রাজনীতি ও আমাদের নীরবতার কুণ্ডলী

পাপলু রহমান

রাজনীতি আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক অনুষঙ্গ। সমাজ, পরিবেশ, অর্থনীতি নিয়ে প্রতিদিনের ছোট ছোট প্রশ্ন, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ সবটাই রাজনীতির বিষয়। যখন দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়, হাসপাতালে ঠিকঠাক চিকিৎসা মেলে না, যখন পরীক্ষার ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল প্রকাশ পায়, সড়কে তরতাজা প্রাণ ঝরে বা ন্যায্য বিচার দাবিতে মানুষ মুখ খোলে কিংবা রাস্তায় নামে তখন সেটা অবশ্যই রাজনীতি।

কিন্তু আমাদের দেশে অনেকে রাজনীতি মানে দল ও দলীয় পরিচয়কেই বুঝে থাকেন। তাদের মতে, যারা দল করেন, রাজনীতি নিয়ে তারাই কথা বলবেন। বাদ বাকিদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। কিন্তু মাথা তারা ঠিকই ঘামান। যখন দেখেন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা উপার্জন করেছেন তা দিয়ে এক কেজি মাংসও কেনা যাচ্ছে না, তখন ঠিকই রাজনৈতিক চক্রে আবদ্ধ হন। 

কিছুদিন আগে সদরঘাট বাস টার্মিনালে সিপিবির একটি মিছিল যাচ্ছিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ওই মিছিলে মাত্র ৫-৭ জন ছিলেন। লাল রঙের একটা ব্যানার ধরে তারা স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছিলেন। স্লোগানে বলছিলেন, ‘বাঁচার মতো বাঁচতে দাও, নইলে গদি ছেড়ে দাও।’ সেই সময় পাশ থেকে এক মধ্যবয়সী নারীকে বলতে শুনলাম, ‘এ মিছিলে আর লোক নাই কেন? তারা তো ঠিকই বলতেছে।’

বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, ‘দেশের মানুষের আয় বাড়ছে না; কিন্তু প্রতিদিনই দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলছে। সাধারণ মানুষ সংসার চালাতে পারছে না। এখন ২৫০ গ্রাম মাংস বিক্রি হচ্ছে; কিন্তু ক্রেতা নেই। গরুর মাংস প্রায় ৮০০ টাকা হয়েছে। আমদানিকারকরা চিনির কেজি ৫০০ টাকা ঘোষণা করলে, সেই দামেই চিনি কিনতে হবে। সরকার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না’ (সূত্র: যুগান্তর, ৭ মার্চ, ২০২৩)

প্রকৃতপক্ষে জিএম কাদেরের এ উপলব্ধি আপামর জনগণের মন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সাধারণ জনগণ রাজনীতি না বুঝলেও দৈনন্দিন ক্ষোভ-অসন্তোষ ঠিকই প্রকাশ করে, সেটার হয়তো বিস্তার হয় না। মনে রাখা দরকার, তারা রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে না জড়ালেও রাজনৈতিক ঘূর্ণিপাকেই থাকেন। অতি সাম্প্রতিক পত্রিকার পাতা উল্টালে দেখা যাবে, হজ পালনে হাজিদের কাছে অতিরিক্ত টাকা নেয়া হচ্ছে, একশ্রেণীর মানুষ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করছে, অসহনীয় দ্রব্যমূল্যের বাজার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম ঘন ঘন বাড়ছে, বায়ুদূষণে ফুসফুসে রোগের হার বৃদ্ধির মতো চতুর্মুখী সংকট। এসব বিষয় নিয়ে জনগণ এখন আর প্রতিবাদ জানান না, রাস্তায় নামেন না। 

আইএমএফের ঋণে দেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে কিনা, আদানির বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি লাভজনক কিনা কিংবা খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা নিয়ে জনগণের মাথাব্যথা নেই। জনগণ নির্বাক হয়ে গেছে। অর্থাৎ জনগণ সবকিছু দেখছে, জানছে কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না, সরব হচ্ছে না। সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিষয়ে এ প্রবণতার নাম হলো ‘স্পাইরাল অব সাইলেন্স’ বা নীরবতার কুণ্ডলী। জার্মান নাগরিক এলিজাবেথ নোয়েল নিউম্যান এ তত্ত্বের প্রবক্তা। তিনি একজন রাজনৈতিক গবেষক ছিলেন। তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করার আগে জিএম কাদেরের বক্তব্য আরো টানতে চাই। 

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে নির্বাচনগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আস্থা নেই বললেই চলে। আমি যতটুকু দেখেছি, নির্বাচনে সঠিকভাবে জনগণের প্রত্যাশা বা জনমতের প্রতিফলন হচ্ছে না। এ কারণে আজকাল ভোট নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে অনেকটা অনীহা দেখা যাচ্ছে।’ রংপুরে জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের কবর জিয়ারত শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। দেশের রাজনীতি বিরাজনৈতিকীকরণ হয়ে গেছে মন্তব্য করে জিএম কাদের বলেন, ‘এটি আমাদের দেশের জন্য কখনই মঙ্গলজনক নয়। জনগণ নির্বাচনবিমুখ হয়েছে। বলতে গেলে রাজনীতিবিমুখ হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল চেতনা দেশের মালিক হবে জনগণ। এটি আমার মনে হয় বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমরা চাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।’ ভারতের সংবিধানের উদাহরণ দিয়ে জিএম কাদের বলেন, ‘ভারতে সংবিধান মেনে সুন্দর নির্বাচন হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে সংবিধান মেনে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে না। সরকার সবকিছু কুক্ষিগত করে রেখেছে। সরকার যখন পক্ষ হয়, তখন নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় না। সরকারের পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়।’ নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‌সরকারি কর্মকর্তারা, এমনকি নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন সরাসরি সরকারদলীয় মানুষ হিসেবে কাজ করে।’ (সূত্র: প্রথম আলো, ২ মার্চ ২০২৩)

জাপা প্রধানের এসব অভিযোগের নেপথ্যে ২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল অনেকটা দায়ী। সংবিধানে দলীয় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ ও বিদ্যমান সংসদ সদস্যদের পদ বহাল রেখে তাদের অধীন প্রশাসনযন্ত্রের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়। এ ব্যবস্থার অধীনে ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ জন সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ সালেও একইভাবে নির্বাচনের আয়োজন হলে বিএনপি বাধ্য হয়ে একতরফা নির্বাচন ঠেকাতে অংশ নেয়। কিন্তু সে নির্বাচনও মারাত্মক বিতর্কের জন্ম দেয়। দেশ-বিদেশে অভিযোগ ওঠে, নির্বাচনের আগের রাতেই বিশেষ কায়দায় বিশেষ প্রতীকের পাশে সিল মারা হয় এবং দিনের বেলায় নির্বাচনী মহড়া দেয়া হয়। এভাবে জনগণের কাছে নির্বাচন করার অর্থ দাঁড়ায়, আওয়ামী লীগ সমর্থক মানেই জয় নিশ্চিত হওয়া। ফলে নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের হতাশাজনক উপস্থিতি দেখা যায়। ‘দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো দল নেই’, ‘ভোট দিয়ে কী লাভ, দিলেও পাস না দিলেও পাস’ কিংবা ‘বিএনপি-জামায়াত কেউ নেই, সবই এখন আওয়ামী লীগ’ এ রকম কথার চাউর ওঠে। বলতে গেলে এভাবে জনগণ নির্বাচন থেকে আস্থা হারিয়ে দূরে সরে। 

চলতি বছর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্যে সরকারবিরোধী দল বিএনপি গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগে ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ থেকে ১০ দফা ঘোষণা করেছে। ১০ দফা মেনে নিতে সরকারকে আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা সংঘর্ষে যেতে চাই না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি, আপনারা সেটা মেনে নিন, ১০ দফা মেনে নিন। ১০ দফা দাবি মেনে অবিলম্বে পদত্যাগ করুন, সংসদ ভেঙে দিন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। আজকে দেখুন, ঢাকা মহানগরে উত্তরা থেকে শুরু করে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে। সমস্ত বাংলাদেশের জেলাগুলোয় মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে। এভাবে সমাবেশের পর সমাবেশ, আরো মানববন্ধন—শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করছি। এ আন্দোলন দিনে দিনে বাড়তে থাকবে, তীব্র থেকে তীব্রতর হবে, বেগবান হবে। এ রকম শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আমরা ভয়াবহ দানবীয় ফ্যাসিস্ট অবৈধ সরকারকে সরে যেতে বাধ্য করব। নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নতুন কমিশনের অধীনে নতুন একটি সরকার, নতুন একটি সমাজ গড়ে তুলব—এই হচ্ছে আমাদের প্রত্যাশা।’ (সূত্র: বণিক বার্তা, ১২ মার্চ, ২০২৩) প্রশ্ন হলো, সাধারণ জনগণের আর কজনইবা জানেন বিএনপির ১০ দফায় কী আছে? আর দফা আদায়ে ঢাকা মহানগরসহ সব জেলায় মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? বিএনপির ১০ দফার অনেকগুলোর সঙ্গে হয়তো জনগণ একমত হতে পারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মানুষ এখন নিশ্চুপ বা নীরব হয়ে গেছে। বিপরীতে সরকার বা আধিপত্যে থাকা দলের মতের প্রকাশ বেড়েছে। 

নোয়েল নিউম্যানের মতে, যখন আধিপত্যবাদীদের মতের প্রকাশ বৃদ্ধি পায়, বিপরীত মতাবলম্বীরা তখন মুখে তালা মেরে বসে থাকেন। নিজেদের সমাজে সংখ্যালঘু ভাবেন। ভাবতে ভাবতে কুণ্ডলী পাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে পড়েন। তত্ত্বটির ভিত্তি বা নীরবতার কারণগুলোয় বলা হয়েছে, ভীতি ও চাপের মধ্যে থেকে নিজের ক্ষতির আশঙ্কায় মানুষ চুপ করে থাকে। এমন নয় যে তারা নিজেদের মত পাল্টে ফেলে। শুধু বিচ্ছিন্নতার ভয় কিংবা হুমকিতে নিজেদের অভিমত, অভিযোগ চেপে রাখে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যম বিশেষ গোষ্ঠীকে খুশি করতে নির্ধারিত এজেন্ডা ক্রমাগত ফলাও করে প্রকাশ করে এবং সাধারণ জনগণের মতামতকে পাত্তা দেয় না। ক্ষমতাসীন দল ও মিডিয়াগুলোর কাছে এখন গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকারের চেয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 

নিউম্যান মনে করেন, মানুষ তার ‘কোয়াসি-স্ট্যাটিসটিক্যাল সেন্সের’ মাধ্যমে যখন বুঝতে পারে তার মতামত গ্রহণযোগ্য হবে না, তখন সে ওই বিষয়ে মতামত দিতে বিরত থাকে। জনসাধারণের প্রবৃত্তি হলো অনুকূল পরিবেশে মতের প্রকাশ ঘটানো। কিছু মতামত তারা চেপে রেখে সময়ের হাতে ছেড়ে দেয় এবং সময় এলে তার বিস্ফোরণ ঘটায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে এই মর্মবাণীর চর্চা হচ্ছে কি? 

রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরই দাবি করে, তারা জনগণের জন্য রাজনীতি করে, জনগণই তাদের শক্তি। এই জনগণ কারা? দলীয় নেতাকর্মী? তারা কোণঠাসা জনগণের কথা কান পেতে শোনে কি? আর জনগণ যদি উপেক্ষিত হয়, রাজনৈতিক দলগুলো থেকে আস্থা হারায় বা উদাসীন হয়ে পড়ে, তাহলে তা বিপজ্জনক হতে পারে। কাজেই রাজনীতিকে অর্থবহ করতে দলগুলোর সদিচ্ছা থাকতে হবে। জনগণের দিকে অন্তর্দৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনগণের অব্যক্ত কথা প্রকাশ পেলে, তা রাষ্ট্রের জন্যই কল্যাণকর। তাদের কোনোভাবেই দাবায়ে রাখা ঠিক হবে না।

পাপলু রহমান: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন