাকী আক্তার বলেন, রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় নারী কৃষকসংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায়ন নেই। কৃষিতে নারীকে অবদানের পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি দিতে হবে। খাসজমি বন্দোবস্ত প্রদানের ক্ষেত্রে নারীর জন্য যে শর্ত জুড়ে দেয়া আছে, সেটি বৈষম্যমূলক। ছাত্রজীবন শেষে আমার মনে হয়েছে কৃষি নিয়ে আমি কাজ করতে চাই। অনেকেই আমাকে নিরুত্সাহিত করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন আপনার তো কোনো জমিই নেই। আপনি তাহলে কীভাবে কৃষক সমিতি করবেন? বিষয়টা আমাকে খুব ভাবিয়েছে। বাংলাদেশে ৮০ ভাগ মানুষ কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। দেশের জিডিপিতে নারীদের যে শ্রম তা কি গণনা হয়? শেরপুরের একজন নারী আমাকে বলছিলেন যে তিনি ৭০ টাকা মজুরি পান। আবার পুরুষ ১২০ টাকা পাচ্ছে। সব জায়গায় একই অবস্থা। সমমজুরি নেই। ভূমিতে নারীর কোনো অবস্থান নেই বললেই চলে। কৃষির সংকট জাতীয় সংকট। এর সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী নারীরা।

. মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, আগেও নারীর জমির ওপর অধিকার ছিল না, এখনো আসেনি, কৃষির ক্ষেত্রেও একই। মজুরির বিষয়েও কোথাও অর্ধেকটা দেয়া হয়, কোথাও কিছুটা কম। ভূমিতে যে নারীর অনধিকার, সেটার জন্য নারী কাঠামোগতভাবে দুর্বল। নারীর ভূমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বিবেচনায় নিতে হবে। সমাজের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পুরুষের পক্ষে, সুতরাং পুরুষ কেন সুযোগ-সুবিধা ছাড়বে। কিন্তু এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন আসছে নারী-পুরুষের একসঙ্গে কাজ করার। সমাজের বিশেষ কিছু বিষয় আছে যেগুলোয় শুধু পুরুষরা কিংবা শুধু নারীরা প্রতিবাদ করে পারবে না। তার জন্য নারী-পুরুষ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

শামসুল হুদা বলেন, সমাজ যখন পুরুষতান্ত্রিক স্বৈরতান্ত্রিক হয় তখন তার বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। মুক্তিযুদ্ধের একটি পর্ব আমরা শেষ করেছি। আরেকটি পর্ব হতে হবে জাগরণের। পর্বে নারীদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। নারীরা জাগলে, সংগঠিত হলে, ঐক্যবদ্ধ হলে এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবে। নারীর মধ্যে বিভিন্ন ক্যাটাগরি আছে, বাঙালি, আদিবাসী, দলিতনানা ধরনের স্বীকৃতি আছে। লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও নারীরা সামনে।

সমাপনী বক্তব্যে খুশী কবির বলেন, ভূমি সম্পত্তিতে নারীর অবস্থান কী? রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা বা ভূমিকা কী? একজন নারী যত যা- করুক, যদি সম্পত্তি বা ভূমির ওপর কোনো নিশ্চয়তা না থাকে তাহলে কোনো লাভ নেই। এখানে রাষ্ট্রের একটা ভূমিকা আছে। আমরা যারা নাগরিক তারা আওয়াজ না তুললে রাষ্ট্র এককভাবে কিছু করতে পারবে না। আমাদের নিজেদের প্রস্তুত করি। চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করি। আশপাশে যারা আছে তাদের চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করি। নারীদের যেন তারা মানুষ হিসেবে মনে করে। একে অন্যের প্রতি সম্মানবোধ তৈরি করতে হবে। আমরা কৃষকদের আন্দোলনগুলোকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। বর্তমান প্রজন্ম যেন ভুলে না যায়।

সেমিনারে মুক্ত আলোচনায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। দিনাজপুরের আদিবাসী নেত্রী সারা মারান্ডী বলেন, নারীরাও হাতে হাত রেখে যুদ্ধ করেছে। গবেষণায় আমরা দেখেছি, সমতলের প্রায় ৭০ ভাগ আদিবাসী যুদ্ধ করেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, অনেকেরই নাম আসেনি। অনেক নারী জানেনই না কোথায় নাম লেখাতে হবে। ভূমি শুধু আয়ের উত্স না, বরং অস্তিত্বের বিষয়। বিভিন্ন অছিলায় এখনো ভূমি দখল হচ্ছে। এর ভুক্তভোগীর বেশির ভাগই নারী। পার্বত্য অঞ্চলে ভূমি দখলকে কেন্দ্র করে হত্যা নির্যাতনের ঘটনা সবাই জানে। এমন সারা দেশে অহরহ ঘটছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন