তরুণদের হার্ট অ্যাটাক

সুস্থ জীবনযাপনে তরুণদের হৃদরোগের ঝুঁকি কমে

ছবি: কার্ডিও মেটাবলিক ইনস্টিটিউট

আধুনিক যুগে কলেরা, ডায়রিয়ার মতো রোগের মহামারী খুব কমই দেখা যায়। বরং বেড়েছে দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠা, ধূমপান, অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার (ফাস্টফুড), বিষণ্নতা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ফলে দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া (রক্তে অস্বাভাবিক লিপিড স্তরের উপস্থিতি), ফ্যাটি লিভারের মতো নানা সমস্যা। এতে হৃদরোগে আক্রান্তের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, অল্পবয়স্ক থেকে তরুণদেরও হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হচ্ছে। দেশের বড় বড় স্বনামধন্য হৃদরোগ বিশেষায়িত হাসপাতালে (ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট) প্রাইমারি পিসিআই করেও তরুণদের বাঁচানো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। পারকিউটেনিয়াস করোনারি ইন্টারভেনশন বা পিসিআই হলো এক ধরনের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের ব্লকের চিকিৎসা করে সেখানে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক করা হয়। 

রোগীর কাছে অথবা তার নিকট আত্মীয়দের কাছে খোঁজখবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, ওইসব রোগী কোনো না কোনোভাবে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেছিলেন। বর্তমানে তরুণদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের যুবসমাজকে এ বিষয়ে অবহিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ফ্রামিংহাম হার্ট স্টাডির গবেষণায় দেখা গেছে, হৃদরোগে আক্রান্তদের মধ্যে প্রতি হাজারে প্রায় ১৩ জন পুরুষ, যাদের বয়স ৩০ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। আবার হৃদরোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৮-৯ গুণ বেশি ৫৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। 

গবেষণায় আরো দেখা যায়, প্রতি পাঁচজন তরুণ ব্যক্তির মধ্যে একজন উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে অনেকেই নিজের রোগ সম্পর্কে অবগত নন, বিশেষ করে শহর এলাকা ও মফস্বলে প্রতি চারজনে একজন আক্রান্ত। উচ্চরক্তচাপ তরুণদের হৃদরোগের অন্যতম কারণ। যদিও এর নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ নেই। তবে অনিয়মিত হার্টবিট, চোখে ঝাপসা দেখা, ঘাড়ে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ সাধারণত পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ইন্টারভেনশন সোসাইটি অব কাির্ডওলজি কর্তৃক আয়োজিত সাম্প্রতিক এক সম্মেলনে দেশ ও বিদেশের স্বনামধন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা তরুণ ব্যক্তিদের হৃদরোগ বৃদ্ধির প্রতিকার ও প্রতিরোধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ রোগের ঝুঁকি নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সুস্থ জীবনযাপনের মাধ্যমে কমানো সম্ভব।

হৃদরোগের ঝুঁকির কারণ 

ধূমপান হার্টের পেশি ও ধমনির মারাত্মক ক্ষতি করে। ধূমপান ইস্কিমিয়াকে (যখন রক্তপ্রবাহ বা অক্সিজেনের অভাব কমে যায়) প্রভাবিত করে। এতে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। ধূমপান সাধারণত দুভাবে হার্টের ক্ষতি করে। 

১) ধূমপানের ফলে শরীরের মধ্যে যে নিকোটিন প্রবেশ করে, তা হঠাৎ আর্টারি বা ধমনির রক্ত চলাচল পথ আংশিক রুদ্ধ করে। ফলে হার্টের পেশির রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয়ে ব্যক্তি হার্ট অ্যাটাক করে।

২) ধূমপানের ফলে হার্টের কোলেস্টেরলের মাত্রা বিপজ্জনক হারে বেড়ে যায়। রক্তের অন্যতম উপাদান এইচডিএল, যা আমাদের শরীরের জন্য উপকারী, সেটা কমিয়ে দেয়। ফলে ধমনি ও হার্টের মারাত্মক ক্ষতি হয়। হৃদরোগের জন্য আরো কিছু কারণকে দায়ী করা হয়, যেমন: স্থূলতা, পরিবারে হৃদরোগে আক্রান্তের ইতিহাস, রক্তে অতিরিক্ত মাত্রায় চর্বি থাকলে, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, অতিরিক্ত ওজন, মদ্যপান, ড্রাগ আসক্ত বা নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি গ্রহণ, অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচার। 

হৃদরোগের লক্ষণ

১.     তীব্র বুকে ব্যথা: বামদিকে বা ডান দিকে বা পুরো বুকে—যা কখনো আগে অনুভব হয়নি। সাধারণত বাম হাতে বা ডান হাতে বা উভয় হাতে অথবা চোয়ালে বা পেছনে ছড়াতে পারে।

২. ব্যথার সঙ্গে অতিরিক্ত ঘাম দেয়া।

৩. ব্যথার সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হওয়া ও বিছানায় সোজা হয়ে ঘুমাতে কষ্ট হওয়া।

৪. অল্প হাঁটলে হাঁপিয়ে যাওয়া এবং ব্যথা অনুভব হওয়া।

৫. অতিরিক্ত দুর্বলতা ও কর্মদক্ষতা হ্রাস পাওয়া।

রোগ নির্ণয়

উপরোক্ত লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত নিকটস্থ রেজিস্টার্ড ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনার জীবন আপনার কাছে ও আপনার পরিবারের কাছে অনেক মূল্যবান। আপনি যত দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাবেন, তত দ্রুত চিকিৎসা হবে এবং আপনার কার্ডিয়াক টিস্যু তত কম নষ্ট হবে।

চিকিৎসাসেবা

বাংলাদেশে সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা বিদ্যমান সব বিশেষায়িত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার প্রতিটি উপজেলা লেভেলে প্রাইমারি চিকিৎসা ও রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ব্যবস্থা করে দিয়েছে। শুধু সচেতনতাই পারে আমাদের জীবন বাঁচাতে। 

প্রতিরোধ

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘প্রতিরোধ চিকিৎসার চেয়ে উত্তম’। বিশেষ করে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করে তুলতে হবে। 

হৃদরোগ থেকে বেঁচে থাকার উপায়:

১. নিয়মিত রক্তচাপ নির্ণয় করা। যাদের উচ্চরক্তচাপ আছে, তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এরই মধ্যে উপজেলা হাসপাতালে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডি) কর্নার চালু হয়েছে। সেখানে বিনামূল্যে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীদের ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

২. ধূমপান, মদ্যপান, নেশাজাতীয় দ্রব্য পরিহার করতে হবে।

৩. অতিরিক্ত তেল-চর্বি জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে।

৪. খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া পরিহার করতে হবে। 

৫. নিয়মিত অ্যারোবিক ব্যায়াম করতে হবে।

৬. দুশ্চিন্তা পরিহার করতে হবে।

৭. অতিরিক্ত সময় বাসায় বসে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি থেকে বিরত থাকতে হবে।

৮. ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, আধুনিক বিশ্বে যারা হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে তরুণদের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক। বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্রের অক্লান্ত পরিশ্রম সত্ত্বেও রোগীর ঝুঁকি কমানো অনেক ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে না। কেননা রোগের চিকিৎসার আগেই প্রতিরোধের বিষয়ে আমাদের মনোযোগ ততটা নেই। 

লেখক: ডা. আয়েশা সিদ্দিকা, এফসিপিএস

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন