ক্যাম্পাস ক্যাফেটেরিয়া

বিশ টাকায় এক বেলার আহার

আনিসুর রহমান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ক্যাফেটেরিয়া ছবি : নিজস্ব আলোকচিত্রী

একটু চা পাতা, সামান্য চিনি, এক টুকরো লেবু দিয়ে বানানো এক কাপ চায়ের মূল্য কত? ৫ কিংবা ১০ টাকা। কিন্তু ১ টাকায়ও মিলবে এই চা, তাও আবার রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে! হ্যাঁ, শুনতে অবান্তর মনে হলেও এটাই সত্যি। এই এক কাপ চায়ে শুরু হওয়া আলাপের বিষয়বস্তু সমসাময়িক রাজনীতি-অর্থনীতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে আরো কত কী! কথার ফাঁকে ফাঁকে চলে চায়ের কাপে চুমুক। এরই মধ্যে হয়তো অনেকে আন্দাজ করতে পেরেছেন ক্যাফেটেরিয়ার নাম। হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ক্যাফেটেরিয়ার কথা বলছি। সুলভমূল্যে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত খাবার সরবরাহ করতে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এ ক্যাফেটেরিয়া চালু করা হয় বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুনসুর আলী। জানালেন টিএসসি প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নে প্রথম পরিচালক এজেড খান ক্যাফেটেরিয়াটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময় ক্যাফেটেরিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র আনানো হয়েছিল আমেরিকা থেকে। যদিও এখন সেগুলোর কিছু নেই।

প্রতিষ্ঠালগ্নের অনেক কিছু না থাকলেও সগৌরবে টিকে রয়েছে পুরানো সেই ক্যা‌ফটেরিয়া। বর্তমানে শুধু ১ টাকার চা নয়, এখানে প্রতি পিস শিঙ্গাড়া, চপ এবং সমুচা বিক্রি হয় তিন টাকা করে। আরো পাওয়া যায় ৭ টাকায় প্যাটিস, ৬ টাকায় কেক। দুপুর ও রাতের খাবারের মূল্য মাত্র ২০ টাকা করে। খাবারের মেন্যুতে সোম ও বুধবার খিচুড়ি আর বৃহস্পতিবার পোলাও, বাকি দুদিন ভাতের সঙ্গে থাকে এক টুকরো মুরগির মাংস। ১০ থেকে ১৫ টাকায় নাশতা আর ২০ টাকায় মধ্যাহ্নভোজ কিংবা নৈশভোজ সারা যায় এ ক্যাফেটেরিয়ায়। খাবারের উপাদান বাদে স্থাপনা, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ খরচ ও কর্মচারীদের বেতন বিশ্ববিদ্যালয় বহন করায় স্বল্পমূল্যে খাবার পরিবেশন সম্ভব হচ্ছে। তবে এত সস্তায় খাবার বিক্রি করেও মুনাফা হয় বলে জানায় ক্যাফেটেরিয়া কর্তৃপক্ষ। 

কথা হলো বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে আসা মোহাম্মদ ফরহাত চৌধুরী সঙ্গে। কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘ঢাকায় এত কম টাকায় খাবার পাওয়া যায় তা না খেয়ে অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না। দামের তুলনায় খাবারের মান যথেষ্ট ভালো। ফলে প্রচুর শিক্ষার্থী ও বহিরাগত খেতে আসেন এখানে।’ ক্যাফেটেরিয়ার বেয়ারা-বাবুর্চিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল আগে চা পাতা, চিনি, লেবু ছাড়াও চায়ের স্বাদ বাড়াতে আরো অনেক কিছু মেশানো হতো। দুধ চায়ের পরিবর্তে চালু হয় লিকার চা। তাতে আদা, দারুচিনিসহ অনেক উপাদান থাকত কিন্তু এখন আর তা সম্ভব হয় না। আগে দুপুর ও রাতে গরু-খাসির মাংস দেয়া হতো। পৌনে ২ টাকায় গরু, আড়াই টাকায় খাসির মাংস পাওয়া যেত। কিন্তু এখন মুরগির বাইরে কিছুই রান্না করা হয় না। নাশতার সঙ্গে পাওয়া যেত সস, এখন সেটাও মেলে না। খাবার বিক্রি করে প্রতিদিন যে পরিমাণ আয় হয় সেই টাকাতেই পরের দিন বাজার করা হয় বলে জানান তারা। 

ক্যাফেটেরিয়া দুই পাশের বারান্দাকে ঘিরে চলে সংস্কৃতি চর্চা। কেউ বন্ধুদের সঙ্গে গলা ছেড়ে গান গাইছেন কেউবা কবিতা-আবৃত্তি করছেন। কেউবা আঁকছেন ছবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের মাস্টার্সে শিক্ষার্থী দ্যুতি অরণ্য চৌধুরী বলেন, ‘টিএসসি ক্যাফিটেরিয়ার এ বারান্দা সংস্কৃতি চর্চার উন্মুক্ত মঞ্চ। সবাই এখানে আসেন, শিল্প চর্চা করেন।’ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও জাতীয় সংকটকালেও এ ক্যাফেটেরিয়ার অবদান কম নয় বলে জানান সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস। তিনি বলেন, টিএসসি ক্যাফেটেরিয়া ও এর বারান্দাই মূলত সংস্কৃতি চর্চার মূল কেন্দ্র ছিল। যখনই কোনো জাতীয় সংকট দেখা দিত, তখনই গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সংস্কৃতিমনা শিক্ষার্থীরা ছাত্রনেতাদের সঙ্গে এ ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দায় বসেই রাজনীতি চর্চা করত, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নীতি নির্ধারণ করতেন। ১৯৮৮ সালের বন্যায় টিএসসি ছিল সবচেয়ে বড় ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণ কেন্দ্র। দিনের বেলা ক্যাফেটেরিয়ায় হাজার হাজার রুটি তৈরি হতো, রাতের বেলা খিচুড়ি রান্না হতো। সেগুলো ট্রলারে করে ঢাকার পাশের বন্যাকবলিত এলাকায় বিতরণ করা হতো। এ সময় খাবার স্যালাইন তৈরি করেও মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এ ক্যাফেটেরিয়া। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন