রিগ্যালের শেষ দিনগুলো

নয়াদিল্লির কনট প্লেসে এ সিনেমা হলে একসময় লেগে থাকত ভিড় ছবি: দ্য ওয়্যার

ষাটোর্ধ্ব তিন ব্যক্তি একটি সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে। তারা গাইছিলেন ‘‌জিনা ইয়াহা, মারনা ইয়াহা’। হাতে হাত ধরে তাদের গান গাওয়ার দৃশ্যটি অন্য রকম। পথচারীদের অনেকেই ঘটনাটি তাদের সেলফোনে ভিডিও করেছেন। কিছুক্ষণ আগেই রিগ্যালে দেখানো হয়েছিল রাজ কাপুরের ‘‌মেরা নাম জোকার’। নয়াদিল্লির বিখ্যাত সিনেমা হল রিগ্যালের এটিই ছিল শেষ শো। মেরা নাম জোকার মুক্তি পাওয়ার ৪৭ বছর পর সিনেমাটি আবার দেখানো হলো রিগ্যালে। এর অন্যতম একটি কারণ, এ হলেই মুক্তি পেত রাজ কাপুরের সিনেমাগুলো। তিনি নিজে সেখানে উপস্থিত থেকে প্রিমিয়ারে দর্শকের সঙ্গে বসে সিনেমা দেখতেন। রিগ্যালের শেষ দিনেও দর্শকরা সিনেমা হলটির সামনে দাঁড়িয়ে রাজ কাপুরের কথাই বলছিলেন।

রিগ্যালের শুরুটা ১৯৩২ সালে। শুরুতে এখানে থিয়েটার হতো। এরপর বলিউড ও হলিউডের সব ভালো ভালো সিনেমা দেখানো হতো। ১৯৪০ সালে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড জয়ী গন উইথ দ্য উইন্ড দেখানো হয়েছিল এ সিনেমা হলেই। কনট প্লেসের সিনেমা হলটি ছিল বলিউডের সে সময়ের সেরা সিনেমাগুলো মুক্তি দেয়ার কেন্দ্রস্থল। রাজ কাপুর ও নার্গিস জুটির সিনেমাগুলো এখানে দেখানো হতো। রিগ্যালের শেষ দিনও এর সামনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মানুষ সে কথাই বলছিল। যেমন একজন বলে ওঠেন, ‘‌রাজ কাপুর তো তার সব সিনেমার প্রিমিয়ার রিগ্যালেই করতেন। প্রথম শোয়ের আগে এখানে পূজাও করা হতো।’ তার কথা শেষ না হতেই পাশ থেকে আরেকজন বলে ওঠেন, ‘‌আরে পৃথ্বীরাজ কাপুর তো এখানে থিয়েটার করতেন।’

রিগ্যাল তার সূচনা থেকেই ভরভরন্ত অবস্থায় থাকত। ষাটের দশকে রাজ কাপুরের সিনেমা এলে তার প্রিমিয়ার রিগ্যালে হবে, তা তো জানাই থাকত। দেখা যেত রাজ কাপুর তার গাড়িটি নিয়ে এসে রিগ্যালের সামনে নামতেন। দর্শকরা অপেক্ষা করতেন তার জন্য। এরপর হয়তো আসতেন তার নায়িকা। দুজনে একত্রে ঢুকতেন রিগ্যালে। শুরু হতো শো। রিগ্যাল কেবল রাজ কাপুরের ছিল, এমন না। তবে এ সিনেমা হলে রাজ কাপুরের সিনেমাই বেশি চলত। এ কালের মতো তখন ওটিটি বা মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখার সুযোগ ছিল না। দর্শক সিনেমা হলেই যেত আর তাদের প্রিয় তারকাকে চাক্ষুষ দেখার সুযোগ ছিল সেখানেই। তাই সে সময়ে একেকটি সিনেমা হল একেক জনের জন্য বিশেষ হয়ে উঠেছিল।

হল কালচারে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণের বিষয় ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো। রিগ্যালও বহু সিনেমার ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শোতে দর্শকের উন্মাদনা দেখেছে। কিন্তু এ সিনেমা হল ২০১৭ সালে দেখেছে এবং দেখিয়েছে লাস্ট ডে লাস্ট শো কতটা বিশেষ হয়ে উঠতে পারে। ওই বছরের ৩০ মার্চ বন্ধ হয়ে যায় থিয়েটারটি। তার আগে সেখানে প্রদর্শন হয়েছিল মেরা নাম জোকার ও সঙ্গম। সিনেমা দুটো দেখতে সেদিন জড়ো হয়েছিলেন সিনেমা হল নিয়ে গবেষণা করা স্থপতি, সাংবাদিক, বাবার কাছে রিগ্যালের গল্প শোনা দর্শকসহ আরো অনেক মানুষ। তারা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন লাস্ট ডে লাস্ট শোয়ের টিকিটের জন্য। রিগ্যালের টিকিট কাউন্টার সেদিন আবার ফিরেছিল ষাট-সত্তরের দশকে।

শেষ শোটি ছিল সঙ্গম সিনেমার। সিনেমাটির টিকিট ২০০ ও ১৮০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছিল। শো ছিল হাউজফুল। সিনেমাটি নিজেই একটি ইতিহাস। বৈজয়ন্তীমালা, রাজ কাপুর ও রাজেন্দ্র কুমার অভিনীত সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে। মোগল-এ-আজম-পরবর্তী এটি ছিল সবচেয়ে বড় হিট। ভারতে এত দীর্ঘ সিনেমাও খুব বেশি হয়নি। ৩ ঘন্টা ৫৮ মিনিট রানটাইমের সিনেমাটিতে দুটি বিরতি দিতে হয়েছিল। সে সিনেমা দিয়েই রিগ্যাল তার শেষ দিনে আলো জ্বেলেছিল। 

পুঁজিবাদ ও আধুনিকতার দিনগুলোয় রিগ্যাল তার পুরনো ধারা ধরে রাখতে পারেনি। ২০০০ সাল থেকে বি গ্রেড সিনেমা দিয়ে তারা টিকে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সিনেমা হলটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন এর মালিকরা। তবে শেষটা রাজ কাপুরের সঙ্গে হওয়ায় রিগ্যালের দর্শকদের জন্য বিষয়টি ছিল বিশেষ। কেননা যারাই শেষ শো দেখেছেন, রাজ কাপুরকে স্মরণ করেছেন। বিষয়টি অনেকটা এমনভাবেই উল্লেখ করা হয়, সে পুরনো আলু প্যাটিসের স্বাদ হারিয়ে গেলেও রিগ্যালের কোণে কোণে রাজ কাপুরের সময়ের ছাপ রয়ে গেছে। আর রিগ্যালের শেষ হয়েছিল রাজ কাপুরকে স্মরণ করে।

দ্য ওয়্যার অবলম্বনে মাহমুদুর রহমান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন