ক্যাম্পাস ক্যাফেটেরিয়া

শিরোনামহীনের সেই ‘পড়ন্ত বিকেল, ক্যাফেটেরিয়া’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া । ছবি : মাসফিকুর সোহান

‘‘পড়ন্ত বিকেল, ক্যাফেটেরিয়া

উঁকি দিয়ে দেখি

এক কাপ চা, গরম তৃষ্ণায়

অজস্র এলোমেলো স্বপ্নের ভিড়ে

তোমার শীতল চোখ

ভিজিয়ে যায় আমায়।’’  (ক্যাফেটেরিয়া, শিরোনামহীন)

জনপ্রিয় বাংলা রক ব্যান্ড শিরোনামহীনের দ্বিতীয় স্টুডিও অ্যালবাম ইচ্ছে ঘুড়ির নস্টালজিক ‘ক্যাফেটেরিয়া’ গানটি হালের তরুণ-তরুণীর মুখে মুখে। যেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণ প্রজন্মের জন্যই গানটি লেখা। শিরোনামহীনের"বিখ্যাত ক্যাফেটেরিয়া গানের গীতিকার জিয়াউর রহমান জিয়া ও গানের কণ্ঠশিল্পী তানজির চৌধুরী তুহিন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের ছাত্র ছিলেন। আর ক্যাফেটেরিয়া গানটিও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া নিয়ে লেখা। তাই তাদের এ গানটি বুয়েটের শিক্ষার্থ‌ীদের মনে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ক্যাফেটেরিয়া গান আর সত্যিকারের ক্যাফেটেরিয়া ঘিরে আবেগ আর অনুভূতির যেন শেষ নেই। গানের গীতিকার জিয়াউর রহমান জিয়া বলেন, ‘আমি বুয়েটে পড়তাম। সুরটাও করেছিলাম পড়ন্ত বিকেলে ক্যাফেটেরিয়ার মুহূর্ত যেমন হয়, সেটা মাথায় রেখে। এজন্যই এমন ধীর লয়ের গান, যেনো সময়টা থমকে থাকে। আমরা ক্যাফেটেরিয়া ছেড়ে গেলেও জীবন একই রকম থাকে। ক্যাফে আমাদের ছাড়ে না।’

যেকোনো ক্যাম্পাসের প্রাণকেন্দ্র বলা চলে ক্যাফেটেরিয়াকে। বিশেষ করে ঢাকা শহরে যেখানে টংয়ের দেখা মেলাভার। তাই চার দেয়ালে ঘেরা ক্যাফেতে আড্ডা, গান, চায়ের ধোঁয়াতে মিশে থাকে আমাদের জীবনের গল্পগুলো। বুয়েটের গেট দিয়ে ঢুকে হাতের বাঁদিকে গেলেই আমাদের ক্যাফেটেরিয়া। অডিটোরিয়ামের দোতলা ভবনের নিচতলায় এর অবস্থান। সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার, পরোটা-গ্রিল, চা, কফি, জুসসহ প্রায় সব খাবারই সুলভ মূল্যে মেলে এখা‌নে। ক্যাফেতে ঢুকলেই দেখা যায় কোনো এক বড় লাল টেবিল ঘিরে বসে বন্ধুবান্ধব মিলে মেতেছে আড্ডায়, প্রেমিক-প্রেমিকা হয়তো আড়ালে বসে সবেমাত্র চায়ের কাপে চুমুক বসাচ্ছে, অমনি পেছন থেকে বন্ধুরা ব্যস্ত তাকে বিরক্ত করতে, কিংবা ক্লাসের সবচেয়ে সিরিয়াস ইন্ট্রোভার্ট ছেলেটি একাকি বসে বার্গারে কামড় বসিয়ে দেখে নিচ্ছে পরের দিনের সিটির পড়া। টেবিল বদলালেই বদলে যায় গল্প।

ক্যাফের সামনে রয়েছে বুয়েটের সিগনেচার র‍্যাগ ওয়াল। শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীরা (র‍্যাগ ব্যাচ) তাদের ক্যাম্পাস জীবনের শেষ সময়টুকু এ ক্যাফেকে ঘিরেই অনেক স্মৃতির জন্ম দিয়ে যায়। বছরজুড়ে তিনবার তিনটি ভিন্ন থিমে র‍্যাগ ওয়াল সাজে নানা গল্পে। রঙতুলির শৈল্পিক ছোঁয়ায় ক্যাফের দেয়াল হয়ে ওঠে গল্পের উঠান। শুরুতে এক বর্ণের রঙে ব্যাচের লোগো লাগিয়ে রাঙানো হয়, এক টার্ম পর পুরো ক্যাম্পাস লাইফের থিমে বর্ণিল থাকে র‍্যাগ ওয়াল। বিদায়ের ঘণ্টা বাজার সময় রঙে রঙিন র‍্যাগ ওয়াল আবার অপেক্ষা করে নতুন ব্যাচের আঁকিবুকির জন্য। 

র‍্যাগ ওয়ালের পাশেই রয়েছে র‍্যাগ কর্নার। যেখানে সবসময়ই গান বাজতে শোনা যায়। র‍্যাগ কর্নার একান্তই র‍্যাগ ব্যাচের জন্য। আমরা জুনিয়র ব্যাচেরা তাকিয়ে দেখি কবে আমাদের পালা আসবে। কবে র‍্যাগ কর্নারে বসে কার্ড খেলব, পছন্দের গান বাজাব, ক্যাফের ছাদে বসে পা দুলিয়ে দুশ্চিন্তাগুলোকে হাওয়ায় মিলিয়ে দেব। ক্যাফের পাশে রয়েছে ডেল ক্যাফে। সেখানে বিভিন্ন প্রদর্শনী কিংবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ক্যাফের সামনের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ আমাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বুয়েটে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রোগ্রাম চলতেই থাকে, সবাই নাক-কান বুজে শুধু পড়াশোনাই করে—এমন ভাবনার কোনো অবকাশ নেই। রীতিমতো ১২ মাসে ১৩ পার্বণের মতো উৎসবমুখর থাকে বুয়েট। ক্যাফেটেরিয়া প্রাঙ্গনেই হয় সব অনুষ্ঠান। আর ক্যাফেটেরিয়ার পাশে রয়েছে একটি ছোট্ট স্মৃতিসৌধ যেটি মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের স্মরণে নির্মিত। আরো রয়েছে হাফ ওয়াল, যেখানে উদাস হয়ে বসে ক্যাফেতে মানুষের আনাগোনা দেখে নিজেকে দলছুট ভেবে একাকি সময় কাটিয়ে দেয়া যায়। আবারো ফিরে যাই শিরোনামহীনের সেই নস্টালজিক গানে- যেখানে তোমার চোখ খুনী/ আমি খুন হই প্রতিদিন/ পড়ন্ত বিকেল, ক্যাফেটেরিয়া। 

আশিক শাহরিয়ার, শিক্ষার্থী, ইইই বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন