শাঁকচুন্নিরা যে কারণে মাছ চুরি করে

শাঁকচুন্নি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

শাঁকচুন্নিরা কেন মাছ চুরি করে- তা বলার আগের একটি বাজারের গল্প শুনে নিন। এতে প্রসঙ্গান্তর ঘটলেও মজার কিন্তু কমতি নেই!

আর দশটা বাজারের মতো জমজমাট, বেচাকেনা হচ্ছে সমানে। তবে ক্রেতা-বিক্রেতা ও পণ্যসম্ভার দেখলে যেকোনো মানুষের চোখ কপালে উঠবে। ভয়ে মূর্ছাও যেতে পারেন।

এটি হলো পিশাচ, ভূত ও শয়তানের বাজার। সেখানে বিকিকিনি হয় মানুষের মাংস দিয়ে বানানো পিঠা! এতটুকু শুনেই গা শিরশির করছে, অবাক হচ্ছেন তো?

তাহলে শুনুন, সে বাজারের মাঝখান দিয়ে যত এগোবেন, আপনার জন্য অপেক্ষা করছে বিস্ময়ের পর বিস্ময়! পাবেন রক্ত দিয়ে বানানো মদ। কিছুটা এগিয়েই দেখলেন সুদৃশ্য পাত্রে রাখা সুস্বাদু ঘি। দেখেই লোভে চকচক করে উঠল চোখ। ভাবলেন, কিনেই নিই এক পাত্র। তখনই জানতে পারলেন, সে ঘি বানানো হয়েছে আপনার স্বজাতির মগজ দিয়ে!

পিছু ফিরে দিলেন এক দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে যেখানে পৌঁছালেন, সেখানে বিক্রি হচ্ছে মানুষের কিমা দিয়ে বানানো গোল গোল রুটি! সরু চালের ভাত পছন্দ করেন না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার। তাদের জন্যও আছে ব্যবস্থা। মানুষের নরম হাড় থেকে তৈরি সরু চাল! খাবার শেষে এক খিলি পান মুখে দিতে ইচ্ছা করে অনেকের। তার ব্যবস্থাও আছে। মানুষের চামড়া দিয়ে তৈরি সে পান রসে টইটুম্বর! কী? পান খাওয়ার ইচ্ছাটাই মরে গেল তো?

তাহলে বাকী অংশ আপনার না পড়াই ভালো। কারণ, এরপর যা আছে তা হলো, মানুষের অস্থিমজ্জা দিয়ে বানানো দইয়ের হাঁড়ি। আচ্ছা, আপনি কি নিরামিষাশী? সমস্যা নেই। সে বাজারে আপনি পাবেন হাতির শাদা দাঁত (মুলার পরিবর্তে), কলা সদৃশ মানুষের জিহবা ইত্যাদি সবজি ও ফলমূল।

উপরে বর্ণিত এমনই এক আজব বাজারের খবর আমাদের জানিয়েছেন ষোলো শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। মধ্যযুগের এ কবি তার ‘চণ্ডিমঙ্গল’ কাব্যে এ ভূতের বাজারের কথা উল্লেখ করেছেন। তার কাব্যে মানুষের প্রাত্যহিক খাদ্যসামগ্রীকে অতিপ্রাকৃত রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে।

বাংলা ভূতের গল্পে ভূতদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিভিন্ন আলাপ আছে। তবে ভূতদের সবচেয়ে বেশি পছন্দের খাবার যে মাছ, এতে সবাই একমত। জেলে কিংবা বাজার থেকে মাছ নিয়ে ফেরা কারো পিছু নিয়ে নাকি সুরে মাছ চাওয়া ভূতদের সাধারণ অভ্যাস। প্রথমে তারা ভালোভাবে চায়। পরে ভয় দেখায়। তবে তারা মাছ কীভাবে খেতে পছন্দ করে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

কারো মতে, তারা কাঁচা মাছ ভালোবাসে। কেউ কেউ বলেন, তারা রান্না করা কিংবা ভাজা মাছ খায়। তবে, বাংলা ভূতের গল্পে অন্যান্য ভূতের চেয়ে শাঁকচুন্নিদের মাছের প্রতি তৃষ্ণা থাকে বেশি। এর সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। এক সময় বাঙালি হিন্দু বিধবাদের মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। অনেকেই অল্প বয়সে বিধবা হতেন। তাই সারা জীবন মাছ খেতে না পারার অতৃপ্তি নিয়েই এক সময় তারা মারা যেতেন। মৃত্যুর পর এসব অতৃপ্ত আত্মা শাঁকচুন্নি হয়ে তাদের বাসনা মেটাতেন।

এর আরেকটি ব্যাখ্যা আছে, মাছের প্রতি এ তৃষ্ণা মূলত তাদের বৈবাহিক জীবনে ফিরে যাওয়ার প্রবল আকাঙ্খার প্রতীক। ঐতিহ্য অনুসারে, বাঙালি বিবাহিতা রমণীদের মাছ খাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। অল্প করে হলেও খেতে হতো। তখনকার বিশ্বাস অনুযায়ী, এতে করে তাদের স্বামীরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ও দীর্ঘায়ু হতো। সুতরাং, একজন শাঁকচুন্নির মত্স্যপ্রীতি মূলত তার বৈবাহিক জীবনে ফিরে যাওয়ার তীব্র বাসনাকেই প্রতিফলিত করে।    

স্ক্রল ডট ইন অবলম্বনে নিজাম আশ শামস      

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন