পোস্টারে শিল্পিত সোনালি দিন

ওয়াহিদ সুজন

‘লিবারেশন ডকফেস্ট’ প্রদর্শনীর একটি অংশে ‘‌ নোলক’, ‘‌উৎসর্গ’ ও ‘‌নয়নমণি’ সিনেমার পোস্টার ছবি: নূর-ই-আলম

‘ফিরে দেখা: সিনেমার গল্প’ এ দেশের সিনেমা শিল্প ও ব্যবসার বিবিধ গল্প, যা মূলত দৃশ্যজ সমীকরণের সূত্রে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের স্বর্ণযুগ ও তার বিবর্তনেরও গল্প। কিছু সুনির্দিষ্ট ফ্রেমের মধ্য দিয়ে দেখার ও দেখানোর ভাবনা থেকে এ প্রদর্শনীর সূত্রপাত। 

রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বার্ষিক আয়োজন ‘লিবারেশন ডকফেস্ট’-এর একাদশ আসরের বিশেষ প্রদর্শনী নিয়ে ওপরের কথাগুলো বলছিলেন কিউরেটর মোস্তফা জামান। 

‘ফিরে দেখা: সিনেমার গল্প’—এ সীমাবদ্ধতা বা মনোযোগের বিস্তার নিয়ে তার মন্তব্য, এ দেশে সিনেমার সার্বিক ইতিহাস তুলে ধরা এ প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য নয়। তবু খণ্ড খণ্ড কিছু দৃশ্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের মুহূর্তগুলো তুলে ধরে চলচ্চিত্রের ইতিহাসের উর্বর অধ্যায়ের উন্মোচন।

প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে দেশের অন্যতম এ উৎসবের এ প্রদর্শনীর মূল আকর্ষণ তিন দশকের পোস্টার, ফটোসেট, বুকলেট, নথি, চলচ্চিত্রবিষয়ক সাময়িকী, আয়োজকদের বিষয়ভিত্তিক লেখা ও ৩৫ মিমি রিলের নিদর্শন।

বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি অতীত নিয়ে প্রশংসনীয় এ আয়োজনে গুরুত্ব পেয়েছে মুক্তি সংগ্রাম ও যাপনের শিল্পিত প্রকাশ। সেই অর্থে অতীত চিনে বর্তমানে দিশা পাওয়ার একটা চেষ্টা রয়েছে।

লক্ষণীয় যে চলচ্চিত্রকে শিল্পনির্ভর বা বাণিজ্যনির্ভর যে ভাগাভাগি আমরা করি না কেন, প্রদর্শিত পোস্টার সেই ব্যবধান কিছু ক্ষেত্রে অনেকটাই উহ্য রেখেছে। তার বদলে গল্প ও তার শিল্পিত রূপই চোখে পড়ে। এখনকার তুলনায় অপ্রতুল প্রযুক্তি নিয়েও কী অসাধারণ সব কাজ করেছেন। একেকটি পোস্টার যেন আলাদা আলাদা দর্শন ও গল্প বলার আকুলতা। প্রদর্শনীর সুবাদে অনেকগুলো পোস্টার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর তা মনে হওয়া স্বাভাবিক। 

হাল আমলের কোনো পোস্টার প্রদর্শনীতে না থাকলেও স্বভাবতই তুলনা চলে আসে। বাংলাদেশে ঘরানা অনুযায়ী পোস্টার ডিজাইন এখনো নির্দিষ্ট বর্গে আটকে আছে। অনেক ক্ষেত্রে সহজ ও সাবলীলতা থেকে বেশ দূরে। যতটা না দর্শন বা বিষয়নির্ভর, তার চেয়ে টেকনিকের গরিমা বেশি। 

পোস্টার শুধু প্রচারণা উপকরণই নয়, সিনেমার মূল ভাবনাকে তুলে ধরার কাজ করে। ঠিক যেন চিত্রিত মেনিফেস্টো, যার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ বুকলেট। আজকাল শিল্প প্রদর্শনীতে যেমন ক্যাটালগ আমরা দেখি, সিনেমার ক্ষেত্রে বুকলেট তেমনই। যদিও উল্টিয়ে দেখার সুযোগ ছিল না। 

প্রদর্শনীতে পোস্টার স্থান পেয়েছে এমন কয়েকটি সিনেমা ওরা ১১ জন, ধীরে বহে মেঘনা, সূর্যদীঘল বাড়ি, দহন, ভাত দে, বসুন্ধরা, আবার তোরা মানুষ হ, ডুমুরের ফুল, সারেং বউ, রংবাজ, লালন ফকির, ঘুড্ডি, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, সূর্য সংগ্রাম, লাঠিয়াল, পালঙ্ক, সুন্দরী, উৎসব, নোলক, পালঙ্ক, গোলাপী এখন ট্রেনে, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, আলোর মিছিল, মেঘের অনেক রং, বিন্দু থেকে বৃত্ত, জয় বাংলা, রূপবান, মুখ ও মুখোশ, নয়নমণি, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, যে নদী মরু পথে, সুতরাং ও সাত ভাই চম্পা। 

শুরুর আলোচনায় ফিরি, চলচ্চিত্র একের মধ্যে অনেক মাধ্যমের সমন্বয়। অনুভূতিজ্ঞাপক যেকোনো কিছুই এর সঙ্গে যুক্ত। বাজার অর্থনীতি ও ঘটমান বাস্তবতার সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকে। এক প্রকার ছদ্ম-বাস্তবতা আমাদের বাস্তব যাপনের সমান্তরালে প্রদর্শিত। সেই অর্থে মানুষ তার সম্ভাবনা ও কল্পনা সমেত চলচ্চিত্রে পাঠ্য।

কোনো একটি সময়ের চলচ্চিত্র আমাদের দেখা না হয়ে উঠলেও পোস্টার দিয়ে অনেক কিছু বিবেচনা করা যায়। একই সঙ্গে কোন স্থানে তা প্রদর্শিত হচ্ছে, সেখানকার নির্বাচন নিয়ে সচেতন থাকার দরকার পড়ে। ডকফেস্টও তার নিজেদের পরিসর স্পষ্ট রেখেছে। সেখান থেকে খণ্ডিত ইতিহাসের পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গিও ফুটে ওঠে, যা ‘দ্য পিকচার’ শিরোনামে শিশির ভট্টাচার্য্যের ক্যারিকেচার থেকে বোঝা যাবে। তিনি সিনেমার ক্যানভাসভিত্তিক ‘অবক্ষয়ের’ চিত্র নিয়ে এসেছেন। 

বাস্তবতার সঙ্গে শিল্পভাষার দূরত্ব চিহ্নিত করলেও চলচ্চিত্র কখনো সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিসর থেকে আলাদা নয়। সে অর্থে ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে বর্তমান চলচ্চিত্রের অবস্থা বোঝা যাবে না। সেখান থেকে মনে হতে পারে বিচ্ছিন্ন ‘অবক্ষয়’ একটা ভুক্তভোগী অবস্থা চিত্রিত করে, কিন্তু তার নির্যাসকে আমরা সমাজ থেকে আলাদা করে দেখছি, যা শিল্পের অতীত গরিমা আকারে দেখা যেতে পারে। যাকে সামগ্রিকভাবে পাঠ না করলে আদতে নতুন কিছু হয়ে ওঠে না।

সিনেমা যে সমাজবিচ্ছিন্ন নয়, তার ব্যাপক উদাহরণ আছে প্রদর্শনীতে। আছে ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর মতো ঐতিহাসিক দলিল নির্মাণের কথা। তা শুধু চিত্র ও লেখায় সীমাবদ্ধ নয়। এখানকার খুবই কম প্রদর্শনীই স্থিরতায় সীমাবদ্ধ থাকে, সেই দিকটি ‘ফিরে দেখা: সিনেমার গল্প’-তেও বিদ্যমান। রয়েছে ‘স্টপ জেনোসাইড’ পর্দায় দেখার সুযোগ। এ বহুমাত্রিক দেখাদেখির মাঝে সিনেমা যে কতটা জীবনের সঙ্গে যুক্ত তা আমরা বারবার বুঝতে পারি। হয়তো ডকফেস্টের পরবর্তী সংস্করণে এ দেখাদেখির পরিসর বিস্তৃত হবে। সিনেমা ও পোস্টারের বিবর্তনের সুস্পষ্ট দাগগুলো তারা তুলে ধরবেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন