সাক্ষাৎকার

ঢাকার বাইরে হৃদরোগের চিকিৎসার সংকট মূলত সুবিধার ঘাটতির কারণে

অধ্যাপক ডা. এ কে এম মনজুরুল আলম। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইসিভিডি) কার্ডিয়াক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান। দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগের চিকিৎসা, অধ্যাপনা ও গবেষণা করছেন এ চিকিৎসক। তরুণদের হার্ট অ্যাটাকের কারণ, প্রতিকার, চিকিৎসা সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা কার্ডিয়াক মেটাবোলিক ইনস্টিটিউটের মতে, দুই দশকে বিশ্বব্যাপী হার্ট অ্যাটাকের হার ২ শতাংশ বেড়েছে। এ ২ শতাংশের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ। অর্থাৎ ২০-৩০ বছরের মধ্যে তাদের বয়স। এর কারণ কী?

হার্ট অ্যাটাক যেকোনো বয়সে হতে পারে। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, তরুণ প্রজন্ম হার্ট অ্যাটাকে বেশি আক্রান্ত হয়। যদি পরিবারের কারো হৃদরোগ থেকে থাকে, তাহলে তরুণদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। পাশাপাশি ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, চর্বিযুক্ত খাবার, জাংক ফুড ইত্যাদি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। পাশাপাশি টিনএজ পার করে অ্যাডোলিসেন্সে যাওয়ার সময় অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে যায়। মাদকাসক্তি সরাসরি হৃদরোগের সঙ্গে জড়িত না হলেও অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। কয়েক দশকে দেশের তরুণদের মধ্যে এসব ঝুঁকি কেমন দেখতে পাচ্ছেন?

গত সপ্তাহেও আমরা হৃদরোগের একটি অস্ত্রোপচার করেছি। রোগীর বয়স মাত্র ২৮ বছর। তার হার্টে শতভাগ ব্লক আছে দুটো। ৯০ শতাংশ আছে একটি। তার ক্ষেত্রে হৃদরোগের কোনো স্পষ্ট কারণ আমরা খুঁজে পাইনি। তবে তার ফ্যামিলি হিস্ট্রি বা পরিবারে হৃদরোগ আছে। তার বাবারও বাইপাস হয়েছে আমার হাতে। সুতরাং এখানে প্রথম কারণ হলো ফ্যামিলি হিস্ট্রি। সে আবার স্থূলকায়। এটিকে বলা হয় ডিসলিপিডেমিয়া, অনিয়ন্ত্রিত কোলেস্টেরল। জাংক ফুড খাওয়ার কারণে এ সমস্যা হয়। অধিক পরিমাণে কোমল পানীয় পান হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বর্তমানে তরুণরা বাসায় খেতে পছন্দ করে না। তারা বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে খাবার আনায়। এমন খাদ্যাভ্যাস কার্ডিয়াক অ্যাটাকের ক্ষেত্রে বহুলাংশে দায়ী। অনিয়ন্ত্রিত ট্রাইগ্লিসেরাইডের কারণেও করোনারি আর্টারিতে কোলেস্টেরল জমা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) মতে, তরুণদের মধ্যে যাদের স্থূলতা ও উচ্চরক্তচাপ রয়েছে, তাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি দুই-চার গুণ বেশি। আসলে হৃদরোগে আক্রান্তদের মধ্যে এমন জটিলতা কেমন?

তারা বিশ্বব্যাপী সমীক্ষার ভিত্তিতে কথাগুলো বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে জাংক ফুড, ডিসলিপিডেমিয়া ও স্থূলতা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের দেশেও এখন এগুলো বাড়ছে। এখন শিশুরা খেলাধুলার সুযোগ পায় না। তারা সারাদিন পড়ার টেবিলে বসে থাকতে বাধ্য হয়। কোনো কায়িক শ্রম করে না। কম্পিউটার গেমসই তাদের একমাত্র আনন্দের উৎস। বর্তমানে অধিকাংশ বাবা-মা চাকরিজীবী। ফলে শিশু-কিশোররা একাকিত্বে থাকে। তাদের খাদ্যাভ্যাসও যথাযথ নয়। কোনো কায়িক শ্রম নেই। কোনো ব্যায়াম নেই। ফ্ল্যাটের আবদ্ধ জীবনে সে সুযোগও নেই। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ সরকার প্রতি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। তা বাস্তবায়ন হলে আমাদের দেশে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে আসবে। স্থূলতাও কমবে।

ডায়াবেটিসসহ দীর্ঘমেয়াদি কোন কোন রোগ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে?

মূলত কারণ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, ডিসলিপিডেমিয়া ও উচ্চরক্তচাপ। এগুলো প্রাথমিক। জেনেটিক ফ্যাক্টর, ফ্যামিলি হিস্ট্রি, মানসিক চাপ ইত্যাদিও বড় কারণ। টার্গেটভিত্তিক কাজগুলো হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এতে হরমোনাল সিক্রেশন বেড়ে যায়। ফলে শরীরে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যায়।

দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসার সংকট। বিশেষায়িত সব হাসপাতালেও পরিপূর্ণ চিকিৎসাসেবা নেই। মূলত আমাদের সীমাবদ্ধতা কী?

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যথেষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ তৈরি হওয়া সত্ত্বেও ঢাকার বাইরে মাধ্যমিক লেভেলে তাদের আমরা পাঠাতে পারছি না। অবকাঠামোগত দুর্বলতা এর প্রধান কারণ। একটা কার্ডিয়াক সেন্টার বা সিসিইউ চালাতে হলে সেখানে একজন কার্ডিয়াক বিশেষজ্ঞ, কার্ডিয়াক সার্জন, ভালো এনজিওগ্রাম ইত্যাদি লাগবে। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট নেই। প্রশিক্ষিত নার্সও নেই। অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্সও নষ্ট বছরের পর বছর। হৃদরোগের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পাশাপাশি বিশেষ অনেক উপকরণ প্রয়োজন। সব হাসপাতালে সেগুলো পর্যাপ্ত থাকে না।

আপনি দীর্ঘদিন হৃদরোগের চিকিৎসায় নিয়েজিত। বিশেষায়িত এ চিকিৎসাসেবা ও গবেষণায় আমাদের সংকটের বিষয়ে জানতে চাই।

আসলে অধিকাংশ ডাক্তার গবেষণার সঙ্গেই জড়িত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছেন গবেষণায় যেন আমরা নিজেদের আরো বেশি নিয়োজিত করি। আসলে এমবিবিএস পাস করার পরে একজন ছাত্র যখন পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করে, এমএস বা এফসিপিএস ডিগ্রি করে তাকে পাঁচ-সাত বছর গবেষণায় থাকতে হয়। তাকে ক্লিনিক্যাল ক্লাস করতে হয়, থিসিস করতে হয়। প্রত্যেক ছাত্রের পাস করার প্রথম শর্ত তাকে একটা থিসিস জমা দিতে হবে। ওই থিসিসের জন্য তাকে অন্তত দুই বছর গবেষণা করতে হয়। তার মানে গবেষণা কিন্তু পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে চলেই আসে। হয়তো অনেক ক্ষেত্রে এটি আমরা জানতে পারি না। অধ্যাপক হিসেবে আমি ২৫ বছর এ কাজে নিয়োজিত। আমাদের প্রত্যেক অধ্যাপকেরই জার্নাল আছে। যে ছাত্রদের আমরা ডাক্তার হিসেবে তৈরি করছি, তাদের প্রত্যেকেরও একটি করে জার্নাল হয়, গবেষণা হয়। গবেষণা ছাড়া তার পক্ষে এমএস (মাস্টার অব সার্জারি) পাস করা সম্ভব না।

হৃদরোগের চিকিৎসা কি খুবই ব্যয়বহুল? আপনার মতামত বলুন।

হৃদরোগের চিকিৎসা সবক্ষেত্রে ব্যয়বহুল নয়। হৃদরোগে আক্রান্ত কোনো কোনো রোগীকে আমরা কেবল কনজারভেটিভ ট্রিটমেন্ট দিয়ে বাড়ি পাঠাতে পারি। কনজারভেটিভ ট্রিটমেন্টের পরও রোগীর ব্যথা কিংবা কোনো ধরনের অস্বস্তি থাকলে তখন চিকিৎসা পর্যায়ক্রমে ব্যয়বহুল হয়। তখন এনজিওগ্রাম, বাইপাস, রিং ইত্যাদি লাগে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট একটি সরকারি হাসপাতাল। এখানে প্রায় বিনামূল্যেই হার্টের অপারেশন হচ্ছে। বাইপাস সার্জারি হচ্ছে। প্রাইভেট সেক্টরের তুলনায় এখানে ধরতে গেলে বিনামূল্যেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এখানে আমরা বিনামূল্যে বাইপাস সার্জারি করি। সরকার বিনামূল্যে ভাল্ভ দিচ্ছে। আমরা প্রতি বছর শত শত ভাল্ভ লাগাচ্ছি বিনামূল্যে। সমস্যাটা হলো যে ভাল্ভটা আমি বিনামূল্যে গরিব রোগীটাকে লাগিয়ে দিচ্ছি সে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সেটার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না। কারণ তার পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। তারা নিয়মিত ওষুধ খায় না। ডাক্তারের কাছে ফলোআপে আসে না। অনিয়মিত ফলোআপের কারণে অনেকের ব্রেন স্ট্রোক বা প্যারালাইসিস পর্যন্ত হয়ে যায়। হয়তো লাখ টাকার অপারেশন সরকারিভাবে বিনামূল্যে করে গেল, তারপর এক বছরেও এ রোগী আর কোনো ফলোআপে আসে না। দেড় বছর পর যখন সে আসে, ব্রেন স্ট্রোক বা একপাশ প্যারালাইজড হয়ে আসে। কারণ আমরা যে মেকানিক্যাল ভাল্ভ লাগাই, তার ভেতর দিয়ে রক্তপ্রবাহ অব্যাহত রাখার জন্য তাকে একটা ট্যাবলেট খেয়ে রক্তের ঘনত্ব বজায় রাখতে হয়। মেকানিক্যাল ভাল্ভের ক্ষেত্রে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই ওষুধটা নিয়মিত খায় না। টেস্টও রেগুলার করে না। যে কারণে পেশেন্ট ভাল্ভ লাগানোর পরেও ভোগান্তিতে পড়ে। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। একজন ডাক্তার, একজন অধ্যাপক সমাজ পরিবর্তন করতে পারেন না, যদি সমাজের প্রত্যেকে সচেতন না হন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন